নির্ধারিত খরচ ৩৩ হাজার লাগছে সাড়ে তিন লাখ
শরিফুল হাসান
জি টু জি প্লাস প্রক্রিয়ায় মালয়েশিয়ায় কর্মী যাওয়ার সরকার-নির্ধারিত খরচ ৩৩ হাজার ৫৭৫ টাকা। কিন্তু কর্মীপ্রতি খরচ হচ্ছে দুই থেকে সাড়ে তিন লাখ টাকা। অর্থাৎ, নির্ধারিত খরচের ১০ গুণ পর্যন্ত দিতে হচ্ছে। ভুক্তভোগী ব্যক্তিরা বলছেন, খরচের বিষয়ে তাঁদের মুখ খুলতে বারণ করা হয়েছে।
কিন্তু প্রথম আলোর অনুসন্ধানে অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের চিত্র উঠে এসেছে। এ ব্যাপারে সরকারেরও কোনো নজরদারি নেই। ব্যবসায়ীরা বরাবরের মতোই বলছেন, মাঠপর্যায়ের দালালেরা অতিরিক্ত টাকা নিচ্ছেন। আর যে খরচ নির্ধারণ করা হয়েছে সেটা বাস্তবসম্মত নয়।
কাগজে ৩৩ হাজার, বাস্তবে কয়েক গুণ
জি টু জি চুক্তির আওতায় মালয়েশিয়ায় যাওয়ার খরচ নির্ধারণ করা হয়েছিল ৩৩ হাজার টাকা। এই চুক্তির আওতায় মাত্র আট হাজার কর্মী গেলেও তাঁরা অতিরিক্ত টাকা দিয়েছিলেন, এমন অভিযোগ ছিল না। জি টু জি প্লাসে নির্ধারিত খরচ ৩৩ হাজার ৫৭৫ টাকা। তবে চিত্র উল্টো।
১৫ মার্চ আইএসএমটি হিউম্যান রিসোর্স, প্যাসেজ অ্যাসোসিয়েটস, রাব্বী ইন্টারন্যাশনালসহ মোট চারটি জনশক্তি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ১৩২ জন কর্মী মালয়েশিয়ায় গেছেন। তাঁদের একজন টাঙ্গাইলের নিজাম উদ্দিন। খরচের বিষয়ে সেদিন জানতে চাইলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘কী লাভ এসব বলে? আমাদের বলে দেওয়া হয়েছে এসব নিয়ে কারও সঙ্গে কথা না বলতে। মাসে বাংলাদেশি টাকায় ১৮ হাজার টাকা বেতন।’
টিপু সুলতান নামের একজন প্রথম আলোকে বলেন, ‘সাড়ে তিন লাখ টাকা খরচ করে যাচ্ছি। সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে মানা করা হয়েছে। আর বললেও বলতে হবে ৩৩ হাজার টাকা লেগেছে।’
>* কাজ পেয়েছে ১০ প্রতিষ্ঠান * ব্যবসায়ীরা বলছেন, মাঠপর্যায়ের দালালেরা অতিরিক্ত টাকা নিচ্ছেন। নির্ধারিত খরচ বাস্তবসম্মত নয় * সরকারের নজরদারি নেই
মালয়েশিয়ায় যাওয়ার আগে কফিলউদ্দিন আহমেদ, নাসির আলী, আশরাফুল, ইমাম হোসেনসহ আরও ২৫ জনের সঙ্গে ঢাকার বিভিন্ন স্থানে কথা হয় প্রথম আলোর। তাঁরাও যাওয়ার খরচ বলতে রাজি হননি। কেউ মধ্যস্বত্বভোগীদের মাধ্যমে আবার কেউ সরাসরি জনশক্তি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানে যোগাযোগ করেন। মালয়েশিয়ায় যাওয়া জহিরুল ইসলামের বাবা শাহজামাল বলেন, ছেলেকে পাঠাতে ৩ লাখ ৪০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। ঋণ করে টাকা জোগাড় করেছেন।
অভিযোগের বিষয়ে আইএসএমটি হিউম্যান রিসোর্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরিফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা সরকার-নির্ধারিত যে খরচ, সেই টাকাই নিচ্ছি। এর বাইরে টাকা নিচ্ছি না।’ সরকার-নির্ধারিত খরচে কর্মী পাঠিয়ে ব্যবসা করা সম্ভব কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সরকার তো নীতিমালা করার সময় আমাদের কাউকে রাখেনি। রাখলে আমরা আমাদের কথা বলতে পারতাম। তবে শুরুর দিকে কিছুটা এলোমেলো হচ্ছে। ঢাকার বাইরে মধ্যস্বত্বভোগীদের আমরা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি না। তবে আশা করছি, দ্রুতই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক ব্যবসায়ী বলেন, বেশি টাকা লাগার বড় কারণ মালয়েশিয়ার এক বাংলাদেশি ব্যবসায়ীকে প্রতি ভিসার জন্য টাকা দিতে হচ্ছে।
১১ মার্চ প্রান্তিক ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরিজম, আইএসএমটি ও রাব্বী ইন্টারন্যাশনালের মাধ্যমে ১০০ জন মালয়েশিয়ায় গেছেন। তাঁদের একজন যশোরের রাহুল হোসেনের মামা নুরুজ্জামান বলেন, ‘৩ লাখ টাকা লাগছে। জমি বন্ধক রেখে টাকা জোগাড় করেছি।’
আরও ১০ জন অতিরিক্ত টাকা দেওয়ার অভিযোগ করেন। প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, তিনি এক গরিব আত্মীয়কে মালয়েশিয়ায় পাঠাতে একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তাঁকে বলা হয়, অন্যদের কাছ থেকে আড়াই থেকে তিন লাখ টাকা নেওয়া হচ্ছে। তবে তাঁর আত্মীয়ের জন্য ন্যূনতম ১ লাখ ৮৫ হাজার টাকা রাখা যাবে।
এত বেশি টাকা নিলেও মন্ত্রণালয় ব্যবস্থা নিচ্ছে না কেন—এ প্রশ্নে ওই কর্মকর্তা বলেন, যারা এবার ব্যবসা করছে, তাদের বিরুদ্ধে মন্ত্রণালয়ের আসলে খুব বেশি কিছু করার নেই। কারণ, তারা খুব প্রভাবশালী। আর সরকার চাইছে লোক যাওয়া শুরু হোক। প্রচুর লোক গেলে হয়তো খরচ কমে আসবে।
এর আগে ২০০৭ ও ২০০৮ সালে কলিং ভিসায় মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর খরচ সরকার নির্ধারণ করেছিল ৮৪ হাজার টাকা। তখন যাঁরা গিয়েছিলেন, তাঁদেরও টাকার অঙ্ক জানাতে নিষেধ করা হয়েছিল। পরে কাজ না পাওয়াসহ নানা অভিযোগ উঠলে তাঁরা দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা দেওয়ার কথা জানিয়েছিলেন।
জানতে চাইলে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী নুরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা সব সময়ই মালয়েশিয়ায় সিন্ডিকেটের বিপক্ষে ছিলাম। যা হওয়ার মালয়েশিয়া থেকে হয়েছে। তবে অতিরিক্ত খরচের বিষয়ে এখনো কোনো অভিযোগ পাইনি। পেলে খতিয়ে দেখা হবে।’
বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অতিরিক্ত টাকা নেওয়ার অভিযোগের বিষয়ে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজের (বায়রা) মহাসচিব রুহুল আমিন বলেন, ‘আমরা যত কম টাকাই নিই না কেন, যাঁরা যাচ্ছেন তাঁদের ধারণা, মালয়েশিয়া যেতে দুই থেকে তিন লাখ টাকা লাগে। ফলে তাঁরা মধ্যস্বত্বভোগীদের টাকা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকেন। সমস্যার সমাধানে আমরা কাজ করছি।’
১০ প্রতিষ্ঠানের হাতে সব কাজ
নানা অভিযোগে ২০০৯ সালে বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেওয়া বন্ধ করেছিল মালয়েশিয়া। ২০১২ সালের ২৬ নভেম্বর সরকারিভাবে কর্মী পাঠাতে দুই দেশ জি টু জি চুক্তি করলেও তেমন কর্মী পাঠাতে পারেনি। গত বছরের ১৮ ফেব্রুয়ারি বেসরকারি ব্যবসায়ীদের অন্তর্ভুক্ত করে জি টু জি প্লাস সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। এর আওতায় এ বছরের ১১ মার্চ থেকে কর্মী পাঠানো শুরু হয়েছে। তবে হাজারখানেক জনশক্তি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান থাকলেও এবার কাজ পেয়েছে মাত্র ১০টি প্রতিষ্ঠান।
এই ১০ প্রতিষ্ঠান হলো বায়রার মহাসচিব রুহুল আমিনের মালিকানাধীন ক্যাথারসিস ইন্টারন্যাশনাল, বায়রার সাবেক সভাপতি নুর আলীর ইউনিক ইস্টার্ন, সাবেক সভাপতি গোলাম মোস্তফার প্রান্তিক ট্রাভেলস, ব্যবসায়ী রুহুল আমিনের আমিন ট্যুরস, বদরুল আমিনের ক্যারিয়ার ওভারসিজ, আরিফুল ইসলামের আইএসএমটি হিউম্যান রিসোর্স, শেখ আবদুল্লাহর সনজরী ইন্টারন্যাশনাল, মোহাম্মদ বশিরের রাব্বী ইন্টারন্যাশনাল, আরিফ আলমের প্যাসেজ অ্যাসোসিয়েটস ও জয়নাল আবেদিনের আল ইসলাম ওভারসিজ।
এই ১০ প্রতিষ্ঠানের বদলে সবাই যেন কাজ পান, সে জন্য ব্যবসায়ীরা আন্দোলনের পর আদালতেও গেছেন। তাঁদের অভিযোগ, কাজ পাওয়া কয়েকজন নিজেদের সরকারের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচয় দিয়ে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছেন।
বায়রার সাবেক সভাপতি গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘এবার একটা নতুন পদ্ধতিতে কর্মীরা যাচ্ছে। এটি সফল হলে অন্যরাও আস্তে আস্তে কাজ পাবে। আর ১০ বছর আগে যেখানে খরচ ছিল ৮৪ হাজার টাকা, সেখানে এখন ৩৩ হাজার টাকায় লোক পাঠাতে বলা অবাস্তব। সরকারের উচিত এমনভাবে খরচ নির্ধারণ করা যেন আমরা সবাই সেটা মানতে পারি।’
শেখ আবদুল্লাহ বলেন, ‘আমরা সরকারকে প্রস্তাব দিয়েছি সৌদি আরবে যাওয়ার খরচ যেমন ১ লাখ ৬৫ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে, মালয়েশিয়ার খরচ তেমনি ১ লাখ ৭৫ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হোক। আমরা প্রয়োজনে সেই টাকা ব্যাংকে নেব।’
অভিবাসন-বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) সমন্বয়ক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক সি আর আবরার প্রথম আলোকে বলেন, ‘জি টু জি প্লাস করার পেছনে সবচেয়ে বড় যুক্তি ছিল কম খরচে লোক যেতে পারবেন। এখন যদি আড়াই থেকে সাড়ে তিন লাখ টাকাতেই লোক যান, তাহলে বলতে হবে পুরো প্রক্রিয়াই ব্যর্থ। সরকারকে অবশ্যই এর দায় নিতে হবে। একই সঙ্গে যে ১০টি প্রতিষ্ঠান লোক পাঠাচ্ছে, তাদেরও দায় নিতে হবে। কারণ, সাড়ে তিন লাখ টাকা খরচ করে একজন যদি ১৮ হাজার টাকা বেতনে যান, তিনি কবে এই টাকা তুলবেন? এটা তো শোষণ ছাড়া কিছুই নয়।’