শরিফুল হাসান
হৃদয় এবং মস্তিষ্কের মধ্যে যখন দ্বন্দ্ব জাগে, তখন তুমি হৃদয়কেই গ্রহণ করো। বুদ্ধিমান মানুষের চেয়ে হৃদয়বান মানুষ অনেক শ্রেয়। বুদ্ধিমান বুদ্ধি দিয়ে ভালোও করতে পারে, মন্দও করতে পারে। কিন্তু হৃদয়বান মানবিক মানুষ কেবল ভালোই করবে।
দার্শনিক নরেন্দ্রনাথ দত্তের এই কথাগুলো আগেও লিখেছি। যাদের কাছে নামটা অপিরিচত লাগছে তাদের বলি কথাটা হিন্দু ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠাতা স্বামী বিবেকানন্দের নাম নিশ্চয়ই জানেন। তাঁরই আসল নাম নরেন্দ্রনাথ দত্ত। তবে স্বামী বিবেকানন্দ নামেই তিনি সবার কাছে পরিচিত।
আধুনিক কালের ধর্ম-সংস্কৃতি এবং পরোক্ষভাবে ভারতীয়দের জাতীয় আত্মচেতনার রূপ দিতে সাহায্য করেছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ। তাঁর স্বদেশ সেবামূলক আবেদনে ভারতের আদর্শবাদী যুবসমাজ অনুপ্রাণিত হয়েছিল, দেশের স্বাধীনতার জন্য তারা মৃত্যুবরণ করতেও অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়েছিল।
যে কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম সেই হৃদয়রবান মানুষের আলোচনায় ফিরি। স্বামী বিবেকানন্দের বারবার বলতেন, মানুষের সেবা করা হচ্ছে ঈশ্বরের সেবা করা। দেখবেন সব ধর্মের মূল কথা এই মানুষ। ইসলামে তো আল্লাহতায়ালা বান্দার হক বা মানুষের হককে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে মানুষকে কষ্ট না দিতে বলেছেন। মানুষের জন্য মানুষকে করতে বলেছেন।
আমার জীবনের দর্শনও তাই। নিজেকে আমি কখনো বুদ্ধিমান মানুষ হিসেবে ভাবিনি। বরং সবসময় সবকিছুর আগে মানবতা বা মানুষকে প্রাধান্য দিয়েছি। ধর্ম, রাজনীতি এ সবকিছু থেকেও আমার কাছে মানুষ বড়। আমার মনে হয়, মানুষের জন্য করতে গেলে মস্তিষ্কের চেয়ে হৃদয়েরই বেশি দরকার পড়ে। অপনি যদি বুদ্ধি দিয়ে প্রতিদিন চলেন দেখবেন মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারবেন না।
উদাহরণ দিয়ে বোঝাই। আপনার কাছে কেউ একজন বিপদে পড়ে টাকা ধার চেয়েছে। আপনার বুদ্ধিমান মস্তিষ্ক বলবে, এই লোককে টাকা ধার দিলে টাকা ফেরত পাওয়া যাবে না। কিন্তু আপনার হৃদয়টা যদি ভালো হয় তবে শুনবেন সে বলছে, ফেরত না দিক, দিয়ে দাও যদি লোকটার কোন কাজে আসে। তাতে না হয় তোমার একটু ক্ষতিই হলো। এক জীবনে বারবারই আমি ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। তবুও আমি হৃদয়ের কথা শুনি। একইভাবে বুঝি অনেক কিছু লিখলে বিপদ। কিন্তু হৃদয় বলে প্রতিবাদটা করতে হবে।
জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে একই কথা প্রযোজ্য। যারা মস্তিষ্ক দিয়ে চলে তারা খুব দ্রুত টাকা পয়সা করা, বাড়ি গাড়ি করা কিংবা বৈষয়িকভাবে হয়তো সফল হতে পারে। আর যারা হদেয়ের কথা শুনে তাদের অনেকের পরিনতিই হয় উল্টো। তবে ওই যে শুরুতেই বলেছি বুদ্ধিমান বুদ্ধি দিয়ে ভালোও করতে পারে, মন্দও করতে পারে, কিন্তু হৃদয়বান কেবল ভালোই করবে।
আমাদের এই বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থাটা হলো বুদ্ধিমান ও স্বার্থপর মানুষের সংখ্যা বেশি। আমরা হৃদয়ের চেয়ে মস্তিষ্কের কথা বেশি শুনি। সবাই নিজের স্বার্থ নিয়ে ব্যস্ত। সারা দুনিয়ারও হয়তো একই চিত্র। কিন্তু আমি সবসময় হৃদয়বান মানুষদের একটা পৃথিবীর স্বপ্ন দেখি যেখানে মানুষ সবসময় তাদের হৃদয় দিয়ে মানুষের মঙ্গল করবে। সে কারণেই গত কয়েক বছর ধরে কথাগুলো লিখছি।
একই সঙ্গে নিজেকে বলি, হৃদয় এবং মস্তিষ্কের মধ্যে যখন দ্বন্দ্ব জাগে, তখন তুমি হৃদয়কেই গ্রহণ করো। কারণ বুদ্ধিমান মানুষের চেয়ে হৃদয়বান মানুষ অনেক শ্রেয়। বুদ্ধিমান বুদ্ধি দিয়ে ভালোও করতে পারে, মন্দও করতে পারে, কিন্তু হৃদয়বান কেবল ভালোই করবে।
সবাইকে শুভ সকাল। সকলের মঙ্গল হোক। হৃদয়বান মানুষের সংখ্যা বাড়ুক। মানবিক বাংলাদেশ ও একটি মানবিক সুন্দর পৃথিবী গড়ে উঠুক যেখানে যুদ্ধ থাকবে না, হানাহানি থাকবে না, দুর্নীতি থাকবে না, দুঃশাসন থাকবে না। থাকবে শুধু ভালোবাসা আর মানবতা।