শরিফুল হাসান

মাটির ঘর। দারিদ্র্যের চিহ্ন স্পষ্ট। সেই ঘরের সামনে মাটি চাপড়ে আহাজারি করছেন গৃহবধূ সীমা আক্তার। বারবার বলছেন, ‘আমনারা মোর স্বামীরে আইন্না দ্যান। মুই ওহন দুইডা মাছুম পোলারে লইয়া কেমনে বাঁচমু?’ মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে কাঁদছে দুই শিশুসন্তান সিফাত ও রিফাত।
মঠবাড়িয়ায় বিজিবির গুলিতে নিহত দিনমজুর বেলাল মোল্লার বাড়ির সবাই কাঁদছে। কাঁদছেন আশপাশের মানুষ।
কেবল বেলালের পরিবার নয়, কাঁদছেন কলেজছাত্র সোলায়মান তালুকদারের বাবা-মা, চাকরিজীবী সোহেল মাতুব্বরের মা-শিশুকন্যা, অটোরিকশাচালক জয়নবের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী, শাহাদাত হোসেনের দুই ছেলে, মা-বোন সবাই।
স্বজনহারাদের কান্না যেন ছড়িয়ে পড়ছে গ্রাম থেকে গ্রামে। একটাই প্রশ্ন—মঠবাড়িয়ায় মানুষের ওপর কেন গুলি চালানো হলো পাখির মতো?
মঙ্গলবার রাতে সাফা ডিগ্রি কলেজে নির্বাচনী সহিংসতায় এই ৫ জন মারা যান। আহত হন ২০-২৫ জন। গতকাল বিকেলে লাশ বুঝে পাওয়ার পর সন্ধ্যায় তাঁদের দাফন সম্পন্ন হয়েছে।
আওয়ামী লীগ নেতা ও স্থানীয় মানুষের অভিযোগ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বাড়াবাড়িতেই এ ঘটনা ঘটেছে। এখানকার স্বতন্ত্র প্রার্থী রফিকুল ইসলামের পক্ষে কাজ করেছে প্রশাসন। নইলে পরিস্থিতি অন্যভাবেও সামাল দেওয়া যেত। তবে নির্বাচন কর্মকর্তা ও প্রশাসন বলছে, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্যই বাধ্য হয়ে গুলি ছুড়তে হয়েছে।
উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি পৌর মেয়র রফিউদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘বয়স ৬০ হতে চলল। নির্বাচন নিয়ে এমন সহিংসতা দেখিনি। এভাবে জনতার মিছিলে গুলি চালানো যায় না। শান্তিপূর্ণ অবরোধ ছিল। কাঁদানে গ্যাসের শেল মেরে, অতিরিক্ত র্যা ব-পুলিশ এনে পরিস্থিতি শান্ত করা যেত। কিন্তু গুলি করে গাড়িচাপা দিয়ে যাওয়া তো নৃশংসতা। এর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।’
পিরোজপুরের পুলিশ সুপার মো. ওয়ালিদ হোসেন গতকাল দুপুরে প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঘটনা তদন্তে জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবু আশ্রাফকে প্রধান করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি হয়েছে। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মানিকহার রহমানকে প্রধান করে প্রশাসনও একটি কমিটি করেছে। প্রতিবেদনের পরেই বোঝা যাবে, কার কী ভূমিকা ছিল।
ক্ষুব্ধ মানুষ, স্বজনহারাদের আহাজারি: গতকাল সকাল ১০টা। সাফা ডিগ্রি কলেজের মূল ফটকের সামনে মানুষের ভিড়। কী ঘটনা ঘটেছে জানতে চাইলে লোকজন বলেন, এই যে দেখেন, মাটিতে এখনো রক্ত লেগে আছে।
কেবল যে মাটিই রক্তাক্ত হয়েছে এমন নয়, কলেজের মূল ফটকের সামনের কয়েকটি দোকানের টিনেও দেখা গেল অসংখ্য গুলির চিহ্ন। দোকানের পেছনে কাদামাটিতেও লেগে আছে রক্ত।
দোকানের সামনেই কথা হয় বৃদ্ধ কৃষক মোফাজ্জল করিমের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘এভাবে গুলি করে মানুষ মারার বিচার হওয়া উচিত।’
সাফা ডিগ্রি কলেজ থেকে দক্ষিণে গেলেই বুড়িচর গ্রাম। মঙ্গলবারের ঘটনায় নিহত হয়েছেন এই গ্রামেরই তিনজন। এঁদেরই একজন বেলাল মোল্লা। পেশায় দিনমজুর। বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল, বেলালের স্ত্রী সীমা আক্তার উঠান চাপড়ে আহাজারি করছেন, আর বলছেন, ‘মুই ওহন দুইডা মাছুম পোলারে লইয়া কেমনে বাঁচমু?’
বেলালের বাড়ি থেকে কয়েক শ মিটার দূরেই সোলায়মান তালুকদারের বাড়ি। খুলনার মহসিন কলেজ থেকে এবার ডিগ্রি পরীক্ষা দিয়েছিলেন সোলায়মান। ছুটিতে বাড়ি এসেছিলেন ভোট দিতে। কিন্তু সেই ছুটিই চিরকালের ছুটি হয়ে গেছে। সোলায়মানের মা রহিমা বেগম ছেলের প্রবেশপত্র দেখিয়ে আহাজারি করতে করতে বলেন, ‘বাবা রে, আমি এখন কেমনে বাঁচমু?’
বেলালের বাড়ির কাছেই সোহেল মাতুব্বরের বাড়ি। পরস্পর তাঁরা আত্মীয়। সোহেলের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল তাঁর মা, দুই সন্তান—সবাই আহাজারি করছেন। সেখানেই কথা হলো ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী তরিকুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘সোহেল আর আমিই একসঙ্গেই ছিলাম। বিজিবির দুইটা গাড়ি ছিল। তারা গুলি করতে করতে আসছিল। আমার কানের পাশ দিয়ে গুলি গিয়ে লাগলো সোহেলের…।’ কথা শেষ করার আগেই কেঁদে ওঠেন তরিকুল।
বুড়িচর গ্রাম থেকে পোনা নদী পেরোলেই ভান্ডারিয়া উপজেলার হরিণপালা গ্রাম। এই গ্রামেরই ব্যাটারিচালিত রিকশাচালক কামরুল ইসলাম মৃধা মঙ্গলবারের গুলিতে নিহত হয়েছেন। বছর খানেক আগে বিয়ে করেন কামরুল। অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী বৃষ্টি কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘বিকেল পাঁচটার সময় বাড়ি থেকে গেল। বলল অটো নিয়ে বের হচ্ছে। আর এল না।’ কামরুলের মা খাদিজা বেগম বলেন, ‘আমি পোলা হত্যার বিচার চাই।’
একই গ্রামের শাহাদাত হোসেন চাকরি করতেন ঢাকায়। তাঁর ছোট ছেলে মুন্না বলেন, ‘আব্বা বলল, সাফা কেন্দ্রে ঝামেলা হচ্ছে। তাঁর ভাইপো নাকি আটকা পড়ছে। সেই যে গেল, ফিরল লাশ হয়ে। ১৪ বছরের এই কিশোর কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘আমি একা একা থানায় গিয়েছিলাম সকালে। থানার মধ্যে আব্বার লাশ ছিল। আমি দেখে আসছি।’
কেন এমন সহিংসতা?: আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী ও স্থানীয় ব্যক্তিরা জানালেন, ধানীসাফা ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ফারুক মিয়া এবারও দলের মনোনয়ন চেয়েছিলেন। তিনি উপজেলা চেয়ারম্যান আশরাফুর রহমানের ঘনিষ্ঠ। কিন্তু এখানে উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতারা মনোনয়ন দেন ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হারুন অর-রশিদকে। এ ছাড়া এখানে স্বতন্ত্র প্রার্থী ছিলেন সাফা কলেজের শিক্ষক রফিকুল ইসলাম। তাঁর এক ভাই কোটিপতি। আরেক চাচাতো ভাই প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা।
উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেল, এই ইউনিয়নের নয়টি কেন্দ্রের মধ্যে পাতাকাটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভোট গ্রহণ স্থগিত হয়ে যায়। বাকি আটটি কেন্দ্রের মধ্যে সাফা মহাবিদ্যালয় বাদে সাতটিতে রফিকুল ৩ হাজার ৮৫১ ভোট পান। আর হারুন পান ৩ হাজার ৬০৭ ভোট। কিন্তু সাফা কলেজ কেন্দ্রে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর ৭৪৬ ভোট বাতিল করা হয়। এখানে হারুন পান ৪৩৮ ভোট আর রফিকুল পান ৩২২ ভোট। হারুনের নেতা-কর্মীদের দাবি, এই ৭৪৬ ভোট বাতিল না করলেই তিনি জিতে যাবেন। কিন্তু প্রিসাইডিং কর্মকর্তা এই ভোট বাতিল করে ঘোষিত ফল নিয়ে চলে যেতে চান। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা এ সময় রাস্তা অবরোধ করলে ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দেশে বিজিবি গুলি ছোড়ে।
আওয়ামী লীগের প্রার্থী হারুন অর রশিদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রশাসন ষড়যন্ত্র করে আমার ৭৪৬ ভোট বাতিল করে। তারা বলে, ব্যালটে সিল থাকলেও স্বাক্ষর নাই। আসলে তারা ইচ্ছে করে স্বাক্ষর দেয় নাই। আমার নেতা-কর্মীরা এই ভোট বাতিলের জন্য শান্তিপূর্ণ অবরোধ করলে গুলি চালায় বিজিবি। মূলত প্রশাসনের নির্দেশেই গুলি চালানো হয়েছে।’
গুলির ঘটনাকে দুঃখজনক উল্লেখ করে স্বতন্ত্র প্রার্থী রফিকুল ইসলাম গতকাল সন্ধ্যায় এই পরিস্থিতির জন্য আওয়ামী লীগের প্রার্থীকেই দায়ী করেন।
ঘটনাস্থলে দায়িত্ব পালন করা নির্বাহী হাকিম কাজী জিয়াউল বাছেত প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা ফল ঘোষণা করে চলে যেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু কেন্দ্রের আশপাশে অন্তত ছয়-সাত শ লোক ছিল। তাদের অনেকের হাতেই দেশি অস্ত্র ছিল। তারা আমাদের মেরে ফেলত। প্রথমে ফাঁকা গুলি ছোড়া হলেও লাভ হয়নি। আমরা অতিরিক্ত ফোর্স চেয়েছিলাম। তারা আসতে পারেনি। বাধ্য হয়েই ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে গুলি চালানোর নির্দেশ দিতে হয়েছে।’
পুলিশের বরিশাল বিভাগের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) হুমায়ুন কবির গতকাল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ঘটনা যে পর্যায়ে গিয়েছিল, তাতে হয়তো গুলি করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ঘটনা এই পর্যন্ত আসার আগেই সামলানো যেত বলে আমার মনে হয়েছে। তবে ঘটনা তদন্তে কমিটি হয়েছে। তারা প্রতিবেদন দিলেই অনেক কিছু পরিষ্কার হবে।’