সরেজমিন মুন্সিগঞ্জ-৭

Spread the love

কমেছে কীটনাশক ও সারের ব্যবহার

শরিফুল হাসান 

মুন্সিগঞ্জের সদর উপজেলার পঞ্চসার ইউিনয়নের কেবিরবাগ এলাকায় চাষি মনির হোসেন তাঁর আবাদকৃত সবজিখেেত সার দিচ্ছেন l ছবি: প্রথম আলো
মুন্সিগঞ্জের সদর উপজেলার পঞ্চসার ইউিনয়নের কেবিরবাগ এলাকায় চাষি মনির হোসেন তাঁর আবাদকৃত সবজিখেেত সার দিচ্ছেন l ছবি: প্রথম আলো

বৌদ্ধ পণ্ডিত অতীশ দীপঙ্করের জন্মস্থানের কারণে মুন্সিগঞ্জ সদর উপজেলার বজ্রযোগিনী গ্রামটি বিখ্যাত। মুন্সিগঞ্জ শহর থেকে গাড়িতে করে এই গ্রামে যাওয়ার সময় রাস্তার দুই পাশে চোখে পড়বে সবজিখেত। কোনো খেতে ফুলকপি, কোনোটিতে বাঁধাকপি, কোনোটিতে টমেটো আবার কোনোটিতে বেগুন চাষ করা হয়েছে। দেখে মনে হবে, সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা কোনো গ্রাম।
বাস্তবের মুন্সিগঞ্জও তাই। প্রায় এক লাখ কৃষক এখন আলু ও সবজি চাষ করছেন। গত পাঁচ বছরে আবাদি জমির পরিমাণ কমলেও জেলায় আলুসহ বিভিন্ন সবজির উৎপাদন বেড়েছে প্রায় দুই লাখ মেট্রিক টন।
স্বস্তির খবর আরও আছে। জমিতে ইউরিয়া, টিএসপি ও পটাশ সারের ব্যবহার ধারাবাহিকভাবে কমেছে। কমেছে কীটনাশকের ব্যবহারও। টঙ্গিবাড়ী উপজেলার ধীপুর ইউনিয়নের মাইরাল গ্রামের কৃষক শামসুল হক (৬০) বলেন, ‘১৫ বছর ধরে আলু চাষ করছি। এবার ৪ একর ২০ শতাংশ জমিতে আলু চাষ করেছি। কৃষি অফিসের পরামর্শে দুই বছর ধরে সারের ব্যবহার কমিয়েছি। এখন প্রতি গন্ডায় (৭ শতাংশে এক গন্ডা) ১০ কেজি ইউরিয়া, টিএসপি ১৫ কেজি ও ২০ কেজি পটাশ ব্যবহার করছি। কয়েক বছর আগেও প্রতি গন্ডায় ২০ কেজি ইউরিয়া দিতাম।’
আলু চাষের সাফল্যে পুরো জেলায় পরিচিতি পাওয়া মীর সিরাজ প্রথম আলোকে বলেন, জেলার অধিকাংশ কৃষক আলুসহ বিভিন্ন সবজি চাষে সার ও কীটনাশকের ব্যবহার কমিয়েছেন। এতে উৎপাদন খরচ কমেছে। আবার সুষমভাবে সারের ব্যবহার করায় আগের চেয়ে উৎপাদন বেড়েছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা মো. হুমায়ুন কবির প্রথম আলোকে বলেন, মুন্সিগঞ্জের আলু ও সবজি সারা দেশের চাহিদা মেটাচ্ছে
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, কোন জমিতে কতটুকু সার ব্যবহার করতে হবে, সে বিষয়ে কৃষকদের দিন দিন সচেতন করা হচ্ছে। এ ছাড়া কীটনাশকের অপ্রয়োজনীয় ব্যবহারও বন্ধ হচ্ছে। ফলে গত পাঁচ বছরে হেক্টরপ্রতি উৎপাদন বেড়েছে চার মেট্রিক টন। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে মুন্সিগঞ্জে ১৩ লাখ ১৬ হাজার ১২ মেট্রিক টন আলু উৎপাদিত হয়েছে। এই সংখ্যা সারা দেশের উৎপাদিত আলুর এক-পঞ্চমাংশ। এখন মুন্সিগঞ্জের ২০ হেক্টর জমিতে বীজতলা হচ্ছে। এখানকার ফুলকপি, বেগুন ও টমেটোসহ নানা জাতের সবজির চারা যাচ্ছে সারা দেশে।
মুন্সিগঞ্জের কন্দাল (মাটির নিচে যে ফসল জন্মায়) ফসল গবেষণা উপকেন্দ্রের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. নিজামউদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, আগে প্রতি হেক্টর জমির আলু চাষে ৯০০ কেজি ইউরিয়া সার ব্যবহার হতো। এখন তা ৫০০ থেকে ৫৫০ কেজিতে নেমে এসেছে। অন্য সবজির চাষেও কীটনাশক ও সারের ব্যবহার কমেছে। যথাযথ প্রচারণা চালাতে পারলে ইউরিয়ার ব্যবহার আরও কমানো সম্ভব হবে।
নিজামউদ্দিন বলেন, কৃষককে সারের সুষম ব্যবহার সম্পর্কে বোঝাতে পারছেন। এ ছাড়া প্রকৃতির অবদানও আছে। এই জেলার চাষের বেশির ভাগ জমি নিচু। বর্ষায় পানি এসে পলি জমে এবং সার ও কীটনাশকের বিষ নষ্ট হওয়ায় জমির উর্বরতা ঠিক থাকছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মুন্সিগঞ্জ জেলা কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০১১-১২ অর্থবছরে জেলায় ইউরিয়ার ব্যবহার ছিল ৪১ হাজার মেট্রিক টন। কিন্তু ২০১৪-১৫ সালে সেটি কমে হয়েছে ৩৬ হাজার ৭০০ মেট্রিক টন। ২০১১-১২ অর্থবছরে টিএসপির ব্যবহার হতো ৩১ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন। এখন সেটি কমে হয়েছে ২৬ হাজার মেট্রিক টন। তখন পটাশের ব্যবহার হতো ৩০ হাজার মেট্রিক টন, এখন কমে হয়েছে ২৫ হাজার মেট্রিক টন।
জানতে চাইলে মুন্সিগঞ্জ জেলা পেস্টিসাইড সমিতির সভাপতি সুজন চন্দ্র সাহা প্রথম আলোকে বলেন, কৃষকদের মধ্যে কীটনাশকের ব্যবহারের আগ্রহ আগের চেয়ে কমেছে।
সার পর্যবেক্ষণ কমিটির সভাপতি ও মুন্সিগঞ্জের জেলা প্রশাসক মো. সাইফুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, কৃষি কর্মকর্তাদের নানামুখী উদ্যোগে কৃষকেরা সচেতন হয়েছেন। ফলে সার ও কীটনাশকের ব্যবহার কমেছে।
সারের ব্যবহার কমলেও গত পাঁচ বছরে আলুর উৎপাদন প্রায় দেড় লাখ মেট্রিক টন বেড়েছে। ২০১০-১১ অর্থবছরে জেলার ৩৮ হাজার ৬ হেক্টর জমিতে ১১ লাখ ৯৭ হাজার ১৮৯ মেট্রিক টন আলু উৎপাদিত হয়। আর ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৩৭ হাজার ৬০০ হেক্টর জমিতে ১৩ লাখ ১৬ হাজার ১২ মেট্রিক টন আলু উৎপাদন হয়েছে।
আলুর পাশাপাশি বেড়েছে অন্য সবজির উৎপাদনও। ২০১০-১১ অর্থবছরে ৩ হাজার ৭৯৫ হেক্টর জমিতে ৬৩ হাজার ২ মেট্রিক টন সবজি উৎপাদিত হয়। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৪ হাজার ৬৫ হেক্টর জমিতে ১ লাখ ৬৮১ মেট্রিক টন সবজি উৎপাদন হয়েছে। অর্থাৎ পাঁচ বছরে প্রায় ৪০ হাজার মেট্রিক টন সবজির উৎপাদন বেড়েছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০১০-১১ অর্থবছরে হেক্টরপ্রতি আলুর উৎপাদন ছিল সাড়ে ৩১ মেট্রিক টন। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে সেটি ৩৫ মেট্রিক টন হয়েছে।
সিরাজদিখানের ইছাপুরা ইউনিয়নের কুসুমপুর এলাকার কৃষক আবদুল মান্নান (৪৮) প্রথম আলোকে বলেন, ‘কয়েক বছর ধরে ১৫ কানি (এক কানিতে ১৪০ শতাংশ) জমিতে আলু চাষ করছি। এ বছরও প্রস্তুতি নিচ্ছি। আগে প্রতি গন্ডা জমিতে ৫০ কেজি সার ব্যবহার করতাম। এখন ৪০ কেজি ব্যবহার করছি। জৈব সারের ব্যবহার বাড়িয়েছি। এর ফলে প্রতি কানিতে ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা সাশ্রয় হচ্ছে। উৎপাদন বাড়ছে।’

Leave a Reply

Your email address will not be published.