শরিফুল হাসান
সৌদি আরবের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে বিপুলসংখ্যক জনশক্তির প্রয়োজন হচ্ছে। কিন্তু বিদেশি শ্রমিকদের কাজ করার বৈধ অনুমতিপত্র বা ইকামা সমস্যা এ কাজে বিঘ্ন ঘটাচ্ছে। তাই গত ২০ এপ্রিল সে দেশের সরকার আইন পাস করে শ্রমিকদের আলোচনার মাধ্যমে ইকামা পরিবর্তনের সুযোগ দিয়েছে। পাকিস্তান, ভারত, শ্রীলঙ্কাসহ সব দেশের শ্রমিকেরাই নতুন আইনের আওতায় ইকামা পরিবর্তনের সুযোগ পাচ্ছেন। কিন্তু বাংলাদেশ এ সুযোগ থেকে বঞ্চিত।সৌদি আরবে কর্মরত আছেন ১৫ লাখের বেশি বাংলাদেশি। তাঁরা সবাই এই ইকামা সমস্যায় ভুগছেন। এর মধ্যে গড়ে প্রায় ৫০ হাজার শ্রমিক অন্য মালিকের কাছে ইকামা আটকে থাকায় অবৈধভাবে কাজ করেন। এর মধ্যে প্রায় ১০ হাজার শ্রমিককে প্রতিবছর পুলিশের হাতে ধরা পড়ে দেশে ফেরত আসতে হয়। গত এপ্রিলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে উচ্চপর্যায়ের সরকারি দলের সৌদি আরব সফরের পর বলা হয়েছিল, খুব শিগগির বাংলাদেশিরা ইকামা পরিবর্তনের সুযোগ পাবেন। কিন্তু সাড়ে তিন মাস পেরিয়ে গেলেও সেই সুযোগ পাননি বাংলাদেশি শ্রমিকেরা। বাংলাদেশ সুযোগ না পাওয়ার কারণ: সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশি পাসপোর্টধারী কিছুসংখ্যক শ্রমিকের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থার জন্য দায়ী। কয়েক বছর ধরে সৌদি আরবের অপরাধ তালিকায় বাংলাদেশিদের নাম ওপরের দিকে ঠাঁই পাচ্ছে। গত দুই বছরে অন্তত আটজন বাংলাদেশিকে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড দেওয়া ও কার্যকর করা হয়েছে। জানা গেছে, ধর্ষণ, ডাকাতিসহ নানা অপরাধে সৌদি আরবে প্রতিবছর গড়ে এক শ থেকে দেড় শ লোককে শিরশ্ছেদ করা হয়। এ তালিকায় বাংলাদেশিদের নামও থাকছে। অনৈতিক কাজের অভিযোগে ২০০৭ সালের অক্টোবরে বাংলাদেশি পাসপোর্টধারী আব্দুর রহমান, আব্দুর রশিদ ও নাউন জোলিকে ফাঁসি দেওয়া হয়। সর্বশেষ গত শনিবার জামান হুসেইন জালালউদ্দিন নামের একজনের ফাঁসি হয়েছে। প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে অবৈধভাবে থাকা রোহিঙ্গাদের একটা অংশ বাংলাদেশি পাসপোর্ট ব্যবহার করে বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমাচ্ছে। এ ধরনের লোকেরা কোনো অপরাধে জড়ালে বাংলাদেশের বদনাম হচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে সৌদি আরব-প্রবাসী ও জনশক্তি রপ্তানিকারক আরিফুর রহমান বলেন, ১৯৯১ সাল পর্যন্ত নিষ্ঠাবান, সত্, কর্মঠ ও নিরীহ হিসেবেই সৌদি আরবে বাংলাদেশিদের সবাই জানত। কিন্তু বিভিন্ন সময় বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে অনেক সন্ত্রাসী ওমরাহ পালনের নামে এখানে এসে থেকে যায় এবং নানা অপরাধে জড়িয়ে বাংলাদেশের সুনাম নষ্ট করছে। আরেক প্রবাসী এবং সেখানকার একটি টেলিকম প্রকল্পের ব্যবস্থাপক ফকরুল বাশার প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভিসা কেনাবেচা, অবৈধভাবে লোক সরবরাহ, অসামাজিক কার্যক্রম, চুরি, আঞ্চলিক সমিতিগুলোর সমর্থকদের প্রকাশ্যে তলোয়ার, রামদার মতো অস্ত্র নিয়ে মারামারি বাংলাদেশিদের নেতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরির জন্য দায়ী। সৌদি একটি বেসরকারি কোম্পানির মানবসম্পদ ব্যবস্থাপক ও সেখানকার নাগরিক আলী আল শেরি ই-মেইলে প্রথম আলোকে জানান, কয়েক বছর ধরেই বাংলাদেশিদের সম্পর্কে খারাপ ধারণা পোষণ করছে সৌদিরা। তাই তারা বাঙালিদের সমস্যাগুলো শুনতে চায় না। যেভাবে ইকামা অবৈধ হয়: কুমিল্লার মোহাম্মদ শামীম তিন বছর আগে দুই লাখ টাকা খরচ করে সৌদি আরবে গেছেন। বলা হয়েছিল, নির্মাণপ্রতিষ্ঠানে চাকরি, বেতন ভালো। ছয় মাস তিনি সেখানে কাজ করেছেন; কোনো বেতন পাননি। বাধ্য হয়ে তিনি অন্য প্রতিষ্ঠানে কাজ নেন। কিন্তু তাঁর কাজ করার বৈধ অনুমতিপত্র বা ইকামা রয়ে গেছে আগের মালিকের কাছে। ফলে তিনি এখন অবৈধ শ্রমিক এবং পালিয়ে থাকছেন পুলিশের ভয়ে। এ ছাড়া একশ্রেণীর দালাল থাকে, যারা বিভিন্ন কোম্পানির জন্য লোক খুঁজতে থাকে। তাদের কাজ, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে লোক ভাগিয়ে নেওয়া। তাদের কথায়ও অনেকে চাকরি ছেড়ে দেন। কিন্তু ইকামা ছাড়া প্রবাসীদের রাস্তায় চলাচল করা কঠিন। শ্রমিকেরা কাজ করতে বের হলে পুলিশ রাস্তায় আটকে ইকামা দেখতে চায়। ফলে যাঁদের ইকামা থাকে না তাঁদের পালিয়ে কাজে যোগ দিতে হয়। আবুল কালাম নামের এক শ্রমিক বলেন, ‘ইকামা নেই বলে মালিকেরা আমাদের সঙ্গে যাচ্ছে তাই ব্যবহার করেন। প্রায়ই বেতন কেটে রাখেন। কিছু বললে পুলিশে ধরিয়ে দেওয়ার ভয় দেখান।’ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বক্তব্য: সৌদি আরবে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত আব্দুল মোমেন চৌধুরী বলেন, খুব কমসংখ্যক বাঙালি অপরাধ করে। কিন্তু এ জন্য সবাইকে সমস্যায় পড়তে হয়। আর দূতাবাস বেশির ভাগ সময়েই এসব মোকাবিলায় ব্যর্থ হয়। তিনি বলেন, ভালো আরবি জানেন এমন কাউকে দূতাবাসে পাঠানো উচিৎ। জনশক্তি রপ্তানিকার প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন বায়রার সভাপতি গোলাম মোস্তফা বলেন, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাজার সৌদি আরব। সেই বাজার কোনোভাবেই হারানো চলবে না। তিনি জানান, পররাষ্ট্রমন্ত্রী তাঁকে আশ্বস্ত করে বলেছেন, এ সমস্যা সামাধানে বাংলাদেশ সব ধরনের চেষ্টা চালিয়ে যাবে। সৌদি আরবে বাংলাদেশের শ্রম উপদেষ্টা হারুন অর রশিদ প্রথম আলোকে বলেন, ইকামার বিষয়টি নিয়ে আগামী সপ্তাহে সৌদি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দূতাবাসের বৈঠক আছে। আশা করা যায়, ইতিবাচক কিছু হবে। বিষয়টি নিয়ে সম্প্রতি একটি সেমিনারে পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনির দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, এপ্রিল মাসে সৌদি বাদশাহসহ সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে তাঁরা কথা বলেছেন। বাংলাদেশি শ্রমিকেরা দ্রুত ইকামা পরিবর্তনের সুযোগ পাবেন—সৌদি সরকার সে সময় তাঁদের আশ্বাস দিয়েছিল। এ বিষয়ে তাঁর মন্ত্রণালয় এখনো যোগাযোগ চালিয়ে যাচ্ছে।