ডেঙ্গুতে শিশু মধুর মৃত্যু!

Spread the love

শরিফুল হাসান

কোনভাবেই ছোট্ট শিশু মধুকে মাথা থেকে বের করতে পারছি না, অথচ মধুকে আমি কখনো দেখিনি। পরিচয় নেই। আজ রাতে আমার চেনা পরিচিত বেশ কয়েকজন ডেঙ্গুতে শিশু মধুর মৃত্যুর কথা লিখে ছবি দিচ্ছেন। গত দুই ঘন্টা চেষ্টা করেও আমি সেই ছবি মাথা থেকে বের করতে পারছি না। বারবার মনে হচ্ছে আমারও একটা ছোট্ট শিশু আছে।

একটা সন্তানকে বাবা-মা কতো আকাঙ্খা করে পান, কতো ভালোবেসে বড় করেন, আর সেই সন্তান যদি ডেঙ্গুতে মরে যায় বুকটা কেমন হাহাকার করে! অথচ প্রতিবছরই একই ঘটনা ঘটছে। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত আর মৃত্যুর রেকর্ড হচ্ছে। হাসপাতালগুলোতে রোজ রোগী বাড়ছে। বিশেষ করে শিশু ওর্য়াডগুলোতে চলছে বাবা-মায়ের আকুতি। রক্ত লাগবে।

কারণ এ বছর ভয়াবহ রূপ নিয়েছে ডেঙ্গু। আমাদের মেয়র আর নীতি নির্ধারকরা বরাবরের মতোই নাগরিকদের সচেতনতার বার্তা দিয়ে খালাস! এর শেষ কোথায়? স্বজনহারাদের আহাজারি থামবে কবে এই দেশে?চিকিৎসকেরা বলছেন, ২০০০ সাল থেকে প্রতিবছরই ডেঙ্গু বাড়ছে। ২০২১ সাল পর্যন্ত প্রবণতাটা ছিল জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রোগী বাড়বে। অক্টোবরে কমবে। নভেম্বরে খুবই কম থাকবে।

গত ২২ বছরের মধ্যে এবারই প্রথম অক্টোবরে সংক্রমণ কমার বদলে বাড়ছে। এখন করনীয় কী? হ্যা, অবশ্যই আমরা আমাদের নিজেদের বাড়িঘর পরিচ্ছন্ন রাখবো যাতে এডিস মশা না জন্মায়। তবে সাধারণ জনগনের পাশাপাশি নগর কর্তৃপক্ষকেও সচেতন হতে হবে। আপনাদের মনে করিয়ে দেই বিশ স্বাস্থ্য সংস্থার একটা গবেষণার কথা।

আমরা সবসময়ই শুনি এডিস মশা বাসাবাড়ি ও আশপাশে জমে থাকা পানিতে বেশি থাকে। কিন্তু বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা বছর তিনেক আগে এক গবেষণায় জানায়, এডিস মশা সবচেয়ে বেশি থাকে সরকারি পরিবহন পুলে। সেখানকার সারিবদ্ধ গাড়ি, টায়ার ও পরিত্যক্ত টিউব যন্ত্রপাতিতে এডিসের বেশি লার্ভা পাওয়া গেছে।

এর পরপরই এডিস থাকে হাসপাতালের নিচে খোলা জায়গায়, ছাদে, পরিত্যক্ত যন্ত্রপাতি ও আসবাবপত্রে। এরপর বেশি থাকে সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন ধরনের যানবাহন স্তূপে। এছাড়া বিমানবন্দরের চৌবাচ্চা ও রানওয়ের আশপাশে, পার্ক, নার্সারি, ফোয়ারা, সিভিল ডিপার্টমেন্টের নির্মাণাধীন ভবনে এডিস মশা থাকে।

সরকারি অফিসগুলো এডিসের বিস্তার বেশি। পাশাপাশি বাসাবাড়ির গ্যারেজে, বাড়ির মূল ফটকের লোহার গেটের ফাঁকে, পরিত্যক্ত কমোডে, বিদ্যুতের তার আটকানোর সরঞ্জামাদিতে মশা ডিম পাড়ে।বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ১৯টি জায়গায় এডিস মশা বেশি পাওয়া গিয়েছিল।

এগুলো হল পুরনো টায়ার, লন্ড্রি ট্যাংক, ঢাকনাবিহীন চৌবাচ্চা, ড্রাম বা ব্যারেল, অন্যান্য জলাধার, পোষা প্রাণীর পাত্র, নির্মাণাধীন ভবনের ব্লক, ফেলে রাখা বোতল ও টিনের ক্যান, গাছের ফোকর ও বাঁশ, দেয়ালে ঝুলে থাকা বোতল, পুরনো জুতা, ফুলের টব, পরিত্যক্ত খেলনা, ছাদে, অঙ্কুরোদগম উদ্ভিদ, বাগান পরিচর্যার জিনিসপত্র, ইটের গর্ত ও অপরিচ্ছন্ন সুইমিং পুল।

কাজেই নগর কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ শুধু নাগরিকদের সচেতন না করে আপনারও আপনাদের কাজ করুন। নাগরিকরাও সচেতন হোক। বিশস্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের প্রধান কিটতত্ত্ববিদ ডা. ভূপেন্দর নাগপাল বছর তিনেক আগে জানিয়েছিলেন, এডিস থাকে ঘরের কোণে খাট-বিছানার নিচে।

দিনের বেলায় এ মশা ঘরের অন্ধকার কোনায়, বিশেষ করে আসবাবপত্রের নিচে ও ঝুলন্ত পোশাকের নিচে থাকতে পছন্দ করে। সাধারণত সূর্যাস্তের পরপরই এবং দুই ঘণ্টা আগে এডিস মশা কামড়ায়। এডিস মশা সর্বোচ্চ ৩-৪ মিটার উড়তে পারে। এজন্য এই সময়ে বাড়ির ভেতর দরজা-জানালা বন্ধ করে মশার ওষুধ স্প্রে করতে হবে।

মনে রাখবেন আপনার বাড়িতে খাট, চেয়ার-টেবিল ও বিছানার নিচে ওষুধ ছিটাতে হবে। যেখানে বেশি মানুষ থাকে, সেখানে এডিস মশা বেশি থাকে। সেখানে বেশি কামড়ায়। ড্রেনের মধ্যে ওষুধ ছিটালে মশা মরবে না। ওখানে মশা থাকে না। উড়ন্ত মশা মারতে হলে সূর্যোদের পরপরই এবং সূর্যাস্তের আগে ওষুধ ছিটাতে হবে।

ফগিং মেশিনে ছিটানো ওষুধে শুধু উড়ন্ত মশা মরে, লার্ভা ধ্বংস হয় না।ভি নাগপাল জানান, এডিস মশা খুব অল্প পানিতে (৫ মিলি বা ১ চা চামচ পানি) ডিম পাড়ে যা পানি ছাড়াও প্রতিকূল পরিবেশেও টিকে থাকতে পারে। লার্ভা ধ্বংসে টেমিফস ১ গ্রাম/১০ লিটার পানিতে খুব কার্যকরী, যা ব্যবহার পরিবেশ ও মানব স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর নয়।

নির্মাণাধীন ভবনের প্রজননস্থল ধ্বংস করে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত রোগের প্রাদুর্ভাব কমানো সম্ভব।যে কোন মানুষের মৃত্যু আমাকে ব্যথিত করে আর সেটা যদি হয় কোন শিশুর মৃত্যু আমার ভীষণ কান্না পায়। নগর কর্তৃপক্ষসহ সবার কাছে অনুরোধ, চলুন আমরা ডেঙ্গুর বিরুদ্ধে নতুন করে যুদ্ধ শুরু করি।

শহরটাকে পরিচ্ছন্ন করি। আমি সবসময় বলি, ক্ষমতাশালীদের টাকা আছে, বিদেশি পাসপোর্ট আছে, নানা বিকল্প আছে কিন্তু আমরা যারা এই বাংলাদেশেই থাকতে চাই তাদের তো কোন বিকল্প নেই। কাজেই মশার বিরুদ্ধেও আমাদেরই লড়তে হবে। আমি সবসময় বলি, এই দেশের প্র‌তিটা অনাকাঙ্খিত বা অস্বাভাবিক মৃত্যু মানে কেউ না কেউ দায়ী।

কাজেই দুই নগর‌পিতাসহ সব কর্তৃপক্ষ‌কে বল‌বো, আপনারা প্লিজ আরেকটু দায়িত্বশীল হন। নয়তো সাবেক মেয়র সাঈদ খোকনের মতোই পরিনতি হবে। পাশাপাশি নাগরিকদেরও দায়িত্বশীল হতে হবে।

চলুন স‌ম্মি‌লিতভা‌বে লড়াই ক‌রি যাতে একটা শিশুও মারা না যায়। মারা না যায় কোন মানুষ। ওপরওয়ালা প্র‌তিটা মানুষকে ভালো রাখুক। ভালো থাকুক প্রতিটা শিশু।

Leave a Reply

Your email address will not be published.