শরিফুল হাসান
শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানের দিকে তাকান। রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর অতি নিয়ন্ত্রণ থাকলে কী হয় দেখুন পাকিস্তানে। দেশটির ৭৫ বছরের ইতিহাসে কোনো প্রধানমন্ত্রী তাঁর পাঁচ বছরের মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেননি। পাকিস্তানের দুরাবস্থা এই বার্তাই দেয় যে রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ অন্য কারো হাতে যাওয়া উচিত নয়।
অন্যদিকে শ্রীলঙ্কায় দেখুন। এক দশক আগেও শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি ফুলে-ফেঁপে উঠছিল। আসছিল বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার। হচ্ছিল বড় বড় প্রকল্প। সড়কে দেখা মিলছিল চকচকে সব গাড়ির। কিন্তু মেগা সব প্রজেক্ট, চীনের ঋণের ফাঁদ, আর ক্ষমতাসীনদের দুর্নীতির কারণে মাত্র এক দশকে শ্রীলঙ্কার চরম দুরাবস্থা চলছে।
ফলাফল, সড়কে এখন বাতি জ্বলছে না, গাড়িতে নেই জ্বালানি, কাগজের অভাবে পরীক্ষা বন্ধ। দ্রব্যমূল্য আকাশচুম্বী। সাধারণ মানুষ বিক্ষুব্ধ। প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষের বাড়িতে বিক্ষোভকারীরা ঢোকার চেষ্টা করেছেন। তাঁরা রাজাপক্ষে ও ক্ষমতায় থাকা তাঁর পরিবারের সদস্যদের পদত্যাগ দাবি করেছেন। বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে নিরাপত্তাকর্মীদের নিয়মিত সংঘর্ষ চলছে। চলছে জরুরী অবস্থা।
শ্রীলঙ্কার এই অবস্থা দেখে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। এবার দক্ষিণ এশিয়ার বাকি দেশগুলোর দিকে তাকান। ভারতে বিজেপির উত্থান ও শক্ত অবস্থান দেশটির ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের চরিত্র বদলে ফেলার আশঙ্কা তৈরি করছে। আফগানিস্তানে তালেবানদের উত্থান, মালদ্বীপ কিংবা নেপালের রাজনৈতিক সংকট এসবই আমরা চোখের সামনে দেখছি।
এই প্রতিটা ঘটনা থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে। সতর্ক থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে উদার গণতন্ত্রের বাইরে ধর্মীয় বা যে কোন উগ্রবাদ, সামরিকতন্ত্র বা অন্য কোনো ব্যবস্থাই কোন দেশের জন্য সুফল আনেনি। আমাদের মনে রাখতে হবে, দক্ষিণ এশিয়ার আর কোন দেশ মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে স্বাধীন হয়নি।
দেখেন, বাংলাদেশই দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র দেশ যারা নয় মাসের যুদ্ধ করে ত্রিশ লাখ শহীদের জীবনের বিনিময়ে স্বাধীন হয়েছে। একাত্তরে যে স্বপ্নে আমাদের এই মুক্তিযুদ্ধ আমরা যেন সেই স্বপ্ন থেকে সরে না যাই। আমার আজকাল প্রায়ই ভয় লাগে। মনে হয় আমরা আমাদের আদর্শ থেকে ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছি।
শেষে ভুটানে যাই। দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় সবগুলো দেশেই অমার যাওয়ার সুযোগ হয়েছে। আমার কেন জানি ছোট্ট দেশ ভুটানকে খুব ভালো লাগে। ভুটান একমাত্র দেশ, যারা মোট দেশজ উৎপাদন দিয়ে দেশের সফলতা পরিমাপ না করে মোট জাতীয় সুখ দিয়ে তা পরিমাপ করে থাকে। ভুটানের ‘সুখের মডেল’ এখন অনুসরণ করছে জাতিসংঘ।
ভুটানে সপ্তাহখানেক থেকে আমার ভীষণ ভালো লেগেছে। ভুটানের মানুষের কাছে মানসিক প্রশান্তি অত্যন্ত জরুরি৷ শিক্ষা, সহমর্মিতা, সহনশীলতা, সবার সঙ্গে সখ্যতা, আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, সুস্বাস্থ্য এসব বিষয়ের ওপর জোর দিয়ে থাকে ভুটানের মানুষরা৷
নাগরিকবান্ধব রাষ্ট্র হয়ে ওঠার লক্ষ্য নিয়ে ১৯৭২ সালে প্রথমবারের মতো নাগরিকের সুখের দিকে লক্ষ রাখা শুরু করে ভুটান। ভুটানের চতুর্থ রাজা জিগমে সিংয়ে ওয়াংচুক প্রথমবারের মতো ‘জাতীয় সুখ সূচক’-এর প্রস্তাব তোলেন। ভুটানের এই সূচক এখন এতই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে যে, মানুষের সুখের দিকে নজর রেখে জাতিসংঘে একটি অর্থনীতি মডেল পাস হয়।
আচ্ছা এই যে ভুটান সবার আগে নাগরিকদের মর্যাদা দিচ্ছে, নাগরিকদের সুখের কথা ভাবছে আমরাও কী সেভাবে আমাদের নাগরিকদের মর্যাদা দিতে পারি না? দিনশেষে মানুষই তো সব! অথচ সেই আমরা মানুষকে ভীষণ অবহেলা করি। তাদের দুর্ভোগকে গুরুত্ব দেই না। আমি খুব করে চাই বাংলাদেশটা একটা সুন্দর মানবিক দেশ হয়ে উঠবে। কিন্তু কবে সেটা হবে?