নানান ব্যস্ততা আর কাজের চাপে ব্লগে আসার সময় হয়ে ওঠে না। তারপরেও আজ না এসে পারলাম না। এই ব্লগের একটি ছোট্ট লেখা, আমার একটি ছোট্ট নিউজ কিভাবে বদলে দিয়েছে এক কিশোরের, একটি পরিবারের জীবন সেই ভালোলাগা না বলে ভালো লাগছে না। তাই এলাম লিখতে। একটি ছোট্ট খবর দিয়ে পুরোনো লেখাটি কিছুটা আডপেট করে দিলাম। শেষ খবরটি হলো আকতার অস্ট্রেলিয়া থেকে চিকিৎসা শেষে দেশে ফিরেছে। সকালেই শোভন ভাই খবরটা দিলেন।
পুরোনো কথা:
সাত বছল ধরে সাংবাদিকতায়। এর মধ্যে অনেক নিউজ করছি, অনেকগুলো লিডও। নিউজ ছাপার পর পাঠক বা বন্ধুদের ফোনে তৃপ্তও হয়েছি অনেকবার। বিশেষ করে সেতু বা কাদের সিদ্দিকীকে নিয়ে লিডের পর। কিন্তু বিডিআরের ঘটনায় আহত এক কিশোরকে নিয়ে করা একটি সংবাদ প্রকাশের পর মানবতার যে অনন্য রুপ দেখলাম সে অন্যরকম পাওয়া। অনেক ভালো লেগেছে।
এই ব্লগেই বিডিআরের ঘটনায় আহত কিশোর আকতারকে নিয়ে শোভন ভাইয়ের একটা লেখা স্টিকি করা ছিল ২০০৯ সালের আগস্টে। সেটি দেখে পড়ে আকতারের জন্য খারাপ লাগে। এরপর খোঁজ নিয়ে আকতারের সঙ্গে কথা বলে একটি ছোট্ট নিউজ করি।
১৩ বছরের কিশোর আকতার চা বিক্রি করে সংসার চালাতো। বিডিআরের ঘটনার দিন সে চা বিক্রি করছিলো ঝিগাতলা এলাকায়। হঠাৎ একটি গুলি এসে লাগে তার। অনেক্ষন পড়ে থাকার পর এক রিকশাওয়ালা তাকে নেয় ঢাকা মেডিকেলে। বাড়ির জমি বিক্রি করে ছেলের চিকিৎসা করায় আকতারের বাবা। কিন্তু একসময়ে টাকা শেষ হয়ে যায়। বন্ধ হয়ে যায় চিকিৎসা। পঙ্গু হয়ে যায় আকতার। সর্বস্ব হারানো বাবা কাঁদতে কাঁদতে বিলাপ করে বলেন, আমার ছেলেটা কেন গুলিতে মারা গেলো না। তাহলে তো এতো কষষ্ট ওকে পেতে হতো না।
আকতারকে নিয়ে আমার এই নিউজটা ছাপা হয় রাজধানী পাতায়। ২০০৯ সালের ৩ সেপ্টেম্বর। গুরুত্বপূর্ণ নিউজ প্রথম বা শেষ পাতায় না সে ভেতরের পাতায় এলে আর কার কি হয় জানি না; তবে আমার বেশ খারাপ লাগে। কাজেই নিজের করা ওই সংবাদটি রাজধানীর পাতায় আসায় আমার কিছুটা খারাপ লেগেছিলো। মনে হয়েছিলো বেশি কিছু হবে না। কিন্তু এই সংবাদের সূত্র ধরে মানবিকতার যে রুপ আমি দেখলাম এবং আজো দেখছি তাতে অন্যরকম শান্তি পেলাম।
৩ সেপ্টেম্বরের কথা:
সংবাদটি প্রকাশের পর প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে আমায় ফোন করলো। এরপর একজন কর্মকর্তা আমার মাধ্যেম আকতকারের সঙ্গে যোগযোগ করলো এবং জানাল তারা দেখবে বিষয়টি। ভালো লাগলো শুনে। সারাদিনে আরো কিছু ফোন পেলাম এ নিয়ে। কিন্তু খুব ভালো লাগলো যখন বৃহষ্পতিবার রাতে একটি ফোন পেলাম মিরপুর থেকে। উনি জানালেন আকতারকে সাহায্য করতে চান। শুক্রবার সকাল ১১ টায় তাকে লালমাটিয়া আসতে বললাম। যথারীতি তিনি হাজির।
বেশ কিছুক্ষন কথা হলো টিপু নামক লোকটির সাথে। তিনি আকতারকে ১০ হাজার টাকা দিলেন। বললেন, ছোট্ট এই নিউজটি তাকে ব্যাথিত করেছে। তিনি চান আকতার সুস্থ্য হয়ে উঠুক। বেশ কিছুক্ষন কথা বলার পর লোকটির মহত্বের আরো পরিচয় পেলাম।
জানলাম লোকটি সুযোগ পেলেই মানুষকে সহায়তার চেষ্টা করেন। হাসতে হাসতে বললেন তিনি খুব ভালো আছেন। ঈদ উপলক্ষ্যে তিনি গ্রামের লোকেদের সাহায্যের জন্য এক লাখ ১০ হাজার টাকা তোলেন ব্যবসা থেকে এবং তাঁর ভাষ্যমতে পরদিনই তাঁর ব্যবসায় আরো এক লাখ টাকা লাভ হয়। তাঁর এবং তাঁর পরিবারের সবার দানশীল মনোভবের কথা শুনে খুব ভালো লাগলো।
সেদিনই এর মাঝে আরো কিছু ফোন পেলাম। সন্ধ্যায় আহছানিয়া মিশন থেকে ফোন করে তারা জানাল, আকতারের চিকিৎসার ব্যবস্থা তারা করবে। মনটা আনন্দে ভরে গেল। রাতে আরেক সরকারি কর্মকর্তা ফোন করলেন। জানালেন তিনিও আকতারকে সাহায্য করতে চান। তিনিও আকতারকে কিছু টাকা দিয়ে গেলেন। ইতিমধ্যে প্রধানমমন্ত্রী শেখ হাসিনা আকতারের চিকিৎসায় এক লাখ টাকা দিলেন।
এবং অষ্ট্রেলিয়া: আহছানিয়া মিশনে কিছুদিন চিকিৎসা চলে আকতারের। এর কিছূদিন পর অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী এক লোক এলেন আমার প্রথম আলোর অফিসে। জানালেন তিনি আকতারকে অস্ট্রেলিয়া নিয়ে চিকিৎসা করাতে চান। আমি তাকে শোভন ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলাম। অত:পর পাসপোর্ট, ভিসা নানান জটিলতা। আমি অনেকদিন কোন খোঁজ নিতে পারি নাই। বলতে গেলা নেওয়া হয়ে উঠতো না। তবে শোভন ভাই মাঝে মাঝে ফোন করে জানাতেন আজ ভিসা হচ্ছে, কাল টিকেট ইত্যাদি। আকতার যেদিন চিকিৎসার জন্য অস্ট্রেলিয়া গেলো সেদিনও ফোন করেছিলেন তিনি। এরপর আমি জাপানে। অনেকদিন যোগযোগ নেই শোভন ভাইয়ের সাথেও। দেশে ফেরার পরও যোগযোগ হয়নি।
সর্বশেষ: আজ ২০ নভেম্বর, ২০১০। সকালে ফোন এলো শোভন ভাইয়ের। ঘূমের ঘোরে জানলাম সুস্থ্য হয়ে আকতার অস্ট্রেলিয়া থেকে দেশে ফিরছে। ভালো লাগলো। তবে সারাদিনের ব্যাস্তাতায় আবার ভূলে গেছিলাম খবরটা। রাতে ফেইসবুকে বারি ভাইয়ের স্ট্যাটাস দেখে আবার মনে পড়লো আকতারের খবরট। মনে হতেই আনন্দে ভরে গেলো মনটা। মনে হলো এমন ভালো একটি খবর স্মৃতি করে রাখতে ব্লগে লিখি।
একটা ছোট্ট নিউজ বদলে দিয়েছে আকতারের জীবন। শোভন ভাইয়ের অশেষ পরিশ্রম, অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী লোকটির চেষ্টা, মহত্ব, আরো অনেকের চেষ্টা আমায় আনন্দিত করেছে। অকে বেশি আনন্দিত। ভালো লাগছে। আমি হয়তো কিছূই করি নাই। সাংবাদিক হিসেবে একটি ছোট্ট নিউজ। সেই ছোট্ট নিউজটাই বদলে দিলো এক কিশোরের, এক পরিবারের জীবন। আমি জানি চারপাশের খারাপের ভীড়ে এখনো অনেক ভালো মানুষ আছে। তাই তো বারবার জয় হয় মানবতার। বাঁচতে ইচ্ছে হয় বারবার। সাংবাদিক হিসেবে নিজেকে অনেক স্বার্থক মনে হয়।