জনশক্তি রপ্তানি অর্ধেকে নেমেছে!

Spread the love

শরিফুল হাসান

জনশক্তি রপ্তানি গত বছরের তুলনায় এ বছর প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। পাশাপাশি এই সময় বিদেশ থেকে শ্রমিক ফেরত এসেছেন আগের বছরের প্রায় দ্বিগুণ। সরকার বলছে, বিশ্বব্যাপী চলমান অর্থনৈতিক মন্দা এর অন্যতম কারণ। তবে একে একটি কারণ হিসেবে মানলেও জনশক্তি রপ্তানির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বাজার ধরে রাখতে সরকারের যথেষ্ট উদ্যোগের অভাব আছে। নতুন করে কোনো বাজার খোঁজার চেষ্টাও করছে না সরকার। অবশ্য শ্রম ও প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন দাবি করেছেন, শ্রমবাজার ধরে রাখা ও প্রবাসী শ্রমিকদের ব্যাপারে সরকার খুব আন্তরিক। এ ক্ষেত্রে সরকারের চেষ্টার কোনো ঘাটতি নেই। জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, এ বছরের জানুয়ারি থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত আট মাসে তিন লাখ ২৭ হাজার ৩৫৯ জন কর্মী বিদেশে গেছেন। গত বছরের একই সময়ে বিদেশ যাওয়া কর্মীর সংখ্যা ছিল ছয় লাখ ১৮ হাজার ৮০। গত বছরের তুলনায় জনশক্তি রপ্তানি প্রায় ৫০ শতাংশ কম হয়েছে। ২০০৮ সালে চাকরি নিয়ে বিদেশে যান আট লাখ ৭৫ হাজার ৫৫ জন বাংলাদেশি কর্মী। ২০০৭ সালে এ সংখ্যা ছিল আট লাখ ৩২ হাজার ৬০৯ জন। জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিসের (বায়রা) আশঙ্কা, এ বছর বিদেশে জনশক্তি পাঠানোর এ সংখ্যা চার লাখ নাও ছুঁতে পারে।সূত্র জানিয়েছে, এ বছর জনশক্তি রপ্তানি কমার পাশাপাশি ফেরত আসার সংখ্যাও বেড়েছে অনেক। গত বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত বিদেশ থেকে ফেরত এসেছিলেন ৩৭ হাজার ৫২২ জন কর্মী। এ বছর একই সময়ে ফেরত এসেছেন ৫৪ হাজার ৬৩২ জন। বছর শেষে এ সংখ্যা লাখ ছাড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কা বায়রার। বেশি কমেছে সৌদি আরব ও মালয়েশিয়ায়: ২০০৮ সালের তুলনায় এ বছর জনশক্তি রপ্তানি সবচেয়ে বেশি কমেছে সৌদি আরব ও মালয়েশিয়ায়। ২০০৮ সালে এক লাখ ৩২ হাজার ১২৪ জন শ্রমিক সৌদি আরবে গিয়েছিলেন। এ বছরের গত আট মাসে সৌদি আরবে গেছেন মাত্র ১০ হাজার ৭৭৭ জন। গত বছর মালয়েশিয়া গিয়েছিলেন এক লাখ ৩১ হাজার ৭৬২ জন বাংলাদেশি শ্রমিক। এ বছর গেছেন মাত্র ১২ হাজার ২১৩ জন। এই মুহূর্তে বাংলাদেশ থেকে নেওয়ার কোনো পরিকল্পনাও মালয়েশিয়ার নেই।২০০৮ সালে দুবাই গিয়েছিলেন চার লাখ ১৯ হাজার ৩৫৬ জন লোক। এ বছর দুবাই গেছেন এক লাখ ৭২ হাজার ৯১৭ জন। গত বছর ওমান গিয়েছিলেন ৫২ হাজার ৮৯৬ জন। এ বছর এখন পর্যন্ত গেছেন মাত্র ৩১ হাজার ৪৩৭ জন। গত বছর কাতার গিয়েছিলেন ২৫ হাজার ৫৪৮ জন। এ বছর গেছেন মাত্র আট হাজার ৮৬০ জন। জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর পরিচালক নূরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, গত বছরের তুলনায় জনশক্তি রপ্তানি কমে যাওয়ার মূল কারণ বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা। তবে সৌদি আরব আর মালয়েশিয়ার বাজার ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যাওয়াও একটি বড় ক্ষতি। মালয়েশিয়া ও সৌদি আরবের বাজার ধরতে পারলে ভবিষ্যতে রপ্তানি বাড়বে বলে তাঁর আশা। জনশক্তি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর অভিযোগ, মন্দার পাশাপাশি সফল কূটনীতিক যোগাযোগ করতে না পারাটাও বিদেশে বাংলাদেশের শ্রমবাজার সংকুচিত হওয়ার একটি কারণ। সৌদি আরব বাংলাদেশি শ্রমিকদের ইকামা (চাকরি পরিবর্তনের অনুমতিপত্র) দিচ্ছে না। তারা নতুন করে লোক নেওয়াও বন্ধ রেখেছে। বিদেশে বাংলাদেশের দূতাবাসগুলো নতুন করে বাজার সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হচ্ছে। অনেক জায়গায় বাংলাদেশ নিয়ে নেতিবাচক যে প্রচারণা আছে, সেটিও মোকাবিলা করতে পারছে না দূতাবাসগুলো। বিষয়টি নিয়ে যোগাযোগ করলে সৌদি আরবের বাংলাদেশের শ্রম কাউন্সিলর হারুন-অর-রশীদ প্রথম আলোকে বলেন, কখনো লোক আসা বাড়বে, কখনো কমবে এটাই স্বাভাবিক। তবে সৌদি আরবে দেশের বাজার বাড়ানোর জন্য তাঁরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সৌদি আরব সফরের পর সৌদি কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে ইতিবাচক সাড়া দিচ্ছে। শিগগিরই বাজার বাড়বে বলে তিনি আশা করেন। অভিযোগ, ব্যাখ্যা, সুপারিশ: তবে জনশক্তি রপ্তানিতে জড়িত ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের প্রতারণার কারণে মালয়েশিয়াসহ কোনো কোনো দেশের বাজার নষ্ট হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এ সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে গত ১৭ জুন সংবাদ সম্মেলনে বায়রার সভাপতি গোলাম মোস্তফাও তা স্বীকার করে বলেন, মালয়েশিয়ার ঘটনা বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানির ইতিহাসে একটি কলঙ্ক তিলক হয়ে থাকবে।বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জনশক্তি রপ্তানি কমে যাওয়ার আরেকটি বড় কারণ দক্ষ জনশক্তির অভাব। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দক্ষ জনশক্তির চাহিদা বাড়লেও বাংলাদেশ তা দিতে পারছে না। ১৯৭৬ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে ৬২ লাখ ৬৫ হাজার ৯০৯ জন বিদেশে গেছেন। এর মধ্যে মাত্র এক লাখ ৭৯ হাজার ৯১০ জন দক্ষ শ্রমিক।শ্রম ও প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ২০০৭ ও ২০০৮ সালের তুলনায় জনশক্তি রপ্তানি কমেছে। কিন্তু ২০০৬ সালের সঙ্গে তুলনা করলে বর্তমানের যে ধারা সেটি অস্বাভাবিক নয়। ২০০৬ সালের আগস্টে ৩৪ হাজার কর্মী বিদেশে গিয়েছিলেন। কিন্তু এই বছর আগস্টে বিদেশে গেছেন ৩৮ হাজার লোক। ২০০৬ সালে তিন লাখ ৮১ হাজার ৫১৬ জন কর্মী বিদেশে গিয়েছিলেন। এবার সেই তুলনায় জনশক্তি রপ্তানি বেশি হবে বলে তিনি মনে করেন। বায়রার সভাপতি গোলাম মোস্তফা প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশের জনশক্তির বাজার ক্রমেই সংকুচিত হচ্ছে। সরকার সেই বাজার বাড়ানোর কোনো চেষ্টা করছে না। তবে মন্দা কেটে গেলে মালয়েশিয়া ও দুবাইয়ের বাজার ঠিক হয়ে যাবে আশা করে তিনি বলেন, ‘এখন আমাদের বিকল্প বাজার খুঁজতে হবে। সেক্ষেত্রে ইরাক নতুন শ্রমবাজার হতে পারে। যুদ্ধবিধ্বস্ত এই দেশের পুনর্গঠনে অনেক শ্রমিকের চাহিদা রয়েছে। ভারত ও শ্রীলঙ্কার আগেই আমাদের এ বাজার ধরতে হবে। কিন্তু এখনো সরকারিভাবে সেখানে লোক পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়নি।’ তিনি বলেন, একবার যদি সেখানে অবৈধভাবে লোক পাঠানো শুরু হয়ে যায়, তাহলে নেতিবাচক ভাবমূর্তির কারণে সব সম্ভাবনা নষ্ট হয়ে যাবে। লিবিয়ার বাজারও ধরতে হবে। তবে এ জন্য সরকারি উদ্যোগ প্রয়োজন। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণা পরিচালক অর্থনীতিবিদ জায়েদ বখত প্রথম আলোকে বলেন, মন্দার কারণে মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশ শ্রমিক ফেরত না পাঠালেও তারা নতুন করে লোক নিচ্ছে না। ফলে শ্রমবাজার সংকুচিত হয়েছে। কিন্তু এ মুহূর্তে বৈদেশিক মুদ্রার প্রবৃদ্ধিতে এটি প্রভাব পড়েনি। তবে জনশক্তি রপ্তানি এভাবে কমে গেলে ভবিষ্যতে বৈদেশিক মুদ্রা খাতে প্রবৃদ্ধি কমে যেতে পারে। তিনি বলেন, এখন থেকে বিষয়টি নিয়ে সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে সচেতন হতে হবে। এ জন্য কূটনৈতিক যোগাযোগের মাধ্যমে পুরোনো বাজারগুলো যেমন ধরে রাখতে হবে, তেমনি নতুন বাজারও খুঁজতে হবে

Leave a Reply

Your email address will not be published.