আজ সকালের ঘটনা। মোটরসাইকেলে একজনকে নামিয়ে দিতে এসেছিলাম মিরপুরের সরকারি বাংলা কলেজে। বৃষ্টির আশঙ্কায় একটু অপেক্ষা করছিলাম কলেজের ভেতরে। এক জায়গায় বসে না থেকে হাঁটছিলাম। তখুনি চোখে পড়লো কবরটা। এপিটাফটা দেখে অবাক হলাম। ভাষা আন্দোলনের জনক প্রিন্সিপাল আবুল কাশেমের কবর।
মিরপুর বাংলা কলেজে অামার সেভাবে অাসা হয়নি। বছর দশেক আগে একজনের ভর্তির তথ্য জানতে এই কলেজে একবার এসেছিলাম। আজ দ্বিতীয়বার আসা। শুক্রবার বলে কলেজের ভেতরে শান্ত পরিবেশ। হাঁটতে হাঁটতেই কলেজের পেছন দিকে গেলাম। পেছনে যে এতো বড় একটা পুকুর আছে জানা ছিল না। কেমন গ্রাম গ্রাম পরিবেশ। একটা ছোট্ট ছাত্রাবাসও দেখি আছে। আছে ছোট্ট একটা মসজিদও। হঠাৎ মসজিদের সামনেই কবরটা চোখে পড়লো।
আগ্রহ নিয়ে এপিটাফটা পড়তেই জানলাম প্রিন্সিপাল আবুল কাশেমের কবর। আমার জানাই ছিলো না তাঁর কবর এখানে। চট্টগ্রামের ছেলে ভাষা আন্দোলনের অগ্রসৈনিক আবুল কাশেম সম্পর্কে মোটামুটি জানি। কিন্তু তাঁর কবরটা চট্রগ্রামে না হয় এখানে কেন?
আরেকটু জানতে ইন্টারনেট ঘাটাঘাটি করে জানলাম যে বাংলা কলেজে বসে আছি সেই বাংলা কলেজেরই প্রতিষ্ঠাতা আবুল কাশেম। ১৯ বছর এই কলেজেরই অধ্যক্ষ ছিলেন তিনি।
বাংলাপিডিয়া বলছে ১৯২০ সালের ২৮ জুন চট্টগ্রাম জেলার পটিয়া থানার ছেদন্দি গ্রামে তাঁর জন্ম। আবুল কাশেম ১৯৩৯ সালে বরমা হাইস্কুল থেকে প্রবেশিকা এবং ১৯৪১ সালে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে আইএসসি পাস করেন। ১৯৪৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিজ্ঞানে বিএসসি (অনার্স) এবং ১৯৪৫ সালে এমএসসি ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৪৬ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞানের লেকচারার পদে যোগ দেন। ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত ছিলেন।
ভাষা আন্দোলনে কীভাবে জড়ালেন তিনি?জানা গেলো আবুল কাশেমের উদ্যোগে ১৯৪৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হয় সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সংগঠন পাকিস্তান তমদ্দুন মজলিশ। তিনি ছিলেন এর সাধারণ সম্পাদক। এই সংগঠনের মাধ্যমেই সর্বপ্রথম তিনি বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতিদানের দাবি উত্থাপন করেন। এই লক্ষ্যে ১৯৪৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা: বাংলা না উর্দু’ শিরোনামে একটি পুস্তিকা প্রকাশিত হয়। এই মূল পুস্তিকায় আবুল কাশেম প্রণীত একটি সংক্ষিপ্ত প্রস্তাবনাও ছিল, এবং তাতে ছিল বাংলাকে শিক্ষার মাধ্যম এবং পূর্ববাংলার অফিস আদালতের ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার দাবি। তাঁরই উদ্যোগে তমদ্দুন মজলিশ ১৯৪৭ সালের ১ অক্টোবর সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠনে নেতৃত্ব দেয়।
রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদই ১৯৪৭ সালের শেষের দিকে এবং ১৯৪৮ সালের প্রথমদিকে ভাষা আন্দোলন সংগঠিত করে। ভাষা আন্দোলনের সূচনাপর্বে আবুল কাশেম ছিলেন আন্দোলনের মধ্যমণি। বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবির সপক্ষে ব্যাপক সমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে তিনি অসামান্য অবদান রাখেন। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবির সপক্ষে যুব সমাজ এবং বিশেষত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও ছাত্রদের সমর্থন লাভে তাঁর সাফল্য ছিল অভাবনীয়। ১৯৪৭ সালের ৬ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ আয়োজিত প্রথম প্রতিবাদ সভায় তিনি সভাপতিত্ব করেন। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ দেশব্যাপী ধর্মঘট সংঘটনে তাঁর সক্রিয় ভূমিকা ছিল।
আবুল কাশেম ছিলেন বাংলা সাপ্তাহিক সৈনিক পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর সম্পাদনায় পত্রিকাটি ১৯৪৮ সালের ১৪ নভেম্বর ঢাকা থেকে প্রথম প্রকাশিত হয়। তমদ্দুন মজলিশের মুখপত্র হিসেবে এই পত্রিকাটি ভাষা আন্দোলনের আদর্শ ও লক্ষ্য প্রচারে সক্রিয় ছিল। ১৯৬১ সাল পর্যন্ত পত্রিকাটি চালু থাকে।
আবুল কাশেম এবং তমদ্দুন মজলিশের কতিপয় নেতৃস্থানীয় সদস্য অচিরেই উপলব্ধি করেন যে, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠাকালে যে রাষ্ট্রীয় আদর্শের কথা বলা হয়েছিল, পাকিস্তান তখন আর সে আদর্শে পরিচালিত হচ্ছে না। এর ফলে তমদ্দুন মজলিশের অধিকাংশ সদস্য মুসলিম লীগ থেকে সরে যান। আবুল কাশেম তখন একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের উদ্যোগ নেন। ফলে ১৯৫২ সালে আবুল হাশেমকে সভাপতি করে গঠিত হয় খিলাফতে রববানী পার্টি। আবুল কাশেম যুক্তফ্রন্টের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে ১৯৫৪ সালে চট্টগ্রামের পটিয়া-বোয়ালখালী নির্বাচনী এলাকা থেকে পূর্ববাংলা আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৫৬ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর তিনি আইন পরিষদে শিক্ষার সকল স্তরে বাংলাকে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে চালু করার প্রস্তাব পেশ করেন।
জেনে ভালো লাগলো কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষায় বাংলা মাধ্যম প্রবর্তনের অপরিহার্যতা উপলব্ধি করে আবুল কাসেম ১৯৬২ সালে বাংলা কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। এ কলেজ প্রতিষ্ঠার ফলে বাংলা মাধ্যমে উচ্চশিক্ষা লাভের দ্বার উন্মুক্ত হয়। তিনি দীর্ঘ উনিশ বছর (১৯৬২-১৯৮১) বাংলা কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। তবে এর অধিকাংশ সময়ই তিনি কলেজ থেকে কোনো পারিশ্রমিক বা বেতন গ্রহণ করেননি।
একজন বহুমুখী লেখক, প্রিন্সিপাল আবুল কাশেম পদার্থবিজ্ঞান ও বিজ্ঞানের অপরাপর শাখায় কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের পাঠ্যবইসহ প্রায় এক শত গ্রন্থ রচনা করেন। বাংলা বানান এবং বাংলা লিখনরীতি সংস্কারের লক্ষ্যে তিনি একটি নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন। তিনি বাংলা একাডেমী, আর্ট কলেজ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, সিটি কলেজসহ পঞ্চাশটিরও অধিক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন।
জাতির সেবায় তাঁর অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ প্রিন্সিপাল আবুল কাশেম বাংলা একাডেমি, স্বাধীনতা পুরস্কার, চট্রগ্রাম সমিতি পদকহ জাতীয় ও সামাজিক অনেক পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৮৯ সালে তাঁকে ঢাকায় জাতীয় সংবর্ধনা দেয়া হয় যাতে বাংলাদেশ ও ভারতের খ্যাতনামা পন্ডিত ও সাহিত্যিকগণ অংশগ্রহণ করেন। ১৯৯১ সালের ১১ মার্চ ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।
তথ্যগুলো একনাগাড়ে পড়ে আবুল কাসেমের প্রতি ভালো লাগাটা বেশ বাড়লো। তবে খারাপ লাগছে এইভেবে যে বাংলা ভাষার জন্য তিনি এতোকিছু করলেন যে বাংলা কলেজ তাঁর হাতে প্রতিষ্ঠিত সেই কলেজের ভেতরে পাতি ছাত্রলীগ নেতা থেকে আরম্ভ করে নানা পর্যায়ের নেতার নামে অসংখ্য ছবি পোস্টার থাকলেও কোথাও প্রিন্সিপাল আবুল কাশেমের একটা ছবি বা নামফলক নেই। ভাগ্যিস কবরটা ছিল! অাচ্ছা এই কলেজের শিক্ষক ছাত্রনেতা কারো কী মনে হয় না কলেজের মূল ভবনের সামনে বা কোথাও অাবুল কাশেম স্যারের নামে একটা নামফলক করতে! অাচ্ছা এই কলেজের ছেলেমেয়েরা কী জানে অাবুল কাশেম কে? তারা কী কখনো এই কবরটা দেখেছে?
কলেজ ছাত্রাবাসের সাথেই বেশ বড়সড় বাগান। কয়েকজন জানালেন, মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে কলেজটিতে লাইনে দাঁড় করিয়ে মেরে ফেলা হতো নিরীহ বাঙালিদের। পাঠদান কক্ষে এনে চালানো হতো ভয়াবহ নির্যাতন। কলেজের আঙিনায় থাকা আমগাছের গোড়ায় জবাই করা হতো গণহারে। আবার সেই কলেজের কর্মচারীকে দিয়েই মোছা হতো রক্ত, সরানো হতো লাশ। কিন্তু আজও মিরপুরের সেই বাঙলা কলেজে স্থাপন করা হয়নি কোনও সংরক্ষিত বধ্যভূমি।বাঙলা কলেজের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পর ২০০৯ সালে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় ‘বধ্যভূমি সংরক্ষণ ও স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ’ প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত করে নকশা প্রণয়ন করে। তবে সাত বছর কেটে গেলেও হয়নি কোনও স্মৃতিস্তম্ভ।
কলেজ মাঠের বটতলায় বসে এসব লিখতে লিখতে মনে হচ্ছিল যে গাছ আমাদের ছায়া দেয় আশ্রয় দেয় সেই গাছের শেকড় উপড়াতে বা কেটে ফেলতেই বোধহয় আমাদের বেশি আনন্দ। অবশ্য তাতে আবুল কাসেম বা শহীদদের কিছু যায় আসে না। তাঁরা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন আজীবন।