মকসুদ ভাই!

Spread the love

শরিফুল হাসান

‘নিজের সরকারি চাকরি আর পরিবারের স্বাচ্ছন্দ্যের চেয়ে মত প্রকাশের স্বাধীনতা আমার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কাজেই ইস্তফা দিচ্ছি।’ কতোটা সাহস থাকলে একজন মানুষ এভাবে ভাবতে পারেন। করতে পারেন। সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদ পেরেছিলেন। দেখতে দেখতে দুই বছর চলে গেল মকসুদ ভাই আমাদের মাঝে নেই।

কিন্তু মত প্রকাশের স্বাধীনতার জন্য তাঁর যে লড়াই যতো দিন যাচ্ছে সেটা বোধহয় আরও বেশি প্রাসঙ্গিক হচ্ছে। আজ দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর সি মজুমদার মিলনায়তনে সকাল ১০ টায় একটি আলোচনা অনুষ্ঠান অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছি আমরা সৈয়দ আবুল মকসুদ স্মৃতি সংসদ।

ইমিরেটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী স্যার সেখানে সভাপতিত্ব করবেন। রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে সাংবাদিক অনেকেই থাকবেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অনুষ্ঠানে যোগদানের আমন্ত্রণ। এই ফাঁকে আমি বরং মকসুদ ভাইকে নিয়ে কিছু কথা বলি।আসলে মকসুদ ভাই আমার খুব পছন্দের মানুষ ছিলেন। আমি সবসময় বলতাম, সাধারণে অসাধারণ এক মানুষ মকসুদ ভাই।

তিনি কতটা সাধারণ জীবনযাপন করতেন সেটা খুব কাছ থেকে না দেখলে বোঝা যাবে না। সব ধরনের বিলাসিতা তিনি এড়িয়ে চলতেন। আপনারা অনেকেই জানেন, ২০০৩ সালে ইরাকে মার্কিন হামলার প্রতিবাদে সেলাইবিহীন সাদা চাদর পরা শুরু করেছিলেন আবুল মকসুদ। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সেই পোশাকই ছিল তার নিত্যসঙ্গী।

সেলাইবিহীন এই সাদা চাদর পরে ন্যায়ের জন্য লড়াই করতে তিনি ছুটতেন দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়কের শেষ প্রান্তে তার বাসায় গিয়ে দেখেছি বই আর লেখালেখির সঙ্গে তার মিতালি। শুনেছি তার জীবনের গল্প। তিনি তাই বলতেন যা তিনি বিশ্বাস করতেন। তিনি সেই জীবনযাপনই করতেন যার কথা তিনি বলতেন। কথায়-কাজে এতো মিল এই দেশের খুব কম মানুষেরই আছে!।

কেন তিনি সাদা কাপড় পরতে শুরু করলেন, কেন তিনি হুমায়ুন আজাদের ওপর হামলার প্রতিবাদে লিখে বাসসের চাকরি ছেড়েছেন, এই দেশ, মানুষ, সমাজ এসব নিয়ে তার সঙ্গে আমার দিনের পর দিন অনেক গল্প হয়েছে। বিশেষ করে ২০১১ সালের আগস্টে চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ ও এটিএন নিউজের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মিশুক মুনীর সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাওয়ার পর নিরাপদ সড়কের দাবির আন্দোলনের সময় তার সঙ্গে অনেক বেশি ঘনিষ্ঠতা।

এই দেশের অনেক বড় মানুষের কাছে গেলে তাদের কথা শুনে, জীবনযাপনের দ্বিচারিতা দেখে মনে হয় তারা আসলে বড় নন। কিন্তু, মকসুদ ভাইয়ের সঙ্গে যখুনি কথা হতো মনে হতো মানুষটা এতো ভালো কেন? এই যুগেও কিভাবে এতো নির্লোভ, সাদাসিধে জীবন যাপন করেন? মানুষের জন্য এতো দরদ কী করে হয় একজন মানুষের?সৈয়দ আবুল মকসুদের জীবনবোধ ছিল ভীষণ গভীর, মানুষের জন্য তার মমত্ববোধ ছিল অসাধারণ। সাংবাদিকতা, লেখালেখি তিনি ভীষণ উপভোগ করতেন। আমার কোন রিপোর্ট তার পছন্দ হলে ফোন দিয়ে কথা বলতেন। প্রবাসীদের নিয়ে তার অনেক আগ্রহ ছিল।

অনেকবার এ নিয়ে লেখালেখি করেছেন। তিনি বলতেন, ‘প্রবাসীদের প্রতি আমাদের আরও যত্নশীল হওয়া দরকার’। তাদের যথাযথ সম্মান দেওয়া দরকার। তিনি বলতেন, রাষ্ট্র-দূতাবাস-এজেন্সি সবাই মিলে সামগ্রিকভাবে উদ্যোগ না নিলে প্রবাসীদের দুর্দশা কখনো শেষ হবে না।সহজিয়া কড়চা’ ও ‘বাঘা তেঁতুল’ শিরোনামে এই দেশ, সমাজ, রাজনীতি, সাহিত্য-সংস্কৃতি, মানবাধিকার, পরিবেশ— সবই তো তুলে এনেছেন! আমাকে তিনি বলতেন, ঝড়বৃষ্টি, জ্বর-জরা যাই হোক না কেন এমন কোন সপ্তাহ নেই যে তিনি তার কলাম লেখা বন্ধ রেখেছেন। সৈয়দ আবুল মকসুদ খুব সাবলীল ভাষায় জরুরি ও ন্যায্য কথাগুলো লিখতেন।

২০২০ সালে বিজয় দিবসে ‘সুবর্ণজয়ন্তীর সূচনায় শতবার্ষিকীর প্রতিজ্ঞা’ শিরোনামে তিনি লিখছেন, ‘স্বাধীনতার পাঁচ দশকেও বাংলাদেশে সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক রাজনীতি বিকশিত হতে না পারার কারণ শক্তিশালী রাজনৈতিক সংগঠনের অভাব। সরকারি ও বিরোধী পক্ষে সুসংগঠিত গণভিত্তিক দল না থাকলে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায় না।’এই তিনি আবার লিখছেন, ‘গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জবাবদিহি ও ভারসাম্য রক্ষার জন্য স্বশাসিত সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান থাকে। বাংলাদেশেও আছে। কিন্তু, সেসব প্রতিষ্ঠান তাদের স্বকীয় সত্তা হারিয়ে ফেলেছে। নির্বাহী বিভাগের চাপে অন্য যেকোনো সরকারি অফিসের মতো সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানও সরকারি দপ্তর মাত্র।’

একদিকে লিখতেন আরেক দিকে শান্তি, অহিংসা, আর মানবতার বাণী নিয়ে ছুটে বেড়াতেন দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। নিজের সম্পদ, বাড়ি-গাড়ি এসবের দিকে কোন আগ্রহই ছিল না। মানিকগঞ্জে পারিবারিক বাড়িটি বন্যায় ভেসে যাওয়ার পর তিনি আর কখনো জমিজমা-বাড়ি— এ সবে নজর দেননি। বরং সততা, সাধারণ জীবনযাপন শেখাতেন সবাইকে।

পারিবারিকভাবে এসবের চর্চা করতেন। সৈয়দ আবুল মকসুদের জন্ম ১৯৪৬ সালের ২৩ অক্টোবর মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলার এলাচিপুর গ্রামে। শৈশব থেকে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন পত্রিকা পড়তেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লেখাপড়া করে কর্মজীবন শুরু করেন ১৯৬৪ সালে সাপ্তাহিক নবযুগ পত্রিকায় সাংবাদিকতার মাধ্যমে। দেশ স্বাধীনের পর রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থায় (বাসস) যোগ দেন।

পদত্যাগ করেন ২০০৪ সালে। ওই বছরের ২৭ ফেব্রুয়ারি বইমেলা থেকে ফেরার পথে লেখক হুমায়ুন আজাদের ওপর হামলা হয়। সৈয়দ আবুল মকসুদ তখন বাসস’র উপপ্রধান বার্তা সম্পাদক। এই হামলার প্রতিবাদে তিনি ২০০৪ সালের ১ মার্চ প্রথম আলো’তে ‘হুমায়ুন আজাদের ওপর আঘাত–ফ্যাসিবাদের নগ্নরূপ’ শিরোনামে একটি কলাম লেখেন। বিএনপি তখন ক্ষমতায়। মকসুদ ভাইয়ের সেই লেখাটি ছাপা হওয়ার পর তাকে বলা হলো সরকারি সংস্থায় কাজ করে তিনি যেন আর পত্রিকায় কলাম না লেখেন।

মকসুদ ভাই রাজি হননি। তিনি পত্রিকায় কলাম লেখার পথটিই বেছে নিলেন এবং বাসস থেকে পদত্যাগ করলেন। অসাধারণ সেই পদত্যাগপত্র! আমার কাছে সেটা আছে। সৈয়দ আবুল মকসুদ পদত্যাগপত্রে লিখেছিলেন, ‘বাংলাদেশ যখন আজ বহুদলীয় গণতন্ত্র বিকাশের উজ্জ্বল সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে সেই মুহূর্তে মত প্রকাশের ওপর বিধিনিষেধ বেদনাদায়ক। আমি স্বাধীন মতপ্রকাশ করব নাকি কারো আদেশমত লেখালেখি বন্ধ রেখে শুধু জীবিকার জন্য চাকরি করে যাব তা নিয়ে অনেক ভেবেছি। ভেবেচিন্তে স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমার চাকরি, পরিবার পরিজনের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের বিনিময়ে আমি যদি অন্যায় অবিচারের প্রতিবাদ না করি তাহলে দেশের কোটি কোটি নিপীড়িত শোষিত দুঃখিত মানুষের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা হবে।

আমার ৪২ বছরের জীবনে আমি আমার বিবেকের সঙ্গে প্রতারণা করিনি। আমি চাকরি থেকে ইস্তফা দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’আমি যতোবার এই চিঠি পড়ি আমার ভীষণ গর্ব অনুভব হয় যে আমি সৈয়দ আবুল মকসুদকে চিনতাম। তাঁর ভালোবাসা পেয়েছিলাম। কথায় আর কাজে কিভাবে মিল রাখা যায়, মোলায়েম কণ্ঠেও কতোটা দৃঢ় হওয়া যায, মাথা উঁচু করে বুদ্ধিজীবী হিসেবে কিভাবে বাঁচতে হয়, রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে কিভাবে প্রতিবাদ করেতে হয়, কিভাবে দেশ ও দেশের মানুষকে ভালোবাসতে হয়—এই দেশে এসবকিছুরই পাঠ্য হতে পারেন সৈয়দ আবুল মকসুদ। আপনার জন্য ভালোবাসা। আজ দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকীর সকালে আপনাকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি।

Leave a Reply

Your email address will not be published.