শরিফুল হাসান
বাংলাদেশের কোন কোন উপজেলা আছে যার নাম শুনলেই আপন মনে হয়! দুটি পাতা একটি কুঁড়ির শ্রীমঙ্গল তেমনি একটা উপজেলা। এখানকার পাহাড়, অরণ্য, হাওর আর সবুজ চা বাগান ঘেরা নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখে মুগ্ধ না হয়ে উপায় নেই। অসম্ভব সুন্দর এলাকা। ঠিক কতোবার এসেছি এখানে মনে রাখাও কঠিন। আমার এক বন্ধু এখানকার চা বাগানের ম্যানেজার ছিলো। তাই দলবেঁধে ছোট বেলার বন্ধুরা এসে হুল্লোড় করতাম। এক বড় ভাই এখনো চা বাগানের ম্যানেজার। কোন এক শীতের রাতে হঠাৎ ঝটিকা সফরে তাঁর আতিথেয়তা ভোলার নয়। অবশ্য গত কয়েকছরে বেশিরভাগ সময়েই মিটিংয়ের ভেনু হিসেবে এখানে যোগ দিতে আসা। এরপর মিটিং শেষে ঢাকায় ফেরা।
বাংলাদেশের সবথেকে শীতল ও বৃষ্টিপাতপ্রবণ এলাকা হিসেবে পরিচিত শ্রীমঙ্গল ঢাকা থেকে প্রায় শ দুয়েক কিলোমিটার দূরে ভারত সীমান্তের কাছাকাছি সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজার জেলায় একটি উপজেলা ।
ঢাকা থেকে সেই ভোরে ক্লান্তিকর ভ্রমণ, এরপর সারাদিনের মিটিং সবমিলিয়ে মাথাব্যথা করছে। মাথা ব্যাথা কমাতে লেখালিখি ভালো কাজ করে আমার। সে কারণেই শ্রীমঙ্গল নিয়ে লেখা। কিন্তু নামটা শ্রীমঙ্গল কেন?
ইন্টারনেট ঘেঁটে জানলাম, ‘শ্রীদাস’ ও ‘মঙ্গলদাস’ নামে দু’জন প্রথমে এসে এখানে হাইল-হাওরের তীরে বসতি স্থাপন করেছিলেন। এ দুই ভাইয়ের নামানুসারে শ্রীমঙ্গল নামকরণ। কেউ কেউ অবশ্য বলেন, শ্রীমঙ্গল শহরের অদূরে ‘মঙ্গলচন্ডী’ দেবতার একটি স্থলী ছিল। তার নামানুসারে ‘শ্রীমঙ্গল’ নামকরণ। এখানে অনেক বেশি বৃষ্টিপাত হয়।
এখানে চা-বাগান, পাহাড়, রেইন ফরেস্ট, হাওর কী নেই! একদিকে আনারস, রাবার, লেবু, চা বাগান, চা গবেষণা কেন্দ্র, চা প্রক্রিয়াজাত কেন্দ্র, লাউয়াছড়া রেইনফরেস্ট, আরেকদিকে হাইল হাওর, বাইক্কা বিল, প্রাকৃতিক গ্যাসক্ষেত্র কী নেই! হাইল-হাওরে তো শীতে আসে ঝাঁকে ঝাঁকে অতিথি পাখি। এখানকার বিস্তীর্ণ পাহাড়ি অঞ্চলে খাসিয়া, মণিপুরী, ত্রিপুরা ও গারোদের জীবনাচার, সংস্কৃতিও আপনাকে মুগ্ধ করবে।
বাংলাদেশের চা বাগানের ইতিহাসের সঙ্গে শ্রীমঙ্গল জড়িত। ১৮৫৪ সালে সিলেট শহরের মালনিছড়ায় প্রথম চা-বাগান শুরু হলেও মূলত শ্রীমঙ্গলে এর বিস্তার। চা-পরিবহনের জন্য এই অঞ্চলে রেল লাইন স্থাপিত হয়। বর্তমানে শ্রীমঙ্গলে ৪০ টির বেশি চা-বাগান আছে। বাংলাদেশের চায়ের একটা বড় অংশই আসে এখান থেকে।
আপনারা অনেকেই জানেন, ১৯৫৭-৫৮ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চা বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন। আর সেই সুবাদে তিনি এসেছিলেন শ্রীমঙ্গলের নন্দবানী চা বাগানে। শ্রীমঙ্গলের চা জাদুঘরে বঙ্গবন্ধুর ব্যবহৃত চেয়ার-টেবিলও আছে।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পর মুক্তিযুদ্ধে শ্রীমঙ্গল দারুণ প্রতিরোধ গড়েছিল। এ কারণে ১৯৭১ সালের ৩০ এপ্রিলের পর থেকে পাকিস্তান হানাদারবাহিনী ৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত শ্রীমঙ্গলে হত্যা করেছিল অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে। শ্রীমঙ্গলের ফিনলে টি কোম্পানির ভাড়াউড়া চা বাগান এলাকায় বধ্যভূমিতে ৪৭ জন চা-শ্রমিককে একসঙ্গে দাঁড় করিয়ে গুলি ছুঁড়ে হত্যা করেছিল হানাদার বাহিনী।
প্রকৃতির দিক থেকে খুব সুন্দর হলেও শ্রীমঙ্গলের ভু-খন্ডের অর্ধেকই যেহেতু চা বাগান এবং অন্যদিকে হাওর তাই এখানকার জনগোষ্ঠী বরাবরই ছিল অবহেলিত। শিক্ষা, যোগযোগ সব দিক থেকে বঞ্চিত ছিলো। আস্তে আস্তে সেই অবস্থার উন্নতি হচ্ছে। আমি মনে করি প্রকৃতি ঠিক রেখে শ্রীমঙ্গলকে বাংলাদেশের সেরা পর্যটন এলাকা হিসেবে গড়ে তোলা যায়।
আসলে আমার ভীষণ ভালো লাগার জায়গা শ্রীমঙ্গল। এতো কম সময় নিয়ে এতোসব মিটিংয়ে আসি যে শেষ করে কোথাও যাওয়া হয় না। তবে শ্রীমঙ্গলের জন্য আমার ভালোবাসা থাকবে সবসবময়। আপনারা সময় সুযোগ পেলে বেড়িয়ে যাবেন এখানে। সুযোগ পেলেই বেড়াবেন সারাদেশে। আমি মোটামুটি দেশের এই প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত বেড়িয়ছি এবং দেখেছি এই দেশটা কত সুন্দর! ভালোবাসা শ্রীমঙ্গল! ভালোবাসি বাংলাদেশ।