কয়েকটি দেশের তিক্ত অভিজ্ঞতা, সরকারের নিরাপত্তার আশ্বাস

Spread the love

সৌদি আরবে নারী গৃহকর্মী পাঠানো নিয়ে উদ্বেগ

শরিফুল হাসান

সৌদি আরবে গৃহকর্মী হিসেবে বাংলাদেশ থেকে নারী কর্মী পাঠানোর ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্ট অনেকে। অভিবাসন-বিষয়ক বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা এবং প্রবাসী বাংলাদেশিরা তাঁদের প্রাপ্ত তথ্য ও অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করে বলেছেন, সৌদি আরবে গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করতে যাওয়া ইন্দোনেশীয়, ফিলিপাইন ও শ্রীলঙ্কার নারীরা শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। কাজেই বাংলাদেশের নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত না করে সে দেশে পাঠানো উচিত হবে না।অভিবাসন-বিষয়ক বেসরকারি সংস্থাগুলো বলেছে, কর্মস্থলে নির্যাতনের কারণে ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন ও শ্রীলঙ্কা যখন তাদের নারীদের সৌদি আরবে পাঠানো বন্ধ করে দিচ্ছে, তখন দেশটি বাংলাদেশ থেকে নারী গৃহকর্মী নিতে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। কিন্তু নিরাপত্তা সম্পর্কে নিশ্চিত না হয়ে বাংলাদেশ সরকারের সেখানে নারী গৃহকর্মী পাঠানো ঠিক হবে না।বাংলাদেশের বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সংগঠন বায়রা অবশ্য বলছে, নারী কর্মীরা যেন কোনো সমস্যায় না পড়েন, সেদিকে খেয়াল রাখা হবে।উদ্বেগ প্রকাশ করে বাংলাদেশ অভিবাসী মহিলা শ্রমিক অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক সুমাইয়া ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘মাসে ১০ হাজার নারী গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করতে যাবে শুনতে খুব ভালো লাগে। কিন্তু লেবাননে বাংলাদেশি নারীরা যে ভয়াবহ পরিস্থিতিতে পড়েছে, আমরা চাই না সৌদি আরবেও তারা সেই সমস্যায় পড়ুক। আমরা চাই নিরাপত্তা নিশ্চিত করে নারীদের সৌদি আরবে পাঠানো হোক।’সমস্যা হলে যোগাযোগের জন্য প্রত্যেক নারী কর্মীকে মুঠোফোন ও প্রয়োজনীয় নম্বর দেওয়ার পরামর্শ দেন সুমাইয়া। এ ছাড়া তাঁর মতে, মাসে অন্তত একবার দূতাবাসের পক্ষ থেকে কর্মীদের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করা যেতে পারে। কিন্তু নিরাপত্তা নিশ্চিত না করে কোনোভাবেই নারী কর্মীদের পাঠানো ঠিক হবে না।সৌদি আরবে বিভিন্ন মেয়াদে বসবাসকারী প্রবাসী বেশ কয়েকজন বাংলাদেশিও দেশটিতে নারী গৃহকর্মীদের প্রতি বিভিন্ন রকম নির্যাতনের কথা উল্লেখ করে এ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন।সৌদি আরবের রিয়াদ থেকে সায়েদুল হাসান, কুমিল্লার ফরহাদ আহমেদ, চট্টগ্রামের বাবুল আহমেদসহ আরও অনেকেই ফোনে প্রথম আলোকে তাঁদের উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন। তাঁরা বলেছেন, লেবাননে কাজ করতে গিয়ে নির্যাতিত হয়ে ফিরেছেন অনেক বাংলাদেশি নারী। কয়েকজনের সেখানে মৃত্যুও হয়েছে। একই ঘটনা ঘটতে পারে সৌদি আরবেও।ফরহাদ আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘সৌদি আরবে নারী গৃহকর্মীদের খাদ্দামা বলে। খাদ্দামাদের কী পরিমাণ দুর্ভোগ পোহাতে হয়, তা এখানকার সবাই জানে। কাজেই আমরা আমাদের মা-বোনদের এভাবে নির্যাতিত হতে দিতে পারি না। বাংলাদেশ সরকারের কোনোভাবেই এখানে নারীদের পাঠানো ঠিক হবে না।’বিদেশে এককভাবে বাংলাদেশের বৃহত্তম শ্রমবাজার সৌদি আরবে আড়াই বছর ধরে জনশক্তি রপ্তানি বন্ধ। তবে গত এপ্রিল মাসে সৌদি ন্যাশনাল রিক্রুটমেন্ট কমিটির (সানারকম) নয় সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল ঢাকায় এসে গৃহকর্মী নেওয়ার ব্যাপারে প্রস্তাব দেয়। বায়রার সঙ্গে এ ব্যাপারে সানারকমের একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। এরপর প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী সংবাদ সম্মেলন করে জানান, বাংলাদেশ থেকে প্রতি মাসে ১০ হাজার গৃহকর্মী নেবে সৌদি আরব।সৌদি আরবের নারী গৃহকর্মীদের অবস্থা নিয়ে গত বছর একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থা ‘হিউম্যান রাইটস ওয়াচ’। ওই প্রতিবেদনে সৌদি আরবে কর্মরত ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন ও শ্রীলঙ্কার দেড় শ গৃহকর্মীর সাক্ষাৎকার ও তাঁদের অবস্থা তুলে ধরা হয়। সাক্ষাৎকারে অধিকাংশ গৃহকর্মী বলেছেন, তাঁরা শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার। বিশেষ করে, যৌন নিপীড়ন একটি বড় সমস্যা।হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদনটি তৈরির সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন সংগঠনটির জ্যেষ্ঠ গবেষক নিশা ভারিয়া। গত মাসে কলম্বো প্রসেস সম্মেলনে যোগ দেওয়ার সময় এ প্রতিবেদক তাঁর কাছে সৌদি আরবে বিদেশি নারী গৃহকর্মীদের পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চান। নিশা ভারিয়া তখন প্রথম আলোকে বলেন, ‘অন্য দেশে গৃহকর্মীদের সাধারণ সমস্যা সাধারণত ঠিক সময়ে বেতন না হওয়া কিংবা ছুটি না পাওয়া। কিন্তু সৌদি আরবে এর বাইরেও নির্যাতন, ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে নিয়মিত। আমরা সেখানে গৃহকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে ভয়াবহ এই চিত্র পেয়েছি।’নিশা ভারিয়া আরও বলেন, যেকোনো দেশের নারীদের জন্যই সৌদি আরবে গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করা কঠিন। বাড়ির গৃহকর্ত্রী যেমন তাঁকে দিনভর পরিশ্রম করান, তেমনি গৃহকর্তা বা তাঁর ছেলে গৃহকর্মীটির জন্য সমস্যা হয়ে উঠতে পারেন। এমন পরিস্থিতিতেও বাংলাদেশ সেখানে নারীদের পাঠাতে চাইলে অবশ্যই নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করা উচিত।ফিলিপাইনের একটি সংসদীয় প্রতিনিধিদল সে দেশের নারী কর্মীদের ওপর নির্যাতনের ঘটনা তদন্তে এ বছর সৌদি আরবে যায়। ফিরে এসে তারা ফিলিপাইনের সরকারকে যে প্রতিবেদন দেয়, তার মূল বক্তব্য ছিল, ‘আমরা আমাদের মেয়েদের ধর্ষিত বা নির্যাতিত হওয়ার জন্য সৌদি আরবে বিক্রি করতে পারি না।’নুরি মিয়াতি নামের এক ইন্দোনেশীয় গৃহকর্মীকে তাঁর সৌদি নিয়োগকর্তা প্রায়ই না খাইয়ে রাখতেন। এ ছাড়া নির্যাতন করে তাঁর হাতের নখ উপড়ে ফেলা হয়েছিল। নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় গত বছর এ মর্মে খবর প্রকাশিত হলে ইন্দোনেশিয়া সৌদি আরবের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে প্রতিবাদ জানায়। ইন্দোনেশিয়া এখন আর নতুন করে সৌদি আরবে গৃহকর্মী পাঠাচ্ছে না।নির্যাতিতা এক বাংলাদেশি: যশোর শহরের বারান্দিনাথ পাড়ায় বাড়ি তাঁর। নারী গৃহকর্মী হিসেবে সৌদি আরবে গিয়ে তিনি নির্যাতিত হন। প্রথম আলোকে তিনি জানান, সৌদি আরবে বাসার কাজ করে মাসে ১৫-১৬ হাজার টাকা আয় করা সম্ভব এবং সেখানে নারীরা পর্দার মধ্যে নিরাপদে থাকেন, এ আশ্বাস দিয়ে তাঁকে রাজি করানো হয়। সহায়সম্পদ বিক্রি করে তিনি এক লাখ টাকা দিয়ে বনানীর একটি রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে সৌদি আরবে যান। ভাগ্যবিড়ম্বিত এই নারী বলেন, সৌদি আরবে যাওয়ার পর তাঁকে একটি বাসায় আটকে নির্যাতন করা হয়। পরিবারের সব পুরুষ সদস্য তাঁকে ধর্ষণ করে ও চাবুক দিয়ে মারে। অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁকে একটি আশ্রয়কেন্দ্রে ফেলে আসা হয়। পরে তিনি অনেক চেষ্টায় যোগাযোগ করার পর ‘রাইটস যশোর’ নামের একটি বেসরকারি সংস্থার সহায়তায় দেশে ফিরেছেন।সরকার ও বায়রার আশ্বাস: সৌদি আরবে গৃহকর্মীদের নিরাপত্তার বিষয়ে জানতে চাইলে বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘নারীদের নিরাপত্তা বিধান করেই সৌদি আরবে পাঠানো হবে। এ নিয়ে দুশ্চিন্তার কিছু নেই।’ কীভাবে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, ‘আগে কোনো ধরনের প্রশিক্ষণ ছাড়াই নারীরা বিদেশে যেতেন। কিন্তু এখন তাঁদের ২১ দিনের একটি প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। এই প্রশিক্ষণ নিয়ে বিদেশে যাওয়ার পর কোনো নারী এখন পর্যন্ত বিপদে পড়েননি। আমরা নিশ্চিত না হয়ে কাউকে সেখানে পাঠাব না।’বায়রার সভাপতি আবুল বাশার এ প্রসঙ্গে প্রথম আলোকে বলেন, ‘সানারকমের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে আলোচনাকালে আমরা বিষয়টি তুলেছিলাম। তখন সিদ্ধান্ত হয়েছে তাঁদের পাঁচজন এবং আমাদের পাঁচজন প্রতিনিধি নিয়ে একটি কমিটি করা হবে। এই কমিটি কোনো নির্যাতনের খবর পেলেই এ ব্যাপারে আইনি ব্যবস্থা নেবে।’

Leave a Reply

Your email address will not be published.