শরিফুল হাসান
বাংলাদেশ থেকে হাজার কোটির বেশি টাকা আত্মসাৎ করে পালিয়ে যাওয়া পি কে হালদারকে গ্রেপ্তার করেছে ভারতের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা। আর্থিক কেলেঙ্কারি, বেআইনিভাবে টাকা দেশে ঢোকানো, আইনবহির্ভূত সম্পত্তিসহ কিছু বিষয়ে তদন্ত করতে গিয়ে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট তাকে গ্রেপ্তার করে। অবশ্য আমি জানি না পি কে হালদারকে কবে কীভাবে বাংলাদেশে আনা হবে। দেশে আনলে তার কী বিচার হবে নাকি জেলখানার নামে হাসপাতালে কাটবে?
তবে আমি খুব করে চাই বাংলাদেশে প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা কী করে তিনি আত্মসাৎ করলেন, কারা তার সহযোগী ছিলেন, কাদেরকে তিনি ঘুষ দিয়েছিলেন, কাদের সহযোগিতায় বাংলাদেশ ছেড়ে ভারতে পালাতে পারলেন ইত্যাদি বিষয়গুলো যথাযথভাবে তদন্ত হোক। ভবিষ্যতে এই ধরনের অপরাধ বন্ধ করতে এগুলো খুব জরুরী। কথাগুলো বলছি, কারণ আমরা তো পাচারকারীদের দৃষ্টান্তমূলক বিচার দেখি না। বরং অনিয়ম দুর্নীতি এমন সব গল্প দেখি যা রূপকথার গল্পকেও হার মানায়। এই যে জনতা ব্যাংক থেকে অ্যাননটেক্স, ক্রিসেন্ট ও থারমেক্স গ্রুপ মিলে ১১ হাজার ২৩০ কোটি টাকা নিয়ে গিয়েছিল কী বিচার হয়েছিল? ওই যে বেসিক ব্যাংক থেকে চলে গেছে সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা তার কী হলো? এই দুর্নীতির তো শেষ নেই। সোনালী ব্যাংকের হল-মার্ক কেলেঙ্কারিতে আত্মসাৎ হয়েছে ৩ হাজার ৫৪৭ কোটি টাকা। বিসমিল্লাহ গ্রুপ নিয়েছিল ১ হাজার ১৭৪ কোটি টাকা। এনআরবি কমার্শিয়াল ও ফারমার্স ব্যাংক থেকে লোপাট হয়েছে আরও ১ হাজার ২০১ কোটি টাকা। এগুলোর বিচার কী হয়েছিল?
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের দুদিন আগে বলেছেন, যারা কোটি কোটি টাকা বিদেশে পাচার করে, তাদের চিহ্নিত করতে হবে। আমরা সেই চিহ্নিত লোকগুলোকে দেখতে চাই। কীভাবে সেটা হবে জানতে চাই। আমার মনে আছে, বছর চারেক আগে সিপিডি তাদের এক গবেষণায় বলেছিল, গত ১০ বছরে দেশ থেকে পাচার হয়েছে ৫ হাজার ৫৮৭ কোটি ৬০ লাখ ডলার। টাকার অঙ্কে যা ৪ লাখ ৪১ হাজার ৪২০ কোটি টাকা। এই অর্থ আমাদের মোট বাজেটের চেয়েও ১ লাখ কোটি টাকা বেশি।
তারা আরও বলেছিল, স্বল্পোন্নত দেশগুলোর (এলডিসি) মধ্যে অর্থ পাচার সবচেয়ে বেশি হয়েছে বাংলাদেশ থেকেই। শুনে অবাক লাগে,গত এক দশকে ধনী ব্যক্তির সংখ্যা বৃদ্ধির হারে শীর্ষে বাংলাদেশ। সুইস ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশি নাগরিকদের ব্যাংক হিসাবের সংখ্যা দ্বিগুণ বেড়েছে। ওদিকে মালয়েশিয়ায় ‘মাই সেকেন্ড হোম’ কর্মসূচিতে বাংলাদেশিরা এগিয়ে। অস্ট্রেলিয়া, কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রে বিনিয়োগ করে নাগরিকত্ব নেওয়ার সুযোগ নিচ্ছেন অসংখ্য বাংলাদেশি।
আমরা জানতে চাই, যারা বিদেশে টাকা পাচার করে, যারা বেগমপাড়ায় কিংবা মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম করে তারা কারা? সিপিডি বলেছিল,রাজনীতিবিদ, আমলা, ব্যবসায়ী—প্রায় সবার ছেলেমেয়ে বিদেশে থাকে। সন্তানদের নিরাপদ ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে তাঁরা টাকা সরানোর চেষ্টা করেন। তাঁদের মধ্যে এ দেশে বিনিয়োগ বা টাকা রাখায় কোনো আস্থা নেই। অবশ্য রাজনীতিবিদরা বেশি টাকা পাচার করে এমন প্রচলিত ধারণা থাকলেও আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী গত বছর বলেছিলেন, সরকারি চাকুরেরা বেশি টাকা পাচার করছে। আমরা জানতে চাই আসলে কারা টাকা পাচার করে।
অর্থপাচারকারীরা জাতীয় বেইমান ও দেশের শত্রু মন্তব্য করে দেশের উচ্চ আদালত গত বছরের ১৭ ডিসেম্বরের মধ্যে পাচারকারীদের একটা তালিকা দিতে বলেছে। সেই তালিকা কী হয়েছিল? সরকার ও নীতি নির্ধারকদের অনুরোধ করছি, বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারকারীদের চিহ্নিত করুন। আজ হোক কাল হোক তাদের সব সম্পদ বাজেয়াপ্ত করুন। তাদের পরিচয় জনগণের সামনে উন্মুক্ত করুন। এই পাচারকারীরা কখনো কোনো দলের বন্ধু হতে পারে না বরং এরা দেশের শত্রু। দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হলে এই অর্থ পাচারকারীদের শাস্তির আওতায় আনতেই হবে।


