ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে যাওয়ার পথে সেদিন কতোবার আমি আমার প্রণয় স্যারের জন্য কেঁদেছিলাম হিসেব নেই। বাসের অনেক যাত্রীই আমার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়েছে। শনিবার সকালে আমি যখন মীরশ্বরাইয়ের দমখালী গ্রামে পৌঁছালাম তখন বেশ বৃষ্টি হচ্ছিল। গ্রামের পথঘাট সব কাঁদা। তবে আমার জন্য ভালোই হয়েছিল। আমার ভেজা চোখ আর বৃষ্টির পানি একাকার হতে পেরেছিল।
প্রণয় স্যার। তাকে চেনানোর জন্য এই দুটো শব্দই আমাদের কাছে যথেষ্ট। আমাদের মানে যারা একসময় চট্টগ্রাম ইউরিয়া ফার্টিলাইজার স্কুলের শিক্ষার্থী ছিলাম। ১৯৮৯ সাল থেকে ২০১৭ সালের 8 সেপ্টেম্বর পৃথিবী ছাড়ার আগ পর্যন্ত স্যার ছিলেন এই স্কুলের ইংরেজির শিক্ষক। ১৯৯৮ সালে আমার স্কুল পর্ব শেষ হয়েছে। তবে প্রণয় স্যার ছিলেন আমার আজীবন শিক্ষক।
প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক ও চিন্তাবিদ আহমদ ছফা তার গুরু জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাককে নিয়ে লিখেছিলেন ‘যদ্যপি আমার গুরু’। তাতে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে আহমদ ছফা বলেছিলেন, অধ্যাপক রাজ্জাকের সান্নিধ্যে আসতে পারার কারনে তার ভাবনার পরিমন্ডল বিস্তৃততর হয়েছে, মানসজীবন ঋদ্ধ এবং সমৃদ্ধতর হয়েছে ।
আহমদ ছফার মতো বড় মানুষ আমি নই। আর আমার প্রণয় স্যারও জাতীয় অধ্যাপক নন, নিতান্তই একজন স্কুল শিক্ষক। কিন্তু আমার কাছে তিনিও আমার গুরু। আমার বলতে দ্বিধা নেই যদি মানুষ হয়ে থাকি পরিবারের পর সবচেয়ে বড় ভূমিকা স্যারের। নিশ্চয়ই আমি আমার স্যারকে নিয়ে আরও বড় কিছু লিখবো।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে এমএ পাস করা প্রণয় স্যার হয়তো বড় সরকারি চাকুরে হতে পারতেন। কিন্তু তিনি সারাজীবন শিক্ষকতাই করতে চেয়েছেন। এটাই ছিলো তার নেশা-পেশা। স্যার আমৃত্যু শিক্ষকতা করে দেখিয়েছেন একজন শিক্ষক কতোটা ভালোবাসতে পারে তার শিক্ষার্থীদের, আর কতোটা ভালোবাসা তিনি পেতে পারেন।
স্কুল পেরিয়ে চট্টগ্রাম কলেজে উচ্চমাধ্যমিক, এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে কতো কতো জ্ঞানী গুনী খ্যাতিমান শিক্ষক পেয়েছি। কিন্তু প্রণয় স্যারের মতো মেধাবী, মানবিক, সৃজনশীল ছাত্র অন্তপ্রাণ শিক্ষক খুব একটা পাইনি।
ইংরেজির শিক্ষক হলেও প্রণয় স্যার আসলে ছিলেন আমাদের আলোকবর্তিকা। স্যার তাঁর মমতা দিয়ে, কেবল লেখাপড়াই শেখাননি শিখিয়েছেন সত্যিকারের মানুষ হওয়ার দর্শন।
আমি যখন সবে পঞ্চম শ্রেণীতে তখুনি স্যার আমার হাতে দেশি বিদেশি সব গল্প উপন্যাস প্রবন্ধ তুলে দিয়েছিলেন। যতোই উপরের ক্লাসে গিয়েছি আরও কঠিন সব বই দিয়েছেন। পড়া শেষে মতামত জানতে চাইতেন। ঘন্টার পর ঘন্টা আলাপ করতেন। দর্শন, মুক্তিযুদ্ধ, বাংলাদেশ, মানুষ, নারীদের সম্মান, বৈষম্যহীন পৃথিবী, মানবতা, মানুষের বিপদে পাশে দাঁড়ানো কী শেখাননি স্যার আমাদের।
চট্টগ্রামের আনোয়ারায় যেখানে সারকারখানা সেটি রাজধানী ঢাকা থেকে প্রায় তিনশ কিলোমিটার দূরে। এই মফস্বলে থাকার পরেও স্যার সবসময় দেশ দুনিয়ার সর্বশেষ খবর রাখতেন। আমাদের জানাতেন। কোন লেখকের কী নতুন বই আসছে সব সংগ্রহে রাখতেন। স্যার আমাদের ইংরেজি পড়াতেন আধুনিক সব বই থেকে।
সত্যি বলছি, বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে কোন কোন শিক্ষকের কথাবার্তা আচরণ দেখে মনে হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই চারজন অধ্যাপক থেকেও বোধহয় আমরা কখনো কখনো একটু বেশি জানি। অথচ প্রণয় স্যারের সাথে কথা বলতে গেলে মনে হতো আমি কিছুই জানি না।
১৯৯৮ সালে স্কুল ছাড়ার পর, বিশেষ করে মা মারা যাওয়ার পর আমি সিইউএএলের সরকারি ওই কলোনীতে যাওয়া ছেড়েই দিয়েছিলাম। যে দুই তিনবার গেছি স্যারের সাথে দেখা করাই ছিলো বড় উদ্দেশ্য। সত্যি বলছি চট্টগ্রাম কলেজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া আর ১৪ বছর সাংবাদিকতায় থাকার সুবাদে অনেক বড় মানুষ, বিখ্যাত মানুষ দেখেছি। কিন্তু কাছে গিয়ে এদের অনেককেই ছোট মনে হয়েছে। আর প্রণয় স্যারের কাছে যতোবার গেছি মনে হয়েছে বড় থেকে বড়তর মানুষ। নিরহঙ্কারী, বিনয়ী, সাদামাটা একজন মানুষ যিনি সদা ব্যস্ত তার ছাত্রদের অলোকিত করতে। ছাত্রছাত্রীরা স্যারকে যে কী পরিমান ভালোবাসতো।
স্যারের বাসাটা ছিলো আস্ত এক লাইব্রেরী। কতো ধরনের বই যে সেখানে ছিলো। স্যার সেখান থেকে ছাত্রছাত্রী বুঝে বই দিতেন। কাউকে দর্শনের কাউকে বিজ্ঞানের বই দিতেন। বই পড়ার অভ্যাস করানোর জন্য কাউকে কাউকে দিতেন শুধুই উপন্যাস। স্যার চাইতেন সবাই বই পড়ুক।
না বললেই নয়, আমার প্রতি স্যারের ভালোবাসা ছিলো ভয়াবহ রকমের বেশি। গত ত্রিশ বছরে স্যারের কতো শত শত ছাত্র দেশ দুনিয়া আলোকিত করেছে। তাদের কেউ ডাক্তার, কেউ প্রকোশলী কেউ বড় সরকারি কর্মকর্তা, কেউ কানাডা আমেরিকায় প্রবাসী। এতো সব সফল যোগ্য ছেলেমেয়ে রেখে সব ব্যাচের ছেলেমেয়েদের স্যার শুধু আমার কথা আমার কথা বলতেন! স্যার তার ছাত্রদের বলতেন যে কয়জনকে মানুষ বানাতে পেরেছেন সেই তালিকায় শরিফুল হাসান সবার আগে। এসব ছাত্রদের সঙ্গে পরে কখনো দেখা হলে ওরা আমাকে বলতো আপনিই শরিফুল হাসান ভাই? আমি কিছুটা বিব্রত বোধ করতাম।
মনে আছে ছোটবেলায় আমাকে স্যার কতো কতো বই পড়তে দিয়েছেন। নানা ধরনের বই দিতেন আমাকে। পড়ার পর সেসব বইয়েয়র ভালো মন্দ জানতে চাইতেন। ঘন্টার পর ঘন্টা আলোচনা করতেন।
ছোটবেলায় সেই যে শুরু, এই সম্পর্ক ছিলো আমৃত্যু। প্রচণ্ড অসুস্থ অবস্থায়ও স্যার আমাকে কবিতা পড়ে শোনাতেন। তাঁর নানা লেখা নিয়ে আলাচনা করতেন। এমনকি ব্যক্তিগত, পারিবারিক নানা বিষয়ে স্যার আমার সাথে কথা বলতেন। এমনও হয়েছে পাহাড়ি রাস্তায় আমরা দুজন বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে গল্প করেছি।
যারা জানেন না শুনে অবাক হতে পারেন সেই ২০০০ সালেই স্যার ক্লোন ক্যানসারে আক্রান্ত হন। দেশের ডাক্তাররা জানিয়ে দিয়েছিল স্যারের ক্যানসার। খুব বেশিদিন বাঁচবেন না। আমি তখন সবে উচ্চ মাধ্যমিক দিয়েছি। স্যার ঠিক করলেন ভারত যাবেন চিকিৎসা করাতে। আমি স্যারের ভিসার লাইনে দাঁড়ালাম।
ভারতে যাওয়ার আগে স্যারের সাথে তাঁর গ্রামে গেলাম। স্যার তাঁর স্কুল দেখালেন। গ্রামের বাড়ি দেখালেন। বললেন, আমি যদি মরে যাই সব চিনে রাখো। আমি বললাম স্যার আপনি সুস্থ হয়ে যাবেন। চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে স্যারকে বিদায় দেয়ার সময় বললাম কেউ না থাকুক আমি আছি আপনার পাশে।
ভারতে গিয়ে অস্ত্রোপাচারের পরও অবস্থার কিছুটা উন্নতি হলেও নিয়মিতই সংকট থাকতো। ডাক্তাররা আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু স্যার কখনো আশা ছাড়েননি। নিজের সব রপ্ত করা কৌশলে স্যার আরও ১৭ টা বছর বাঁচলেন। ডাক্তাররা স্যারকে দেখে অবাক হতো।
স্যার ‘প্রবচন প্রদীপন’‘বুদ্ধির মুক্তি ও বেদনা মাধুরী’, ‘আকাশলীনার সাথে কিছুক্ষণ’, ‘অতঃপর মেঘের কাছে’ নামে যখন যে কাব্যগ্রন্থ লিখেছেন প্রত্যেকটা অামাকে পড়ে শুনিয়েছেন। স্যারের লেখা সর্বশেষ বই যেটা ২০১৭ সালের বইমেলায় এসেছিল সেটার নাম প্রবচন প্রদীপন। স্যার অসুস্থ অবস্থায়ও প্রতি বছর বইমেলায় আসতেন। ২০১৭ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি স্যার ঢাকায় এসে পুরো বইটা আমাকে পড়ে পড়ে শুনিয়েছেন। বইটা উপহার দেয়ার সময় লিখেছেন, আমার আকাশ প্রিয় হাসান।
মানব সেবা করবে এমন ব্রত নিয়ে নিজের একমাত্র মেয়ে কৃষ্টি প্লাবনী তন্বীকে স্যার ডাক্তার বানাচ্ছিলেন। কয়েকদিন আগে যখন তন্বী ফেসবুকে লিখলো, ‘সৃষ্টিকর্তার কাছে বাবার জন্য দোয়া চাই, আমার বুক কেঁপে উঠলো’।
এরমধ্যেই আমি টানা তিনদিন ভাইরাস জ্বরে ভুগলাম। ৮ সেপ্টেম্বর রাতে জ্বর ছাড়ার পর যখন বিছানা থেকে উঠলাম তখুনি পেলাম নিষ্ঠুর বার্তা। আমার স্যার আর বেঁচে নেই। আমি সেই কষ্টের কথা ভুলতে পারবো না। মনে হলো, মা মারা যাওয়ার পর আরেকবার অভিভাবক হারানোর তীব্র কষ্ট অনুভব হলাম।
যে অবস্থায় ছিলাম আমি দ্রুত চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম।
ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে যাওয়ার পুরো পথটায় বারবার আমার চোখ ভিজেছে। ঢাকায় বসে যখন খবর এলাম আমার স্যার আর নেই আমি যে অবস্থায় ছিলাম রওয়ানা দিলাম। পুরোটা পথ স্যারের সঙ্গে আমার স্মৃতিগুলো ভাবছিলাম। ২৭ বছরে কতো কতো কতো স্মৃতি।
এসব ভাবতে ভাবতে সকালে যখন মিরসরাইয়ের শাইরখালী ইউনিয়নের দমখালী গ্রামে স্যারের বাড়িতে পৌঁছালাম তখন বৃষ্টিভেজা পথে কাঁদছিলাম। ১৭ বছর আগে ২০০০ সালে আমি এই বাড়িতে এসেছিলাম স্যারের সাথে। আজ আবার ঢাকা থেকে এলাম।
আমি বাড়িতে গিয়ে দেখি পুকুরপাড়ে স্যারকে প্রস্তুত করা হচ্ছে চিরতরে মাটিতে শোয়ানোর। আমি স্যারের মুখের দিকে তাকিয়ে, স্যারকে ছুয়ে বসে থাকলাম। স্যারের মুখে লেগে থাকা সেই মিষ্টি হাসি দেখে আমার বিশ্বাসই হচ্ছিল না স্যার আর নেই। বরং বারবার মনে হচ্ছিল আমাকে দেখে স্যার হাসিমুখে বলে উঠবেন, এসেছ তুমি? চলো কবিতা শুনবে। কিন্তু সে তো আর কোনদিন হবে না। আর কোনদিন স্যার আমার সাথে আড্ডা দেবেন না।
প্রণয় স্যার ছিলেন আমাদের আলোকবর্তিকা। আমার দেখা সত্যিকারের বড় মানুষদের একজন। আজ হয়তো স্যার নেই। কিন্তু স্যার আসলে বেঁচে থাকবেন আমার মতো তাঁর হাজারো ছাত্রছাত্রীর অন্তরে। আমরা সারাজীবন বলবো আমাদের একজন প্রণয় স্যার ছিলো। স্যার আপনি আজীবন আলোকবর্তিকা হয়ে থাকবেন আমাদের মনে।
(স্যারের স্মরণে প্রকাশ হতে যাওয়া স্মরণিকার জন্য লিখেছিলাম। অাজ ১ ফেব্রুয়ারি স্যারের জন্মদিন। স্যার অাজ পৃথিবীতে নেই। স্যারকে স্মরণে লেখাটি দিলাম)।