দেশে আড়াই লাখ এনজিও!

Spread the love

শরিফুল হাসান


বাংলাদেশকে বলা হয় বেসরকারি সংস্থাগুলোর (এনজিও) মডেল। ১৯৭১ সালে যুদ্ধ-পরবর্তী বিপর্যস্ত অর্থনৈতিক পরিস্থিতি মোকাবিলায় বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও বিদেশি সংস্থা ত্রাণ-পুনর্বাসন ও চিকিত্সা-স্বাস্থ্যসেবাসহ নানা ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে। এরপর থেকে দেশে অসংখ্য এনজিও হয়েছে। এনজিওর নামেও নিবন্ধন পেয়েছে অসংখ্য সংগঠন।কিন্তু সত্যিকারভাবে দেশে এনজিওর মোট সংখ্যা কত? সরকারের একটি হিসাব অনুযায়ী এ সংখ্যা আড়াই লাখ। এর মধ্যে সমাজসেবা অধিদপ্তরের অধীনে ৫৬ হাজার, সমবায় অধিদপ্তরের অধীনে দেড় লাখ, মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের অধীনে ১৬ হাজার এবং এনজিও ব্যুরোতে আড়াই হাজার এনজিও দেখানো হয়েছে। আড়াই লাখের মধ্যে ৫৫ হাজার এনজিও নিষ্ক্রিয় এবং ৪৮ হাজার ৮০৩টিকে সক্রিয় বলা হয়েছে।তবে এনজিওগুলোর সংগঠনগুলো সরকারের এ দাবিকে অযৌক্তিক ও হাস্যকর মনে করে। ফেডারেশন অব এনজিওস ইন বাংলাদেশের (এফএনবি) পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ ইব্রাহীম প্রথম আলোকে বলেন, সরকার ঢালাওভাবে বেসরকারি সংস্থাগুলোকে এনজিও বলছে। এমনকি পাড়ার ক্লাবও সরকারি পরিসংখ্যানে এনজিওর মধ্যে রয়েছে। কিন্তু দেশে এনজিওর সংখ্যা কোনো-ভাবেই সাড়ে তিন হাজারের বেশি হবে না।সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তি: এফএনবির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সরকারি হিসাব-নিকাশসহ সভা-সেমিনারে প্রায়ই বলা হয়, দেশে লাখ লাখ এনজিও আছে। বিষয়টি নিয়ে সবার মধ্যে বিভ্রান্তি রয়েছে। এ ছাড়া সম্প্রতি সমাজকল্যাণমন্ত্রীর সভাপতিত্বে বেসরকারি সংস্থাগুলোর প্রতিনিধিসহ সবাইকে নিয়ে একটি বৈঠক হয়। ওই বৈঠকে সরকারিভাবে দেশে এনজিওর সংখ্যা আড়াই লাখ বলা হয়। এ সময় এফএনবির পক্ষ থেকে সরকারকে এনজিওর প্রকৃত সংখ্যা ও তালিকা তৈরি করার পরামর্শ দেওয়া হয়।এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সমাজকল্যাণমন্ত্রী এনামুল হক মোস্তফা শহীদ প্রথম আলোকে বলেন, সমাজসেবা অধিদপ্তর, মহিলা অধিদপ্তর, সমবায় অধিদপ্তরসহ এখন বিভিন্ন জায়গা থেকে এনজিওর নিবন্ধন দেওয়া হচ্ছে। অনেক ক্লাব-পাঠাগারও এ তালিকায় রয়ে গেছে। এ তালিকার অর্ধেকেরও বেশি এনজিও নিষ্ক্রিয় আছে। এগুলো যাচাই-বাছাই চলছে। এটি শেষ হলে বলা যাবে, এনজিওর সংখ্যা কত।সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এবং উন্নয়ন সংস্থাগুলোর সংগঠন এডাবের (অ্যাসোসিয়েশন অব ডেভেলপমেন্ট এজেন্সিস ইন বাংলাদেশ) সাবেক নির্বাহী প্রধান রাশেদা কে চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ক্লাব, সমিতি সবকিছুকে ঢালাওভাবে এনজিও বলে দেওয়া ঠিক নয়। বিষয়টি নিয়ে সংখ্যা ও ধারণাগত দুই ধরনের বিভ্রান্তি আছে। কিন্তু সত্যিকারের উন্নয়নমূলক কাজ করছে এমন এনজিওর সংখ্যা কোনোভাবেই আড়াই থেকে তিন হাজারের বেশি হবে না। তিনি সঠিক এনজিওগুলো চিহ্নিত করার দাবি জানান।এফএনবির পরিচালক তাজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, নানা উদ্দেশ্য নিয়ে প্রতিষ্ঠিত বহু রকমের প্রতিষ্ঠান এখন এনজিও নাম দিয়ে একটি বিশাল সংখ্যার সৃষ্টি করেছে। একই এনজিওকে বিভিন্ন জায়গায় ছাড়পত্র নিতে হয় বলে অনেক সময় সরকারিভাবে একই প্রতিষ্ঠানকে বারবার গোনা হয়। ফলে তাদের সংখ্যাও তাই বেড়ে যায়। এ ছাড়া ক্লাব ও পাঠাগার এখন এনজিওর তালিকায় রয়েছে। কিন্তু এনজিও বলতে বোঝায়, যেসব বেসরকারি সংস্থা কোনো লাভ না করে দারিদ্র্য বিমোচন, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পরিবেশ সংরক্ষণ ইত্যাদি, এক কথায় বলতে গেলে সামাজিক উন্নয়নের জন্য কাজ করছে। এ বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী সারা দেশে এনজিওর সংখ্যা সাড়ে তিন থেকে চার হাজারের বেশি হবে না।ভিন্ন আইন, ভিন্ন তদারকি প্রতিষ্ঠান: বাংলাদেশে কার্যরত বেসরকারি সংস্থাগুলো সমাজসেবা অধিদপ্তর, মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর, সমবায় অধিদপ্তর, রেজিস্ট্রার জয়েন্ট স্টক কোম্পানি, এনজিও ব্যুরো ও মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটির (ক্ষুদ্র ঋণ নিয়ন্ত্রণ সংস্থা) মাধ্যমে চলে।এর মধ্যে সমাজসেবা অধিদপ্তরের অধীন এনজিওগুলো স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাসমূহ (নিবন্ধন ও নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাদেশ ১৯৬১ আইনে নিবন্ধিত। সমাজসেবা অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, এই আইনে অধিদপ্তরের নিবন্ধিত এনজিওর সংখ্যা ৫৫ হাজার ৯৪৫টি। এর মধ্যে ৩২ হাজার ৯৪৫টি সক্রিয় এবং ২৩ হাজার ৪৪৫টি নিষ্ক্রিয়।মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের অধীন এনজিওগুলো স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাসমূহ (নিবন্ধন ও নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাদেশ ১৯৬১ আইনে চলে। এর অধীন নিবন্ধিত এনজিওর সংখ্যা ১৫ হাজার ৩৯৮টি।সমবায় অধিদপ্তরের অধীন এনজিওগুলো দি কো-অপারেটিভ সোসাইটিজ অ্যাক্ট ২০০১ আইনে চলে। এই আইনের অধীন নিবন্ধিত এনজিওর সংখ্যা এক লাখ ৬২ হাজার ১১২টি। এর মধ্যে মাত্র ১৩ হাজার ২০০টি সক্রিয়। অধিদপ্তর নিষ্ক্রিয় হিসেবে ৩০ হাজার এনজিওর তালিকা করেছে।যৌথ মূলধনী কোম্পানি ও ফার্মসমূহের নিবন্ধন অধিদপ্তরের অধীন এনজিওগুলো দি সোসাইটিজ রেজিস্ট্রেশন অ্যাক্ট ১৮৬০ অনুযায়ী চলে। এর অধীন এনজিওর সংখ্যা নয় হাজার ৭১০টি।ব্যুরোর অধীন এনজিওগুলো দি ফরেন ডোনেশন (ভলান্টারি অ্যাক্টিভিটিজ) অর্ডিনেন্স ১৯৭৮ ও দি ফরেন কনট্রিবিউশন (রেগুলেশনস) অর্ডিনেন্স ১৯৮২ আইনের অধীনে চলে। এর আওতায় এনজিওর সংখ্যা প্রায় আড়াই হাজার। এর মধ্যে ৫৫টির নিবন্ধন বাতিল করা হয়েছে।ক্ষুদ্রঋণ নিয়ন্ত্রণ সংস্থার অধীন এনজিওগুলো মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি আইন ২০০৬ অনুযায়ী চলে। এর অধীন এনজিওর সংখ্যা এক হাজার ৩৮০টি। এর মধ্যে ৩৭৩টি সক্রিয় এবং এক হাজার সাতটি নিষ্ক্রিয়।এনজিওগুলো চিহ্নিত করা জরুরি: এফএনবি ও এডাবের কর্মকর্তারা বলেছেন, এনজিওগুলো নিয়ে কিছু ভাবতে হলে এবং এগুলো নিয়ে কোনো কাজ করতে হলে সবার আগে কারা এনজিও তা নির্ধারণ করা জরুরি। এ কারণেই শুধু এনজিওগুলোর একটি আলাদা তালিকা করা দরকার।এফএনবির পরিচালক তাজুল ইসলাম বলেন, এনজিও শব্দটির পরিচিতি আরও স্বচ্ছ করা দরকার। যেসব এনজিও দারিদ্র্য বিমোচন, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, ক্ষুদ্রঋণ, পরিবেশ, নারীর ক্ষমতায়নসহ সামাজিক উন্নয়নে ভূমিকা রেখে চলেছে সেগুলোকেই এনজিও বলতে হবে। অন্যদের আলাদা নামকরণ বা পরিচিতির ব্যবস্থা রাখা প্রয়োজন। এ ছাড়া সমবায় সমিতিগুলো কোনোভাবেই এনজিও নয়।প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা, সামাজিক উন্নয়ন ও রাজনৈতিক উপদেষ্টা আলাউদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ঢালাওভাবে সবাইকে এনজিও বলা ঠিক নয়। কারণ, সামাজিক উন্নয়নসহ সুনির্দিষ্ট কিছু বিষয়ে যারা কাজ করছে, তাদেরই কেবল এনজিও বলা যায়। এ হিসাবে এনজিওর সংখ্যা আড়াই হাজারের বেশি হওয়ার কথা নয়। তবে সত্যিকারভাবে কারা এনজিও এবং কারা এনজিও নয়, সেটি ঠিক করা দরকার।দরকার সমন্বিত আইন বা কমিশন: বাংলাদেশে কর্মরত বেসরকারি সংস্থাগুলো সমাজসেবা অধিদপ্তর, মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর, সমবায় অধিদপ্তর, রেজিস্ট্রার জয়েন্ট স্টক কোম্পানি, এনজিও ব্যুরো ও মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটির মাধ্যমে চলে। এ প্রতিষ্ঠানগুলো আবার নিজস্ব আইনে এনজিওগুলোকে নিবন্ধন বা ছাড়পত্র দেয়। কিন্তু অনেকগুলো দপ্তরে মাঠপর্যায়ের কোনো তদারকি অফিস বা কর্মকর্তা-কমচারী নেই। বিভিন্ন সংস্থা এনজিও বিষয় নিয়ে কাজ করায় পরস্পরের মধ্যে সমন্বয় নেই।সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, এ সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য এ মন্ত্রণালয় এনজিওগুলোর নিবন্ধনের জন্য একটি সমন্বিত আইন করার উদ্যোগ নিয়েছে। এ ছাড়া মন্ত্রণালয় সোশ্যাল সিকিউরিটি কাউন্সিল (সামাজিক নিরাপত্তা কাউন্সিল) গঠনেরও উদ্যোগ নিয়েছে। এ ব্যাপারে দাতা সংস্থা, এনজিও প্রতিনিধি, আইন বিশেষজ্ঞসহ সবাইকে নিয়ে সমাজকল্যাণমন্ত্রীর সভাপতিত্বে গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে একটি বৈঠকও হয়। বৈঠকে সবাই এ ব্যাপারে মতামত দেবেন বলে সিদ্ধান্ত হয়। তবে এনজিওগুলো বলছে, সমন্বিত আইনের চেয়েও জরুরি বিষয় হলো একটি সমন্বয়কারী সংস্থা প্রতিষ্ঠা।এফএনবির পরিচালক তাজুল ইসলাম বলেন, একীভূত নিবন্ধনকারী বা তদারকি সংস্থার বদলে দরকার একটি এনজিও কমিশন বা এ রকম একটি সমন্বয়কারী সংস্থা। এ কমিশন বিভিন্ন নিবন্ধন কর্তৃপক্ষের অনুমোদিত এনজিওগুলোর তালিকা ও তথ্য সংগ্রহ করে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করতে পারে।সমাজকল্যাণমন্ত্রী এনামুল হক মোস্তফা শহীদ বলেন, এনজিগুলোর জন্য একটি সমন্বিত আইন করার কাজ চলছে। এর পক্ষে-বিপক্ষে মত নেওয়া হচ্ছে। সমন্বিত এই আইন করতে পারলে কোন উত্স থেকে এনজিওগুলোর টাকা আসছে এবং কীভাবে তা ব্যয় হচ্ছে সব তথ্যই সহজে জানা যাবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published.