শরিফুল হাসান

সকালটা শুরু হয়েছিল ভোটারদের উপস্থিতি দিয়ে। ভোটের পরিবেশ ছিল ভালো। কিন্তু বেলা যত গড়িয়েছে, ততই বেড়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ প্রার্থী ও তাঁদের লোকজনের দাপট। সেই দাপটে ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই বিএনপি, স্বতন্ত্র প্রার্থীসহ বাকিরা অসহায় হয়ে পড়েন। এরপরেই ঘটতে থাকে কেন্দ্র দখল, ব্যালট ছিনতাই, প্রকাশ্যে সিলমারা, সংঘর্ষসহ একের পর এক অপ্রীতিকর ঘটনা। কমতে থাকে ভোটারদের উপস্থিতি।
ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) নির্বাচনের প্রথম ধাপে বরিশালের বেশির ভাগ ইউনিয়নের ভোটের চিত্র এমনই ছিল। গতকাল মঙ্গলবার বরিশালের ৭৪টি ইউনিয়নে ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়।
বিএনপি ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের অভিযোগ, অনেক জায়গায় পুলিশ ও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সামনেই এমন ঘটনা ঘটেছে। নির্বাচন নিয়ে উজিরপুর, বাকেরগঞ্জ, বরিশাল সদরসহ বিভিন্ন স্থানে প্রায় অর্ধশত লোক সংঘর্ষে আহত ও মারধরের শিকার হয়েছেন।
তবে ভোট গ্রহণ শেষে বরিশালের পুলিশ সুপার এস এম আক্তারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘দু-একটি জায়গায় সমস্যা হওয়ায় পুলিশ ফাঁকা গুলি ছুড়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করেছে। তবে সার্বিকভাবে পরিবেশ শান্তিপূর্ণ ছিল।’
অবশ্য জেলা বিএনপির দক্ষিণের সভাপতি ওবায়দুল হকের দাবি, প্রতিটি ইউনিয়নে কারচুপি হয়েছে। এমন অভিযোগ ভিত্তিহীন দাবি করে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাংসদ তালুকদার মো. ইউনুস বলেন, সুষ্ঠু পরিবেশে নির্বাচন হয়েছে।
নারীরাই বেশি: সকাল আটটায় সদর উপজেলার চরবাড়িয়া ইউনিয়নের মকবুল হোসেন প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের সামনে গিয়ে দেখা যায়, ভোটারদের দীর্ঘ লাইন। পুরুষের চেয়ে নারী ভোটার বেশি। লাইনে দাঁড়ানো মধ্যবয়সী মুকুল বেগম বলেন, ‘ভোট দেওয়া তো নাগরিক দায়িত্ব। নাগরিক হিসেবে ভোট দিচ্ছি।’
জাগুয়া ইউনিয়নের কয়েকটি কেন্দ্রে নারী ভোটার বেশি দেখা যায়। এখানকার প্রিসাইডিং কর্মকর্তা হারুন অর রশিদ বলেন, তাঁর কেন্দ্রে মোট ভোটার ৬৬৯ জন। এর মধ্যে ৫৪১ জনই ভোট দিয়েছেন, যাঁদের মধ্যে ২৭১ জনই নারী।
প্রার্থীরা যখন অসহায়: ভোট শুরুর ঘণ্টা খানেক পর সদর উপজেলার চরকাউয়া ইউনিয়নের স্বতন্ত্র প্রার্থী মো. শাহজাহান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভোট শুরুর পরপরই সব কেন্দ্র দখল করে নেয় আওয়ামী লীগের বহিরাগত লোকজন। নির্বাচনে সবার জন্য সমান পরিবেশ থাকার কথা। কিন্তু একজন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে আমি অসহায় বোধ করেছি।’
কাশিপুর ইউনিয়নে বিএনপির প্রার্থী মো. হোসেন শিকদার বলেন, তিলকলা ডেমা কেন্দ্রে তাঁর এজেন্টকে আওয়ামী লীগের লোকজন কেন্দ্রে ঢুকতেই দেয়নি।
রায়পাশা-কড়াপুর ইউনিয়নের পপুলার মাধ্যমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সমর্থকদের মধ্যে সকালে সংঘর্ষে জেলা ছাত্রলীগ নেতা রনি সেরনিয়াবাত আহত হন। এখানকার বিএনপির প্রার্থী বর্তমান চেয়ারম্যান নুরুল আমিন বলেন, পপুলারসহ বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে বিএনপির লোকজনকে বের করে দেওয়া হয়। একপর্যায়ে বিএনপির কর্মীদের সঙ্গে মারামারি করে এখানে ভোট বন্ধ করে দেওয়া হয়। তাঁর বিজয় ঠেকাতেই এটা করা হয়েছে।
সদর উপজেলার নির্বাচন কর্মকর্তা আবদুল মান্নান বলেন, ‘কয়েকটি কেন্দ্রের বাইরে মারামারি হলেও কেন্দ্রের ভেতরের পরিবেশ ঠিক ছিল।’
বাকেরগঞ্জে পুলিশের গুলি, ভোট স্থগিত: বাকেরগঞ্জের নিয়ামতি ইউনিয়নের আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি এবং বর্তমান চেয়ারম্যান কামাল হোসেন তালুকদার বলেন, ‘সকালে প্রথম দুই ঘণ্টা সুষ্ঠু ভোট হয়। এরপর আওয়ামী লীগ প্রার্থী ও দলীয় লোকজন কেন্দ্রে কেন্দ্রে ঢুকে দরজা-জানালা ভেঙে ব্যালট ছিনিয়ে নৌকায় সিল মারতে থাকে। স্থানীয় জনতা প্রতিরোধ করলে পুলিশ ফাঁকা গুলি চালায়। পরে ভোট বন্ধ হয়ে যায়।’
বাকেরগঞ্জ থানার ওসি আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘বাকেরগঞ্জের নিয়ামতি এবং চরামদ্দি ইউনিয়নের দুটি কেন্দ্রে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে ফাঁকা গুলি করা হয়েছে। ওই দুটি কেন্দ্রের ভোট গ্রহণ স্থগিত করা হয়েছে।
ব্যালট পেপার পানিতে: দুপুর ১২টার দিকে বাবুগঞ্জের মাধবপাশা ইউনিয়নের চন্দ্রদ্বীপ স্কুল অ্যান্ড কলেজে গিয়ে দেখা যায়, পাশের পুকুরে ব্যালট ভাসছে। আর সাধারণ ভোটাররা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার ব্যালট পাচ্ছেন না। এখানকার বিএনপির প্রার্থী ওয়াহিদুল ইসলাম বলেন, ভোট শুরুর ঘণ্টা দুয়েক পরে আওয়ামী লীগের লোকজন গুলি ছুড়ে চেয়ারম্যান পদের ব্যালট ছিনিয়ে সিল মারতে থাকে।
আগরপুরে বিএনপির প্রার্থী কামরুল হাসানও একই রকম অভিযোগ করেছেন। তবে উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা আবদুল হাই বললেন, যেসব অভিযোগ পেয়েছেন, ব্যবস্থা নিয়েছেন।
আনসারের মৃত্যু: বানারীপাড়ার বিশারকান্দি ইউনিয়নের মুরারবাড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দায়িত্ব পালনের সময় ঘুমিয়ে পড়ায় নিজের গুলিতে আল আমিন হোসেন (৪০) নামে এক আনসার সদস্য নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে পুলিশ। বানারীপাড়া থানার ওসি জিয়াউল আহসান জানান, অসাবধানতাবশত হাতে থাকা রাইফেলের ট্রিগারে চাপ পড়ে গুলি বের হয়ে তাঁর শরীরে বিদ্ধ হয়। এতে ঘটনাস্থলেই তিনি মারা যান।