লক্ষ্মীপুর

Spread the love

সন্ত্রাসের পর নির্বাচনেও ‘তাহের’ স্টাইল

শরিফুল হাসান


প্রতিপক্ষের পোলিং এজেন্টদের মারধর, ভোটারদের প্রকাশ্যে ভোট দিতে বাধ্য করা, কেন্দ্রের সামনে বহিরাগতদের মহড়াসহ নানা অনিয়মের এক নির্বাচন দেখল লক্ষ্মীপুরবাসী। ‘সন্ত্রাসের গডফাদার’ বলে পরিচিত আওয়ামী লীগের মেয়র পদপ্রার্থী আবু তাহের বাহিনীর ‘তাণ্ডবে’ গতকাল মঙ্গলবার আতঙ্কের শহরে পরিণত হয় লক্ষ্মীপুর। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি পুনর্নির্বাচন দাবি করে আজ বুধবার লক্ষ্মীপুরে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডেকেছে। গত কয়েক দিনে দেশের বিভিন্ন পৌরসভায় নির্বাচনে যেখানে কেন্দ্রগুলোতে শৃঙ্খলা আর ভোটারদের মধ্যে উৎসাহ দেখা গেছে সেখানে লক্ষ্মীপুরের চিত্র ছিল উল্টো। এখানে ভোটাররা ছিলেন ভয়ে, আর বিএনপির এজেন্টরা ছিলেন আতঙ্কে। স্থানীয়রা বলছে, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর তাহের যেভাবে লক্ষ্মীপুরে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে সবাইকে জিম্মি করে ফেলেছিল, একই স্টাইলে গতকাল পৌর নির্বাচন করেছে তাহের বাহিনী।লক্ষ্মীপুর শহরের পৌর শহীদ স্মৃতি বিদ্যালয়, সাহাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মাদ্রাসা-ই-আলিয়া, সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রসহ বিভিন্ন কেন্দ্র ঘুরে গতকাল চরম বিশৃঙ্খলার দৃশ্য চোখে পড়েছে। প্রতিটি কেন্দ্রের বাইরে বুকে দেওয়াল ঘড়ির প্রতীক লাগিয়ে দুই পাশে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছেন ৫০ থেকে ৬০ জন করে লোক। যেই কেন্দ্রে ঢুকেছে তাকেই বলে দেওয়া হচ্ছিল আবু তাহেরর দেওয়াল ঘড়ি প্রতীকে সিল মারতে হবে।এ তো গেল বাইরের দৃশ্য। কেন্দ্রের ভেতরে গিয়েও দেখা গেল একই দৃশ্য। যে কটি কেন্দ্র ঘুরে দেখা গেছে তার প্রতিটিতেই ১৫ থেকে ২০ জন করে তাহেরের সমর্থক ঘুরছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লোকজনের সঙ্গে। তারা লাইনে দাঁড়ানো ভোটারদের বলে দিচ্ছিল দেওয়াল ঘড়িতে সিল মারতে। পূর্ব বাঞ্চানগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সকাল ১০টায় গিয়ে দেখা গেল, কেন্দ্রের ভেতরেই আবু তাহেরের ভগ্নিপতি শাব মিয়া লোকজন নিয়ে ভোটারদের উপদেশ দিচ্ছেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লোকজন কয়েকবার তাঁদের বের করার চেষ্টা করে পিছিয়ে গেল। দুপুর ১২টা পর্যন্ত লক্ষ্মীপুরের ১৮টি ভোটকেন্দ্রের ১১টি ঘুরে একই রকম দৃশ্য চোখে পড়েছে। স্থানীয়রা জানান, সকাল সোয়া আটটার দিকে ২ নম্বর ওয়ার্ডের বাঞ্ছানগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়কেন্দ্র থেকে বিএনপি-সমর্থক প্রার্থীর এজেন্ট আবুল হাসেম মোল্লা ও নিজামউদ্দিন ভুইয়াকে মারধর করে বের করে দেওয়া হয়। নিজামউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আবু তাহের সবার সামনে কেন্দ্রে ঢুকে আমাকে, হাসেম মোল্লাকে ও নাসিরউদ্দিন হাওলাদারকে পিটিয়ে বের করে দেয়। এরপর তার লোকজন ব্যালট নিয়ে সিল মারতে থাকে।’এই কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা সাহীদ ইমাম প্রথম আলোকে বলেন, তিনি এমন দৃশ্য দেখেননি। তাঁর কাছে কেউ লিখিত অভিযোগও করেনি। ৬ নম্বর ওয়ার্ডের ১০ নম্বর কেন্দ্রের বিএনপি-সমর্থিত প্রার্থীর এজেন্ট আনিসুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘সকালে আবু তাহের কেন্দ্রে এসে আমার গলা চেপে ধরেন। তিনি বলেন, মাইর খেতে না চাইলে এখান থেকে চলে যা।’ প্রিসাইডিং কর্মকর্তা ফরিদ উদ্দিন বলেন, এমন কোনো অভিযোগ তাঁর কাছে নেই। ১১ নম্বর ওয়ার্ডের ১৬ নম্বর কেন্দ্রের বিএনপি-সমর্থিত প্রার্থীর এজেন্ট আনোয়ারুল হক বলেন, ‘আমাকে আবু তাহেরের লোকজন বলে, চলে যা। নইলে লক্ষ্মীপুরে থাকতে পারবি না।’তবে এখানকার প্রিসাইডিং কর্মকর্তা সাহাব উদ্দীন বলেন, তাঁর কাছে কেউ লিখিত অভিযোগ করেনি।৩ নম্বর ওয়ার্ডের কালীগাজী কমিউনিটি বিদ্যালয় কেন্দ্রের এজেন্ট মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘তাহেরের লোকজন কেন্দ্রে এসে আমার পেটে অস্ত্র ঠেকায়। বলে, চলে যা। নইলে গুলি খাবি। এরপর তারা আমাকে মেরে বের করে দেয় এবং ব্যালটে সিল মারা শুরু করে।’ এ কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা আবু তাহের মোল্লা বলেন, ‘বিষয়টি আমি জেনেছি। তবে এখানে বিএনপির মেয়র পদপ্রার্থীর কোনো এজেন্ট খুঁজে পাইনি।’আদর্শ সামাদ উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রে একজন ভোটার প্রথম আলোকে বলেন, ‘তাহেরের এজেন্টরা আমাকে সবার সামনে সিল মারতে বলে। বাধ্য হয়ে আমি দেওয়াল ঘড়িতে সিল মারি। প্রতিবাদ করার সুযোগ ছিল না।’ পৌর শহীদ স্মৃতি একাডেমির একজন মহিলা ভোটার বলেন, ‘কেন্দ্রে প্রবেশের আগেই তাহেরের সমর্থকেরা আমাকে বলে দেয় দেওয়াল ঘড়িতে সিল মারতে হবে। কেন্দ্রে ঢোকার পর তাঁর এজেন্টরাও একই কথা বলে।’ বহিরাগতদের ঠেকাতে দেশের প্রতিটি পৌরসভার প্রবেশপথগুলোতে পুলিশের মহড়া থাকলেও লক্ষ্মীপুরে সেটি ছিল না। ফলে বাইরে থেকে এখানে অবাধে লোকজন যাওয়া-আসা করেছে। গতকাল দুপুর ১২টার পর থেকে বিভিন্ন কেন্দ্রের সামনে গিয়ে তাহেরের সমর্থকদের স্লোগান ও আনন্দ মিছিল করতে দেখা গেছে। এ সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের সরিয়ে দিলেও কিছুক্ষণ পরই তারা এসে আবার জড়ো হচ্ছিল।ভোটার ও এজেন্টরা জানিয়েছেন, আবু তাহের, তাঁর স্ত্রী, দুই ছেলে টিপু ও শিমুল, লক্ষ্মীপুর সদরের ৩ নম্বর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নূরন্নবী চৌধুরী এবং বহিরাগত বিপুলসংখ্যক ক্যাডার প্রতিটি কেন্দ্রে ঢুকে ভোটারদের ভয় দেখিয়েছেন।বিভিন্ন জায়গা থেকে এজেন্টদের বের করে দেওয়ার খবর আসতে থাকায় দুপুর একটায় বিএনপির প্রার্থী হাসানুজ্জামান চৌধুরী ছুটে যান বিএনিপর স্থানীয় সাংসদ শহীদউদ্দিন চৌধুরীর বাসায়। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে এজেন্টরা এসে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ছেন। কীভাবে তাহের ও তাঁর ক্যাডাররা নির্যাতন করেছে তাঁরা তা সাংসদকে জানান। দুপুর দেড়টায় সাংসদ শহীদউদ্দিন চৌধুরী তাঁর বাসায় সংবাদ সম্মেলন ডাকেন। সংবাদ সম্মেলনে মেয়র পদপ্রার্থী হাসানুজ্জামান চৌধুরী বলেন, দুপুর সাড়ে ১২টার মধ্যে ১৮টি কেন্দ্রের মধ্যে ১২টি থেকেই তাঁর লোকজনকে বের করে দিয়েছে তাহেরের লোকজন। এই কেন্দ্রগুলো তাঁর নিজস্ব ভোট ব্যাংক। সাংসদ শহীদউদ্দিন চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, তিনি প্রধান নির্বাচন কমিশনার, একজন কমিশনার এবং জেলার রিটার্নিং কর্মকর্তাসহ সবাইকে এখানকার পরিবেশ সম্পর্কে জানিয়েছেন। কিন্তু স্থানীয় প্রশাসন কোনো ব্যাবস্থা নেয়নি। দুপুর দুইটায় নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেন হাসানুজ্জামান চৌধুরী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘লক্ষ্মীপুর বিএনপির এলাকা। সুষ্ঠু নির্বাচন হলে আমি জয়ী হতাম। কিন্তু আওয়ামী লীগের গডফাদার আবু তাহের নিজে তাঁর সন্ত্রাসীদের নিয়ে সব কেন্দ্র থেকে আমার এজেন্টদের পিটিয়ে বের করে দিয়েছে। বিভিন্ন স্থানে আমার নেতা-কর্মীদের ওপর হামলা চালিয়েছে। আমি কলঙ্কিত এই নির্বাচন বর্জন করে পুনরায় নির্বাচন দাবি করছি।’বিকেল চারটায় সাংসদের কার্যালয়ে ফের সংবাদ সম্মেলন করা হয়। তাতে লক্ষ্মীপুরে বাকি দুই সাংসদ জেলা বিএনপির সভাপতি আবুল খায়ের ভুয়া এবং লক্ষ্মীপুর-১ আসনের সাংসদ নাজিমউদ্দিন আহমেদ উপস্থিত ছিলেন। সংবাদ সম্মেলনে শহীদউদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘নির্বাচনের আগের দিন রাত থেকেই শহরে সন্ত্রাস চালানো শুরু করে গডফাদার তাহের। তারপরও আমরা নির্বাচনে যাই। আমাদের বিশ্বাস ছিল প্রতিটি কেন্দ্রে যদি আমাদের এজেন্টরা সারা দিন থাকতে পারে তাহলে নির্বাচনে আমরা জিতবই। কিন্তু তাহেরের লোকজন সবাইকে বের করে দিয়েছে। এর প্রতিবাদে আমরা নির্বাচন বর্জন করে হরতাল ডেকেছি। লক্ষ্মীপুরের জনগণ এই সন্ত্রাসীকে প্রতিরোধ করবেই। আগামীকালের হরতালে আমি নেতা-কর্মীদের উপস্থিত থাকার নির্দেশ দিচ্ছি।’নির্বাচনের পরিবেশ সম্পর্কে জানতে চাইলে লক্ষ্মীপুরের রিটার্নিং কর্মকর্তা ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক গোলাম মোস্তফা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী প্রতিটি কেন্দ্রে ছিল। সেনাবাহিনী টহল দিয়েছে। সব মিলিয়ে নির্বাচন ভালো হয়েছে। কোনো কেন্দ্র বাতিল করতে হয়নি। আমি নিজেও কয়েকটি কেন্দ্রে গিয়েছি। আমার কাছে ভালো মনে হয়েছে।’ বিএনপির এজেন্টদের বের করে দেওয়ার অভিযোগ সম্পর্কে গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘হয়তো কয়েকটি কেন্দ্রে পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী তারা নিজেরাই বের হয়ে গেছে। কারণ তারা আমার কাছে লিখিত কোনো অভিযোগ দেয়নি।’ রিটার্নিং কর্মকর্তার এই বক্তব্যের বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির প্রার্থী হাসানুজ্জামান চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখানকার পুরো প্রশাসন আবু তাহেরের পক্ষে কাজ করেছে। আমরা প্রধান নির্বাচন কমিশনার, রিটানিং কর্মকর্তাসহ সবাইকে বারবার জানিয়েছি এখানে কী হচ্ছে। নির্বাচন চলাকালেই ফ্যাক্স করে নির্বাচন কমিশনকে ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছি। কিন্তু তারা কোনো ব্যবস্থা নেননি।’নির্বাচনের পরিবেশ সম্পর্কে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগ-সমর্থিত প্রার্থী আবু তাহের প্রথম আলোকে বলেন, ‘লক্ষ্মীপুরের লোকজন আমাকে মেয়র হিসেবে দেখতে চায়। কারণ আমি ক্ষমতায় থাকলেই লক্ষ্মীপুরের উন্নয়ন হয়। জনগণ এটি বিবেচনা করে আমার পক্ষেই ভোট দিয়েছে।’ বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে বিএনপির প্রার্থীদের বের করে দেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেন, ‘নির্বাচনে পরাজিত হবে জেনে তারা এসব বলছে।’

Leave a Reply

Your email address will not be published.