শরিফুল হাসান
একজন সিঙ্গেল মাদার যিনি ১৭ বছর ধরে একমাত্র ছেলেকে নিয়ে জীবনযুদ্ধ করছেন একটা ছোট্ট চাকরি করে নওগাঁয় ইউনিয়ন ভূমি কার্যালয়ের সেই অফিস সহকারী সুলতানর বিরুদ্ধে ফেসবুক হ্যাক করার অভিযোগ রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ের একজন পরিচালকের যিনি কী না যুগ্ম সচিব! এই ঘটনা তদন্তের জন্য বিভাগীয় তদন্ত কিংবা সর্ব্বোচ্চ পুলিশি তদন্তই তো যথেষ্ঠ! কিন্তু কেন একজন যুগ্ম সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করলেন, কেন থানা পুলিশ কোথায় না গিয়ে র্যাবের টহল দলের সঙ্গে গেলেন, আগে কোন মামলা না থাকলেও কেন একজন নারীকে অফিসে যাওয়ার সময় তুলে নেওয়া হলো, কীভাবে তাঁর মৃত্যু হলো-এই প্রত্যকেটা প্রশ্ন গুরুত্বপূর্ণ।
আচ্ছা সুলতানা জেসমিন যদি সরকারি অফিসের অফিস সহকারী না হয়ে একজন বড় কর্মকর্তা হতেন তাহলে কী তাকে এভাবে অফিসে যাওয়ার পথে কেউ তুলে নিতো? তাকে কী তখন এভাবে মরতে হতো? তখন কী এই দেশের বাকি সরকারি কর্মকর্তারা এভাবে চুপ থাকতেন?
পরিবারের সদস্যরা বলছেন, ২২ মার্চ সকালে সুলতানা অফিসে যাওয়ার সময় মুক্তির মোড় এলাকায় একটি সাদা মাইক্রোবাস জেসমিনকে নিয়ে যায়। বিভিন্ন ক্যাম্পে খুঁজেও পাননি। দুপুরের দিকে শুনেন নওগাঁ হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। সেখানে গিয়ে দেখেন ২ জন নারী র্যাব সদস্য ইউনিফর্মে সুলতানাকে পাহারা দিচ্ছে। পরে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। এরপর মৃত্যৃ!
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এফএম শামীম আহমেদ বলছেন, ২২ মার্চ রাত ৯টা ২০ মিনিটে অজ্ঞান অবস্থায় সুলতানাকে নিয়ে আসেন র্যাব কর্মকর্তারা। সুলতানা অজ্ঞান ছিলেন এবং তাকে দ্রুত নিউরোলজি ওয়ার্ডে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে তাকে নিবিড় পরিচর্যা ইউনিটে (আইসিইউ) স্থানান্তর করা হয়, কারণ ক্রমাগত তাঁর অবস্থার অবনতি হচ্ছিল। আমরা সিটি স্ক্যান করি এবং তার মাথায় একাধিক ইন্ট্রাক্রানিয়াল রক্তপাত দেখতে পাই। চিকিৎসকরা সুলতানার মাথায় একটি বাহ্যিক আঘাতও দেখতে পেয়েছেন।
গণমাধ্যমের খবর পড়ে বুঝলাম, আত্মীয়স্বজন সহকর্মীরা কেউই সুলতানার বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ বিশ্বাস করছেন না। ১৭ বছর আগে স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হওয়ার পর একমাত্র ছেলেকে নিয়ে ছিল সুলতানার সংসার। তাঁর ছেলে শাহেদ হোসেন সৈকত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। মায়ের এমন মৃত্যুতে নির্বাক শাহেদ বলছেন, ‘আমার মা চক্রান্তের শিকার। তাঁর ওপর নির্যাতন চালানো হয়েছে। ফলে তাঁর মৃত্যু হয়েছে।’
সুলতানা জেসমিনের মামা বলছেন, ‘আমার ভাগ্নি অত্যন্ত সাদামাটা একজন গৃহিণী। স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হওয়ার পর ছোট্ট একটা চাকরি করে ছেলেটাকে মানুষ করছে সে। তাঁর ছেলের লেখাপড়ার খরচের টাকা অনেক সময় আমাকে দিতে হয়। আর্থিক অনিয়ম করলে তো অভাব-অনটন থাকতো না। তাঁর বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়মের কোনো প্রশ্নই ওঠে না। আমার ভাগ্নি একটা চক্রান্তের শিকার হয়েছে। আমার বিশ্বাস, সঠিকভাবে তদন্ত করলে তাঁর বিরুদ্ধে উঠা অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হবে।’
চিকিৎসকরা বলছেন, সুলতানা মাথায় আঘাত পেয়েছিলেন এবং তার মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়েছিল। হাইকোর্ট সুলতানা জেসমিনের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনসহ সংশ্লিষ্ট নথিপত্র দেখতে চেয়েছেন। রাষ্ট্রপক্ষকে এসব কাগজ আদালতে দাখিল করতে বলা হয়েছে। কোনো মামলা না থাকা সত্ত্বেও র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) কোন ক্ষমতাবলে তাকে তুলে নিয়েছিল, তা জানতে চেয়েছেন হাইকোর্ট। উদ্বেগ প্রকাশ করে আদালত বলেন, ‘তিনি (সুলতানা) হয়তো গুরুতর অপরাধ করেছেন। কিন্তু তার সুরক্ষা এবং ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার আছে। বিনা মামলায় র্যাব কি কাউকে আটক করতে পারবে?’
আমি জানি না সুলতানা অপরাধী না নির্দোষ। তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নিই তিনি অপরাধী তাই বলে কী অফিসে যাওয়ার পথে একজন নারীকে তুলে নিতে হবে? ওই নারীও কিন্তু সরকারি কর্মচারী। কিন্তু তিনি তো ছোট কর্মচারী তাই তাঁর জীবনের দাম নেই, সম্মানের দাম নেই। আচ্ছা ওই নারী যদি আজকে বড় পদে থাকতেন তাহলে কী তাকে ধরে নেওয়ার সাহস পেত কেউ? আচ্ছা যে অপরাধ তিনি করেছেন সেজন্য কী তাঁর মৃত্যুদণ্ড হতো? তাহলে কেন তাঁর জীবন গেল?
জানি না এসবের সঠিক তদন্ত হবে কী না, বা হলেও কী হবে! এই ধরনের ঘটনাগুলো ভীষন মর্মান্তিক। অনেকবছর ধরে বলছি, মানুষের জীবনের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু হতে পারে না। কথায় কথায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা, ক্ষমতা দেখানো, মানুষকে তুলে নেওয়া এগুলোর কোনটাই আইনের শাসন নয়। এসব ঘটনায় কোন বাহিনীর ভাবমুর্তিও বাড়ে না। বরং অনেক অর্জন নিয়ে মানুষ প্রশ্ন তোলে। এসবে দেশেরও অগ্রগতিও হয় না।
আচ্ছা আর কবে নীতি নির্ধারকদের বোধ ফিরবে? আর কবে সুশাসন আসবে এই দেশে? আমরা কেন ভুলে যাই দিনশেষে এই দেশটা আমাদের সবার? কেন সবাই মিলে একটা সুন্দর বাংলাদেশ আমরা গড়তে পারি না?