১৯৭১ সালের জানুয়ারির শেষ সপ্তাহ। মতিউর রহমান সপরিবারে দুই মাসের ছুটিতে আসেন ঢাকায়। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ডাক এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। বার্তা পেয়ে গেছেন মতিউর। ২৫ মার্চের কালরাতের ভয়াবহতা দেখলেন। শুরু করলেন প্রতিরোধযুদ্ধ। নরসিংদীর রায়পুরের রামনগর গ্রামে ছিলেন তিনি তখন ৷ পাকিস্তান বিমান বাহিনীর একজন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট হয়েও অসীম ঝুঁকি ও সাহসিকতার সাথে ভৈরবে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য একটি ট্রেনিং ক্যাম্প খুললেন ৷ যুদ্ধ করতে আসা বাঙালি যুবকদের প্রশিক্ষণ দিতে থাকলেন ৷ মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন স্থান থেকে সংগ্রহ করা অস্ত্র দিয়ে গড়ে তুললেন একটি প্রতিরোধ বাহিনী ৷ সশস্ত্র বাহিনীর কর্মকর্তা হয়েও তিনি দৌলতকান্দিতে জনসভা করেন এবং বিরাট মিছিল নিয়ে ভৈরব বাজারে যান। পাক-সৈন্যরা ভৈরব আক্রমণ করলে বেঙ্গল রেজিমেন্টে ই,পি,আর-এর সঙ্গে থেকে প্রতিরোধ করলেন। ১৯৭১ সালের ১৪ এপ্রিল পাকিস্তানি বিমান বাহিনী এফ-৮৬ স্যাবর জেট থেকে তাঁদের ঘাঁটির উপর বোমাবর্ষণ করে ৷ মতিউর রহমান পূর্বেই এটি আশঙ্কা করেছিলেন৷ তাই ঘাঁটি পরিবর্তন করেন এবং ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা পান তিনি ও তাঁর বাহিনী৷ এরপর পারিবারিক চাপেই ১৯৭১ সালের ২৩ এপ্রিল ঢাকা আসেন ও ৯ মে সপরিবারে করাচি ফিরে যান। মনে মনে ঠিক করেন আকাশপথে মুক্তিবাহিনীকে শক্তিশালী করতে হবে। কিন্তু কীভাবে?
ওদিকে ১লা মার্চ মতিউরের কর্মস্থলে ফিরে যাবার কথা। কেন গেলেন না? পাকিস্তানে ফেরার পর কর্তৃপক্ষের কাছে দেরিতে যোগদানের কারন দর্শাতে হলো। পাকিস্তানি বাহিনী তাকে ফ্লাইং সেফটি অফিসারের দায়িত্ব দিলো। মতিউরের মন পড়ে আছে বাংলাদেশে। নিয়মিত কাজের আড়ালে তিনি একটি বিমান ছিনতাই করে মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের পরিকল্পনা করতে থাকেন। এনিয়ে তিনি কয়েকজন দেশপ্রেমিক বাঙালি অফিসারের সাথে আলোচনাও করেন। একদিন ঠিক করে ফেলেন পরিকল্পনা। তারিখটা ছিল আজকের দিন।
২০ই আগস্ট সকাল। করাচির মৌরিপুর বিমান ঘাঁটি। সকাল ১১ টা ১৫। পাঞ্জাবী পাইলট অফিসার মিনহাজ রশীদসহ টি-৩৩ প্রশিক্ষণ বিমান (কল সাইন ব্লু-বার্ড-১৬৬)নিয়ে আকাশে উড়বেন। মতিউর ঠিক করেন মিনহাজ কন্ট্রোল টাওয়ারের অনুমতি পেয়ে গেলে তিনি তাঁর কাছ থেকে বিমানটির নিয়ন্ত্রন নিয়ে নেবেন। পরিকল্পনা অনুসারে অফিসে এসে গাড়ি নিয়ে চলে যান রানওয়ের পূর্ব পাশে৷ সামনে দুই সিটের প্রশিক্ষণ বিমান টি-৩৩ । পাইলট মিনহাজ বিমানটি নিয়ে দ্বিতীয় বারের মত একক উড্ডয়নের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। কন্ট্রোল টাওয়ার ক্লিয়ারেন্সের পর মিনহাজ বিমানটি নিয়ে রানওয়েতে উড্ডয়নের প্রস্তুতি নিলে মতিউর রহমান সেফটি অফিসারের ক্ষমতাবলে বিমানটি থামাতে বলেন। মিনহাজ বিমানটি থামান এবং ক্যানোপি ( জঙ্গি বিমানের বৈমানিকদের বসার স্থানের উপরের স্বচ্ছ আবরন) খুলে বিমান থামানোর কারণ জানতে চান। এসময় মতিউর রহমান বিমানের ককপিটে চড়ে বসেন এবং রাশেদ মিনহাজকে ক্লোরোফর্ম দিয়ে অচেতন করে ফেলেন। জ্ঞান হারানোর আগে রাশেদ মিনহাজ কন্ট্রোল রুমে জানিয়ে দেন বিমানটি হাইজ্যাক হয়েছে।

মৌরিপুরের ছোট পাহাড়ের আড়ালে থাকায় মতিউররের প্লেন ছিনতাই কেউ দেখতে না পেলেও কন্ট্রোল টাওয়ার মিনহাজের বার্তা শুনতে পেল সবাই। রাডারে বিমানের অবস্থান বুঝে অপর চারটি জঙ্গি বিমান ধাওয়া করলো মতিউরকে। মৃত্যু আসন্ন জেনেও মতিউর রহমান বিমানটি নির্ধারিত সীমার নিচে চালিয়ে রাডার কে ফাঁকি দিয়ে বাংলাদেশের অর্থাৎ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের দিকে উড়তে থাকলেন। ভারতের সীমান্তে পৌঁছে যাওয়ার একটু আগে রশিদ মিনহাজ জ্ঞান ফিরে পান এবং বিমানটির নিয়ন্ত্রন নিতে ফের চেষ্টা করেন। এ সময় রশিদের সাথে মতিউরের ধ্বস্তাধস্তি চলতে থাকে এবং এক পর্যায়ে রশিদ ইজেক্ট সুইচ চাপলে মতিউর বিমান থেকে ছিটকে পড়েন। বিমানটি কম উচ্চতায় উড্ডয়ন করার ফলে বিধ্বস্ত হয়। মতিউর রহমানের সাথে প্যারাসুট না থাকায় তিনিও নিহত হন। তাঁর মৃতদেহ ঘটনাস্থল হতে প্রায় আধ মাইল দূরে পাওয়া যায়।
রশীদ মিনহাজকে পাকিস্তান সরকার পাকিস্তানের সর্বোচ্চ সামরিক খেতাব ‘নিশান-ই-হায়দার’এ ভূষিত করে। তার নামে পাকিস্তান বিমান বাহিনীর একটা ঘাঁটির নামকরন করা হয়, করাচীর একাধিক রাস্তার নামকরন হয়। আর মশরুর বিমানঘাঁটিতে পাকিস্তানের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের কবরস্থানে দাফন করে মতিউরকে। জামায়াতে ইসলামীর মুখপত্র দৈনিক সংগ্রামে মিনহাজের মৃত্যুর জন্য গর্ববোধ করে ৩০ আগস্ট, ১৯৭১ এ ‘আমরা গর্বিত’ শিরোনামে একটি সম্পাদকীয় প্রকাশ করে আল্লামা মতিউর রহমান নিজামীর বয়ানে। পরবর্তীতে, ১ সেপ্টেম্বর ‘শহীদ মিনহাজের জীবনের শেষ কয়েকটি মূহুর্ত’ শিরোনামে পরিবেশিত সংবাদে মতিউর রহমানকে বিশ্বাসঘাতক ও মিনহাজ রশীদকে শহীদ বলে আখ্যায়িত করে। ৪ সেপ্টেম্বর তৎকালীন ছাত্র সংঘের প্রধান নিজামী মিনহাজের পিতার কাছে একটি শোকবার্তা পাঠান। সেই শোকবার্তায় নিজামী বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানকে ভারতীয় এজেন্ট বলে উল্লেখ করে। আর ৩৫ বছর ধরে মতিউরের কবরে লেখা ছিলো, ‘ ইদার শো রাহা হ্যাঁ এক গাদ্দার। ‘
তবে মৃত্যুর ৩৫ বছর পর ২০০৬ সালের ২৪ জুন মতিউরের দেহাবশেষ পাকিস্তান থেকে দেশে এনে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় মিরপুর শহীদ বুদ্ধজীবী কবর স্থানে পুনঃসমাহিত করা হয়। মতিউর রহমানকে নিয়ে অগ্নিবলাকা নামের একটি ডকুড্রামা নির্মাণ করা হয় ২০০২ সালে যেখানে রিয়াজ মতিউর রহমানের চরিত্রে এবং তারিন ওনার স্ত্রী মিলির চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। এছাড়া তাঁর জীবনী নিয়ে ২০০৭ সালে অস্তিত্বে আমার দেশ চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয়। বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর যশোর বিমান ঘাটি তারঁ নামে নামকরণ করা হয়েছে। বিমান বাহিনী তাঁর নামে একটি ট্রফি চালু করেছে। বিমান প্রশিক্ষনে সেরা কৃতিত্ব প্রদর্শনকারীকে এটি প্রদান করা হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চলচ্চিত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক থাকা অবস্থায় আমি মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র প্রদশর্নীত নিয়ে এসেছিলাম বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের স্ত্রী মিলি রহমানকে। তিনি তখন জানিয়েছিলেন, মতিউর রহমান শহীদ হবার পর পাকিস্তানিরা তাঁকে এক অন্ধকার কক্ষে তাঁর শিশু বাচ্চাসহ বন্দী করে রাখে। মতিউর রহমানকে নিয়ে তিনি সবসময় গর্ব করতেন। বলতেন, এমন জীবনদাণের মধ্যেই মতিউর আসল সুখ খুঁজে পেয়েছিলেন। দেশপ্রেম যার ভেতরে তার তো এমনি হওয়ার কথা। এমন সাহসী সন্তানরা ছিলে বলেই না বাংলাদেশ আজ স্বাধীন। তাদের কারণেই তো আমি স্বাধীন বাংলায় রোজ সকালে বলতে পারি, শুভ সকাল বাংলাদেশ। স্যালুট বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান। স্যালুট বাংলাদেশ।