ডাচ-বাংলা ব্যাংকের সেবা !

Spread the love

শরিফুল হাসান

সেবা জিনিষটা পাওয়া বাংলাদেশে বেশ কঠিন বিষয়, হোক সেটা সরকারি দপ্তর কিংবা বেসরকারি ব্যাংক। আজ একটু ডাচ-বাংলা ব্যাংকের সেবা নিয়ে কথা বলি। নিজের একাউন্টের একটা মোবাইল নম্বর চেঞ্জ করতে তারা ঠিক কতোদিন নেয় শুনুন।

ডাচ বাংলায় আমার একটা একাউন্ট আছে। ১৬ বছর আগের একাউন্ট। আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগে মাস্টার্স করছি। নরওয়ের একটা স্কলারশীপ এবং মাসে গড়ে ২৫-৩০ হাজার টাকা। ওই সময়ের প্রেক্ষিতে ভালো টাকা। স্কলারশিপটা দুই বছরের।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সোনালী ব্যাংকে একটা একাউন্ট থাকলেও রেজিস্ট্রার ভবনে গিয়ে লাইন ধরা, এটিএম কার্ড না থাকাসহ নানা কারণে সে সময়ে ডাচ বাংলায় একটা অ্যাকাউন্ট করি। কারণ সব জায়গায় এটিএম বুথ আছে।

আমি যেহেতু প্রথম আলোয় তখন এবং আমার অফিস কারওয়ানবাজারে এবং রোজ সেখানেই যাই কাজেই কারওয়ানবাজারেই একাউন্ট করলাম। গত ১৬ বছর ধরেই সেই একাউন্টটি কম বেশি ব্যবহার করছি। কিন্তু বিপত্তি বাঁধিয়েছে মোবাইল নম্বর।

২০০৬-০৭ সালে আমার একটা টেলিটক মোবাইল ছিলো। একাউন্ট করার সময় ওই নম্বরটি দিলেও পরেবর্তীতে আমার মোবাইল নম্বরটি পরিবর্তন করি। আমি সাধারণত ব্যাংকে খুব কম যাই। এটিএম কার্ডেই টাকা তুলি। আমার স্যালারি হয় যে ব্যাংকে সেই ব্যাংকের নিজস্ব অ্যাপ আছে। টাকা পাঠানো থেকে শুরু করে নানা কাজ আমি সেই এপেই করতে পারি। কোভিডের সময় আমি এই ধরনের এপে অভ্যস্ত হওয়ায় ডাচ বাংলার ক্ষেত্রেও এই ধরনের অ্যাপ ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নেই। বিপত্তির শুরু সেখান থেকেই।

ডাচ বাংলা ব্যাংকের নেক্সাস পে নামে একটা এপ আছে। সেই এপ চালু করতে হলে মোবাইল নম্বর লাগবে। ডাচ বাংলার কাস্টময়ার কেয়ার ফোন দিয়ে জানতে পারি, সেই মোবাইল হতে হবে একাউন্ট নম্বরের মোবাইল। আমি জানাই আমি তো এখন নম্বর বদলেছি। আপনি কী আমার নম্বরটা আপডেট করে দিতে পারবেন? তারা জানায় না এটা কাস্টমার কেয়ার থেকে করা যাবে না। এটা করতে হলে আমাকে যে কোন শাখায় যেতে হবে।

আমি পাঁচ বছর আগেই প্রথম আলো আর কারওয়ান বাজার ছেড়েছি। কাজেই ঘারের কাছের মহাখালীর ব্রাঞ্চে গিয়ে টোকেন নিয়ে একদিন দুপুরে যাই। তারপর শুনি যিনি এই সেবা দেবেন তিনি লাঞ্চে গেছেন। প্রায় ঘন্টাখানেক অপেক্ষা করে ঠিক করি আরেকদিন যাবো। সেদিন অনেকক্ষণ অপেক্ষার পর আমি টোকেন সিরিয়াল এলে জানতে পারলাম নতুন তথ্য। মহাখালী শাখায় হবে না আমার যে শাখায় একাউন্ট সেই কারওয়ান বাজারে যেতে হবে।

আমি তাদের কাছে জানতে চাইলাম, এখন তো সব অনলাইনে। আপনি আমার ছবি দেখেন, সাইন নেন, অনলাইনে করে ফেলেন। তাদের কথা না কারওয়ান বাজারেই যেতে হবে। কিন্তু কারওয়ানবাজারে গিয়ে দেখি তাদের ঠিকানা বদলে গেছে।

ঢাকায় কোথাও যাওয়া মানেই যানজট। বসুন্ধরা মার্কেট মঙ্গলবার বন্ধ থাকে। কাজেই ওইদিন কারওয়াবাজার এলাকায় যানজট কম থাকে। কাজেই তাড়াতাড়ি পৌঁছে গেলাম। কিন্তু আমার পুরোনো সেই ঠিকানায় গিয়ে দেখি সেখানে আর ডাচ বাংলা ব্যাংকের শাখা নেই। একে ওকে জিজ্ঞাসা করে জানলাম, ঠিকানা বদলেছে এখান বিটিএমসি ভবনে গেছে।

অতপর গুগল দেখে সেই ব্র্যাঞ্চে গিয়ে টোকেন নিয়ে অনেক্ষণ অপেক্ষা করে সিরিয়িাল নিয়ে এক আপার সামনে গিয়ে পুরো ঘটনা বলে জানালাম আমার মোবাইল নম্বরটি পরিবর্তন করতে হবে। তিনি একটা সাদা কাগেজের আবেদন ফরম দিলেন। আমি এক মিনিটেই পূরণ করে জমা দিলাম। তিনি বললেন, এক সপ্তাহ পর আসুন।

আরো এক সপ্তাহ? আমি বললাম, একটা মোবাইল নম্বর বদলে করতে এক সপ্তাহ? তিনি বললেন, আমাদের অনেক কাজ। অনেক আবেদন। তিনি আমার দিকে ফিরেও তাকালেন না। আবেদনটা একটা বক্সে রেখে বললেন, এক সপ্তাহ তো কমই। আমি বললাম, আচ্ছা এক সপ্তাহ পর আমি জানবো কীভাবে? আর আপনারা তো কিছুই চেক করলেন না। আমাকে কোন রিসিভ কপি দিলেন না। শুধু একটা ফরম ফিল আপের জন্য আমাকে এতোদূর আসতে হলো? এটা তো যে কোন শাখায় হতে পারতো। তিনি বললেন, আপনি আসুন। এক সপ্তাহ পর খোঁজ নেন। এরপর কী হলো শুনতে চান?

এক সপ্তাহ না আজ প্রায় তিন সপ্তাহ হলো। হঠাৎ করে মনে হলো আমার মোবাইল নম্বরটা চেঞ্জ এখনো তো হলো না। গুগল থেকে মোবাইল নম্বর বের করে ডাচ বাংলা ব্যাংকের মোবাইলে ফোন দিলাম। পরিচয় দিয়ে কথা বললাম। তিনি মনোযোগ দিয়ে শুনলেন। জানালেন ব্র্যাঞ্চের ম্যানেজার। সব শুনে খুব সুন্দর করে বললেন, তাদের অনেকেই কোভিডে আক্রান্ত। তিনিও আক্রান্ত। এখন কম জনবল নিয়ে কাজ করছেন। সে কারণেই দেরি হতে আরে।

আমি তার কথায় একমত হয়ে বললাম, কোডিড বলেই আমি আসলে ব্রাঞ্চে যেতে চাইনি, এই কাজগুলো মোবাইলে বা অনলাইনে যাচাই করে তখুনি করে ফেলতে পারেন। তিনি বললেন, ম্যানেজারদের মিটিংয়ে তিনি এই কথাগুলো বলেছেন আগে। ভবিষ্যতে দেখবেন।

আমি জানতে চাইলাম, আমার মোবাইল  নম্বর বদলের জন্য এখন কী করবো? আর আপনার ব্যাংকেই আমার ক্রেডিট কার্ডে আছে। সেখানে কিন্তু আমার নতুন নম্বর দেওয়া। সেই নম্বরটা পুরোনো একাউন্টে আপডেট করতে আমাক আর কতো অপেক্ষা করতে হবে? তিনি আমাকে বললেন, অপারেশন ম্যানেজার বা ডেপুটি একজনের নম্বর দিচ্ছেন। সেই আপাকে যেন ফোন করি। এবার ফোন করলাম তাকে। নতুন অভিজ্ঞতা।

আবারো একই ঘটনা পুনারাবৃত্তি করে আপাকে বলতে হলো। তিনি সব শুনে আমার একাউন্ট নম্বর নিয়ে দেখলেন এখনো আপডেট হয়নি এবং কারণ হিসেবে বললেন, কোভিডসহ নানা কারণে অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। এমনকি তিনি নিজেও মাত্র কোভিড থেকে ফিরলেন। তিনি দেখছেন বিষয়টা এবং আমাকে আজকের মধ্যে জানাবেন বললেন।

ম্যানেজার এবং ডেপুটি ম্যানেজার দুজনেরই আন্তরিকতা ছিল মোটামুটি। এই দুজনের সাথে কথা বলার ঘন্টাখানেক পর আরেকটা ফোন। এবার প্রশ্ন, আপনি কার কাছে আবেদন দিয়েছিলেন? টোকেন নম্বর কতো ছিলো?

আমি বললাম, দেখুন সেদিন মঙ্গলবার ছিলো বলে তারিখটা আমার মনে আছে। ১৮ জানুয়ারি। মঙ্গলবার। আমি এসেছিলাম সকালের দিকে। টোকেন নম্বরটা আমার মনে নেই। একজন আপা ছিলেন মনে আছে কিন্তু তাঁর নাম বা মোবাইল নাম্বার নেইনি। কারণ ব্যাংকের একজন আপার চট করে নাম জিজ্ঞাসা করা যায় না।

এরপর তিনি বললেন, আপনি ব্যাংকে ঢোকার পর ডানে না বামে গিয়েছিলেন? আমি বললাম গেট দিয়ে ঢুকে ডানে গিয়ে ফরম ফিলাপ করে আবার বামে গিয়েছি। আপনারা সিসি ক্যামেরায় বাকিটা দেখে নিন। আমার একাউন্ট নম্বর বললাম। তিনি সব শুনে জানালেন, আমাকে আপডেট জানাবেন।

আমি জানি এই স্ট্যাটাস দেয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে এবং হলোও তাই। এখন স্ট্যাটাস এর আপডেট লিখছি। আমাকে জানানো হয়েছে আমার সমস্যাটি সমাধান হয়ে গেছে। কিন্তু আমি তো নিজের সমস্যা সমাধানের জন্য লিখিনি। আমার মোবাইল নম্বরটি চেঞ্জ করতে তিন সপ্তাহ লাগছে আরো তিন সপ্তাহ লাগতে পারতো, কিন্তু সমস্যাটার স্থায়ী সমাধান দরকার যাতে আরো অনেক মানুষের কষ্ট না হয়। আর সে কারণেই এই লেখা। 

আমি কোথাও কোন সেবা দিতে গেলে নিজের পরিচয় না দিতে চেষ্টা করি। আমি নিজের পরিচয় দিয়ে বা ডাচ বাংলার কোন বন্ধুর সহায়তায় একদিনেই হয়তো এই সেবা পেতাম। যাচাই বাছাই করে কাজটা কয়েক মিনিটের। কিন্তু আমি কোন পরিচয় না দিয়ে স্বাভাবিকভাবেই কাজটা করতে চেয়েছি।‌ এক সপ্তায় হলেও আমি মেনে নিতাম। সেটা হয়নি।

আমি জানিনা এটিএম বুথ থেকেই কেন মোবাইল নাম্বার চেঞ্জ করা যাবে না। আরো কোন সহজ উপায় বের করা হোক যাতে তৎক্ষনাৎ যাচাই-বাছাই করে কিংবা ১-২ দিনের মধ্যে এসব কাজ করা যায়।

আমি চাই আমার স্ট্যাটাসের কমেন্ট সেকশনে গিয়ে ডাচ বাংলার কর্মকর্তারা পড়বেন এবং তারা যেন বুঝতে পারেন সারাদেশে তাদের ব্যাংকিং খাতের সেবার কি অবস্থা। বেশিরভাগ লোকের কথা শুনে আমার মনে হয়েছে, ডাচ বাংলা যেভাবে তাদের শাখা বা উপশাখা বাড়িয়েছে সেই তুলনায় জনবলের তীব্র সংকট রয়েছে। আশা করছি ডাচ-বাংলা কর্তৃপক্ষ জনবল সংকট সহ সেবার দিকে নজর দেবে। ‌

আমি সব ব্যাংক কর্তৃপক্ষসহ বাংলাদেশ ব্যাংককে বলবো, এই যুগে একজন গ্রাহককে যতো কম ব্রাঞ্চে আনা যায় ততোই মঙ্গল। কাজগুলো সব ডিজিটাল হতে পারে। দেখেন একজনের এনআইডি, মোবাইল নম্বর এগুলো যাচাই করা খুব কঠিন কাজ না। আপনি যদি দেখেন কারো এনআইডি, মোবাইল নম্বর, নাম সব ঠিক আছে তাহলে সেই পরিবতর্নগুলো একদিনেই করা উচিত।

আমি মনে করি এই দেশের ব্যাংকিং সেবা আরো ভালো করার সুযোগ আছে। সারা দুনিয়ায় এখন ডিজিটাল ব্যাংকিং চলছে, নিত্য নতুন অ্যাপস আর প্রোডাক্ট হচ্ছে। আশা করছি আমাদের ব্যাংকিং খাতের লোকজন খালি টাকা আনার প্রতিযোগিতা না করে সেবার দিকে আরো নজর দেবেন। সবার চেষ্টায় নিশ্চয়ই এই দেশের ব্যাংকিং খাত আরো ভালো হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published.