শরিফুল হাসান
মালয়েশিয়ার পুলিশ অবৈধ শ্রমিকদের চিহিৃত করতে বিদেশি শ্রমিকদের বিভিন্ন শিবিরে অভিযান চালায়। বীনা সিক্রি তখন মালয়েশিয়ায় ভারতের হাইকিমশনার। একবার অভিযান চলাকালে কোন এক ভারতীয় শ্রমিকের পাসপোর্ট ছুড়ে মেরেছিল এক পুলিশ সদস্য। এ ঘটনায় চরম অপামনিত হন ওই ভারতীয় নাগরিক। তার অভিযোগ, পাসপোর্ট অপমান মানে তার দেশকে অপমান।
ক্ষুব্ধ সব ভারতীয় শ্রমিকরা তাদের হাইকমিশনারকে জানাল। বীনা সিক্রি ঘটনাস্থলে ছুটে গেলেন। এই ঘটনায় ভারত এতোটাই শক্ত প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে যে মালয়েশিয়া আর কখনো ভারতীয়দের সঙ্গে এমন আচরণ করেনি।
মালয়েশিয়ার বাংলাদেশি প্রবাসীদের নিয়ে কাজ করতে গিয়ে এক যুগ আগে ঘটনাটি জেনেছিলাম এশিয়ার অভিবাসন বিষয়ক বেসরকারি সংস্থাগুলোর জোট কারাম এশিয়ার সাবেক সমন্বয়ক হারুন আল রশিদের কাছ থেকে। দেড়যুগ ধরে তিনি মালয়েশিয়ার অভিবাসীদের নিয়ে কাজ করছেন।
তাঁর কাছ থেকে জানা এই গল্পটা আমি অনেকবার করেছি আফসোস নিয়ে যে আমরা কেন এমনটা পারি না। আরব আমিরাত বলেন কিংবা দুবাই বলেন, কাতার বলেন কিংবা বাহরাইন মধ্যপ্রাচ্য বলেন কিংবা মালয়েশিয়া বা মালদ্বীপ নানা দেশে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি বাংলাদেশিরা প্রায়ই এই দেশগুলোতে নিপীড়নের শিকার হন। কিন্তু আমরা শক্ত প্রতিবাদ করতে পারি না।
বরং উল্টো আমরাই আমাদের নাগরিকদের সম্মান দিই না। অথচ এই প্রবাসীরাই আমাদের সবচেয়ে বড় শক্তি। একটু পেছনে ফিরেন। ৯ মাসের স্বাধীনতা সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ যখন বিজয় লাভ করে তখন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটি পৃথিবীর অন্যতম দরিদ্রতম দেশ।
একদিকে প্রায় শূন্য রিজার্ভ আরেক দিকে ডলারের তীব্র সংকট। কিন্তু পাঁচ দশক পর আজ অন্য এক উচ্চতায় বাংলাদেশ। এর একটা বড় কারণ প্রবাসী আয়।এ প্রসঙ্গে আমার নিজের একটা ভাবনা আছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে কেউ জানতে চাইলে আমি তিনটি অক্ষর বলি। ই, এফ এবং জি।
ই মানে এক্সপেটিয়েট ওয়ার্কার বা প্রবাসী শ্রমিক। এফ মানে ফার্মারস বা কৃষক। আর জি মানে গার্মেন্টস ওয়ার্কার বা পোশাকশ্রমিক। যে যতো বড় কথাই বলুক বাংলাদেশের অর্থনীতির ভিত আসলে এই তিন খাত। এর মধ্যে প্রবাসীদের অবদান অনন্য।এই যে প্রবাসীরা বছরে ২২-২৪ বিলিয়ন ডলার পাঠায় এটি কিন্তু বিশাল।
সহজ করে বললে, সারা বিশ্ব মিলে বাংলাদেশকে এখন যে পরিমাণ ঋণ বা অনুদান দিচ্ছে বা সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগের (এফডিআই) যে অর্থ আসছে তার চেয়ে ছয় থেকে দশ গুণ পর্যন্ত বেশি অর্থ পাঠাচ্ছেন প্রবাসীরা। এই যে বাংলাদেশ এখন আর বিদেশি ঋণের ওপর নির্ভরশীল কোনো দেশ নয় তার কারণ এই প্রবাসী আয়।
একযুগ আগের বিশ্ব মন্দার কথা মনে আছে? ২০০৮-০৯ সালের বিশ্বব্যাপী ওই অর্থনৈতিক মন্দায় বাংলাদেশকে কোন সংকটে পড়তে হয়নি কারণ ওই প্রবাসী আয়। করোনা মহামারির মধ্যেও রেকর্ড পরিমান ২৪ বিলিয়ন ডলার পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। এই যে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর সারা বিশ্বে যখন সংকট সেই সময়ও বাংলাদেশের ভরসা প্রবাসী আয়। ভেবে দেখেন, শিক্ষিত যে শ্রেণীটি একেবারে বিদেশে চলে যায় বা সুযোগ পেলে যেখানে বিদেশে টাকা পাচার করে সেখানে প্রবাসী বাংলাদেশি শ্রমিকরা কিন্তু নিজ দেশে টাকা পাঠায় মা মাটি আর স্বজনদের জন্য।
আফসোস এত অবদানের পরও প্রবাসীদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বদলায়নি, বিমানবন্দর থেকে শুরু করে দূতাবাস সবখানেই পোহাতে হয় অবর্ণনীয় দুর্ভোগ। পাসপোর্ট তৈরি থেকেই শুরু। এরপর দালাল, চাকরির বিষয়ে অসত্য তথ্য, উচ্চমূল্যে ভিসা কেনাবেচা, স্বাস্থ্য পরীক্ষা, সরকারি ছাড়পত্রসহ সবখানে সীমাহীন যন্ত্রণা। দেশের আকাশ পার হলে শুরু হয় বিরূপ প্রকৃতি, অমানুষিক পরিশ্রম, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে জীবনযাপন, মালিকদের প্রতারণা, নির্যাতনসহ আরও কত-কী! শুনে অবাক হবেন গত ১৪ বছরে ৪৫ হাজার প্রবাসীর লাশ এসেছে।
বলতে দ্বিধা নেই, সরকার, মন্ত্রণালয়, বিমএইটি, কল্যাণ বোর্ডসহ সরকারি বেসরকারি অনেক সংস্থা অনেক উদ্যোগ নিচ্ছে তবে এখনো অনেক পথচলা বাকি। মনে রাখতে হবে, কোটিরও বেশি প্রবাসী শুধু যে দেশের অর্থনীতি সচল রাখছেন তা নয়, অনেক দূর থেকেও বুকের মধ্যে যত্ন করে রেখেছেন লাল-সবুজের জন্য ভালোবাসা।
দেশের এই সংকটময় মুহুর্তে তারাই আমাদের ভরসা। আজ ১৮ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবসকে সামনে রেখে কোটি প্রবাসীকে সালাম। পৃথিবীর যে যেই প্রান্তে আছেন আপনাদের সবাইকে জানাচ্ছি শুভ সকাল। শুভ কামনা আপনাদের জন্য।