সুবিধা নেই, তবু পৌরসভা সোনারগাঁ
শরিফুল হাসান
অধিকাংশ জায়গায় কৃষি কিংবা অনাবাদি জমি। কোথাও পানি সরবরাহ ও পয়োনিষ্কাশনের ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। এ কারণে বর্ষায় বা বৃষ্টি হলেই দেখা দেয় জলাবদ্ধতা। রাস্তাগুলো সরু, বেহাল। নেই পৌরসভার অনেক সুবিধাই।
এমন একটি পৌরসভা নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ। ২০০১ সালের ২৫ এপ্রিল আমিনপুর ইউনিয়নকে সোনারগাঁ পৌরসভা ঘোষণা করা হয়। ২০১০ সালের ১ ডিসেম্বর ‘গ’ থেকে এটিকে ‘খ’ শ্রেণির পৌরসভা করা হয়। গত দুদিন সরেজমিন ঘুরে ও স্থানীয় মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, পৌরসভা হলেও পৌর সুবিধাগুলো এখানে মেলে না।
এবার সোনারগাঁ পৌরসভায় আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন নারায়ণগঞ্জ-২ আসনের সাংসদ নজরুল ইসলামের বোনজামাই ফজলে রাব্বী। আর বিএনপির মনোনয়ন পেয়েছেন উপজেলা যুবদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোশাররফ হোসেন।
সোনারগাঁ পৌর এলাকার বাসিন্দা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক হাফিজউল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, সোনারগাঁয় আছে পানাম নগরের মতো ঐতিহ্যবাহী স্থান, লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন। যথাযথ উদ্যোগ নিতে পারলে এগুলোকে কেন্দ্র করেই এটি আধুনিক পৌরসভা হিসেবে গড়ে উঠতে পারত। কিন্তু সেই উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এ জন্য মানুষের দুর্দশার শেষ নেই।
তবে পৌরসভার এসব সমস্যার জন্য অর্থসংকটকে দায়ী করলেন সোনারগাঁ পৌরসভার সচিব শামসুল আলম। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, পৌরসভার আয় মাত্র ২২ থেকে ২৫ লাখ টাকা। এই অর্থ দিয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতনও হয় না। এ কারণে নাগরিক সুবিধাগুলো দেওয়া কষ্ট। তিনি বলেন, পর্যটন বিবেচনায় আরও আগেই ঐতিহ্যবাহী এই এলাকাকে পৌরসভা করা উচিত ছিল। যাই হোক, পৌরসভার একটি মহাপরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। পানি ও পয়োনিষ্কাশনের একটি প্রকল্প নিয়ে জাইকার সঙ্গে কথা চলছে। রাস্তাগুলো ঠিক করার কাজও শুরু হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সোনারগাঁ পৌরসভার মোট ভোটার ২২ হাজার ৪৪২ জন। জনসংখ্যা ৬০ হাজারের বেশি। পৌরসভায় কোনো সরকারি কলেজ নেই। একটিমাত্র বেসরকারি কলেজ, দুটি হাইস্কুল, ১০টি মাদ্রাসা ও ছয়টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে। ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নেই বলে লোকজন ঢাকায় চলে যায়। স্বাস্থ্যসেবাও বেহাল।
রাজধানীর গুলিস্তান থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ধরে ২৪ কিলোমিটার এলে মোগরাপাড়া চৌরাস্তা। ওই চৌরাস্তায় নেমে বাঁয়ের রাস্তা ধরে আধা কিলোমিটার গেলেই চিলারবাগ থেকে শুরু হয়েছে সোনারগাঁ পৌরসভা। ওই রাস্তা বেহাল। রাস্তায় বড় বড় গর্ত, মানুষের চলাচল করাই দায়। অথচ সোনারগাঁ পৌরসভা ও উপজেলার বেশির ভাগ মানুষকে এই সড়ক দিয়েই চলতে হয়। সোনারগাঁয়ের ২৪টি সরকারি দপ্তরসহ থানা, হাসপাতাল এবং সরকারি কাজে আসতে হলে এই সড়কের বিকল্প নেই।
পৌরসভার বাসিন্দা ও চিকিৎসক গাজি জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ‘এখানকার রাস্তাগুলো এত বেহাল, যেকোনো অসুস্থ মানুষ বা গর্ভবতী নারীর চলাফেরা করা ভয়াবহ কষ্টের। বিভিন্ন জায়গায় এত বেশি গর্ত যে বৃষ্টির সময় এগুলো পানিতে তলিয়ে থাকায় যানবাহন উল্টে প্রায়ই ছোটখাটো দুর্ঘটনা ঘটে।
চিলারবাগ পড়েছে পৌরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডে। এর কাছেই খাসনগর দীঘিরপাড় এলাকার রাস্তাগুলো জরাজীর্ণ। এখানকার একটি বড় সমস্যা মাদক।
সোনারগাঁ পৌরভবন থেকে উত্তর-পশ্চিমে কয়েক শ গজ সামনে গেলে চোখে পড়বে দিগন্তবিস্তৃত ফসলি জমি। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, এই পৌরসভার অধিকাংশই কৃষিজমি কিংবা অনাবাদি জমি।
পৌরভবনের পশ্চিমে ১ নম্বর ওয়ার্ডে পড়েছে আদমপুর, পাটালপাড়া, অজুন্দি ও দরপত। এই ওয়ার্ডের রাস্তাগুলো মোটামুটি চলাচলযোগ্য হলেও সড়কবাতি নেই। চোখে পড়ল না পয়োনিষ্কাশন লাইন। পৌর ভবনের পশ্চিমেই গোয়ালদী, হরিশপুর। বর্তমান পৌর মেয়র সাদেকুর রহমানের বাড়ি এ এলাকায়। স্থানীয় লোকজন জানান, আগে এই এলাকার অবস্থা খারাপ থাকলেও এখন উন্নয়নকাজ চলছে।
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশেই পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ড। এখানকার টিপরদী, মল্লিকেরপাড়া ও তাজপুর সোনারগাঁয়ে মাদকের প্রধান আখড়া হিসেবে পরিচিত। এ এলাকায়ও প্রচুর কৃষিজমি। তবে রাস্তাগুলোর উন্নয়নকাজ চলছে।
৫ নম্বর ওয়ার্ডে পড়েছে পানামনগর। তারপরও এ এলাকার কোনো উন্নয়ন নেই। নেই পর্যটকদের কোনো সুযোগ-সুবিধা। এমনকি পুরোনো ভবনগুলো দেখতে এসে অনেকেই ছিনতাইয়ের শিকার হয়েছেন।
পানামনগর এবং বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনের পেছনে ৬ নম্বর ওয়ার্ডের খাগুটিয়া, দিয়াপাড়া, শ্রীরামপুর, বাগমুছা। এর মধ্যে বাগমুছায় ঋষি সম্প্রদায়ের কয়েক হাজার মানুষের বসবাস। তাঁরা চামড়া প্রক্রিয়াজাত করেন। ফলে এ এলাকায় দুর্গন্ধে হাঁটাচলা দায়।
সোনারগাঁ থানার পেছনেই ৮ নম্বর ওয়ার্ডের ভবনাথপুর, দত্তপাড়া ও হাতকোপা। সরকারি সব দপ্তর এ এলাকায়। অথচ পানিনিষ্কাশনের কোনো ব্যবস্থা না থাকায় বর্ষাকালে এ এলাকার বাসিন্দাদের জলাবদ্ধতায় দুর্ভোগ পোহাতে হয়।
এ এলাকার বাসিন্দা ব্যবসায়ী মাহমুদ হাসান বলেন, ‘পৌরসভা হওয়ার পর ভেবেছিলাম জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি পাব। কিন্তু দিনকে দিন সমস্যা বাড়ছে। এমন পৌরসভার বাসিন্দা হয়ে লাভ কী?’
৯ নম্বর ওয়ার্ডের ভট্টপুর, বাণীনাথপুর, বাড়ি রঘুবাঙ্গা, সাহাপুরে উন্নয়নের কোনো ছোঁয়া পড়েনি।
সব সমস্যার সমাধানের আর আধুনিক পৌরসভা গড়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ২০১০ সালে নির্বাচিত হয়েছিলেন বর্তমান মেয়র সাদেকুর রহমান। গত পাঁচ বছরে কতটা প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন হয়েছে জানতে চাইলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি মেয়র হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে সমস্যাগুলো সমাধান করার চেষ্টা করেছি। ২০ কোটি টাকার উন্নয়নকাজ চলছে। এগুলো শেষ হলে পৌরবাসী অনেক সুবিধা পাবে।’