শরিফুল হাসান
বিভিন্ন পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের অধিকাংশই সরকারি কর্মকর্তা বা কর্মচারী। এ রকম ছয়-সাতজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও ১৫-২০ জন কর্মচারীর নাম পেয়েছে পুলিশ। এদের হয়ে পরীক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য রয়েছে আরেকটি চক্র। রংপুর ও ঢাকায় এই চক্রের সাত সদস্য গ্রেপ্তার হয়েছেন। পুলিশ ও গোয়েন্দা সূত্র জানিয়েছে, ২০০৩ সালের পর যতগুলো পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে, তার সঙ্গে এই চক্রের যোগাযোগ আছে বলে তথ্য-প্রমাণ মিলেছে।প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা তদন্ত করছেন পুলিশের বিশেষ শাখার একজন কর্মকর্তা। গতকাল মঙ্গলবার তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সরকারি কর্মকমিশনের (পিএসসি) পরিচালক, উপপরিচালক ও সহকারী পরিচালক পদমর্যাদার ছয় থেকে সাতজন কর্মকর্তা বিভিন্ন সময় প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় নেতৃত্ব দেন বলে তাঁরা তথ্য পেয়েছেন। সরকারি ছাপাখানা বিজি প্রেসের আট থেকে ১০ জন কর্মচারী আছেন, যাঁদের কাজ গোপনীয় শাখা থেকে প্রশ্ন বের করে আনা। প্রশ্নসহ বেরিয়ে যেতে তাঁদের সহায়তা করেন কয়েকজন নিরাপত্তাকর্মী। প্রশ্নপত্র ফাঁসের চক্রের সঙ্গে শিক্ষা অধিদপ্তর ও সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারীও যুক্ত। গ্রেপ্তার হওয়া কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কয়েকজন রংপুরে পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে এই চক্রের বেশির ভাগ সদস্যের নাম বলেছেন। তাঁদের গ্রেপ্তার করা হবে বলে পুলিশ জানিয়েছে।রংপুরের পুলিশ সুপার সালেহ মোহাম্মদ তানভীর প্রথম আলোকে বলেন, এই চক্রটিকে গ্রেপ্তারের মাধ্যমে শুধু যে এবারকার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা বের হয়েছে তা নয়, অতীতে এ ধরনের অপরাধ কারা করেছে, সেটিও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ইতিমধ্যে উচ্চপর্যায়ের কয়েকজন কর্মকর্তার জড়িত থাকার সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে। ২০০৩ সাল থেকে তাঁরা প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত। পুলিশ শিগগিরই তাঁদের গ্রেপ্তারে অভিযানে নামবে। তবে তদন্তের স্বার্থে কারও নাম প্রকাশ করা সম্ভব নয়। মহানগর পুলিশের তেজগাঁও অঞ্চলের উপকমিশনার চৌধুরী মঞ্জুরুল কবিরও প্রথম আলোকে একই কথা বলেছেন। তিনি বলেন, এ ঘটনার সঙ্গে আরও অনেকেই জড়িত বলে পুলিশের কাছে সুনির্দিষ্ট তথ্য আছে।পুলিশের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, এর আগে বিভিন্ন সময় পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হলেও নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়া শুরু হয় ২০০৩ সাল থেকে। ২০০২ সালের ১০ সেপ্টেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মাহফুজুর রহমান পিএসসির সদস্য হিসেবে যোগ দেন। এর পর থেকে তাঁর সহায়তায় চক্রটি প্রশ্নপত্র ফাঁস করার কাজ শুরু করে। গত সাত বছরে চক্রটি শতাধিক নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করে। এ সময় ৩৫ থেকে ৪০ কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে। অধিকাংশ প্রশ্নপত্রই ফাঁস হয়েছে বিজি প্রেসের কর্মচারীদের সহায়তায়।এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিজি প্রেসের উপপরিচালক মজিবুর রহমান বলেন, পুলিশ ঘটনার তদন্ত করছে। প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে কোন কোন কর্মকর্তা-কর্মচারী জড়িত, সেটি তারাই তদন্ত করে বের করতে পারবে। তবে এবার বিজি প্রেসের গোপনীয় শাখার ত্রুটিগুলো চিহ্নিত করার চেষ্টা চলছে। এ ছাড়া প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনার পর থেকে কয়েকজন কর্মচারী অফিসে আসছেন না। এঁদের একজন শহীদুল ইসলাম ফকির আজ বুধবারের মধ্যে কাজে যোগ না দিলে তাঁকে সাময়িক বরখাস্ত করা হবে। মজিবুর রহমান বলেন, বিভিন্ন মাধ্যমে তাঁরা জানতে পেরেছেন, প্যান্টের বেল্টের নিচের অংশের সেলাই খুলে সেখানে প্রশ্ন ঢুকিয়ে তা বের করে আনতেন কয়েকজন কর্মচারী। কিন্তু গোপনীয় শাখা থেকে বের হওয়ার সময় প্রত্যেকের পায়ের নখ থেকে চুল পর্যন্ত তল্লাশি করার কথা। সেটি ঠিকমতো হয়ে থাকলে প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিষয়টি অবশ্যই ধরা পড়ার কথা। বিজি প্রেসের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত কর্মচারীরা বরাবরই কাজ শেষে অনেক দেরিতে বের হতেন। এঁদের সহায়তাকারী ছিলেন বিজি প্রেসের কয়েকজন নিরাপত্তাকর্মী।বিজি প্রেসের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে জানান, প্রশ্নপত্র ফাঁস, প্রকাশ বা বিতরণের সঙ্গে জড়িত থাকার শাস্তি ন্যূনতম তিন বছর থেকে সর্বোচ্চ ১০ বছরের কারাদণ্ডসহ অর্থদণ্ড। পাবলিক পরীক্ষাসমূহ (অপরাধ) আইন, ১৯৮০ এবং সংশোধনী ১৯৯২-এর চার নম্বর ধারায় এই শাস্তির বিধান রয়েছে। কিন্তু এই আইন প্রণয়নের পর বিসিএসসহ বিভিন্ন পরীক্ষায় অন্তত ৬২ বার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা ঘটলেও শাস্তির নজির নেই। এ কারণেই বারবার অপরাধীরা পার পেয়ে যাচ্ছে।সংস্থাপন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বিভিন্ন সময় প্রশ্নপত্র ফাঁসের পর পরীক্ষা স্থগিত করে ২৯টি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। কমিটি বিভিন্ন সময় সংকট সমাধানের সুপারিশ করেছে। কিন্তু সেই সব সুপারিশ বাস্তবায়িত হয়নি।ধরন বদলেছে: গোয়েন্দা সূত্র জানিয়েছে, সাম্প্রতিক সময়ে প্রশ্নপত্র ফাঁসের ধরন বদলেছে। এখন প্রশ্নপত্র ফাঁস হলেও গণহারে সবাই পায় না। চক্রটি পরীক্ষার কয়েক দিন আগে নির্দিষ্ট প্রার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে টাকা চায়। যারা টাকা পরিশোধ করে, শুধু তাদেরই বিভিন্ন স্থানে নিয়ে গোপনে প্রশ্নপত্র ফাঁস করা হয়। গত কয়েক মাসে এই চক্রটি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) গোয়েন্দা কর্মকর্তা, সমাজসেবা কর্মকর্তা ও খাদ্য পরিদর্শকের নিয়োগ পরীক্ষাসহ বিভিন্ন পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করেছে।গোয়েন্দা সূত্র জানিয়েছে, যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত, তাঁদের কিছু আত্মীয়স্বজনই মূলত প্রার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। রংপুরে গ্রেপ্তার আতিকুল ইসলাম পিএসসির সাবেক এক সদস্যের আত্মীয়। বিজি প্রেসের কম্পোজিটর এ টি এম মোস্তফার আত্মীয় শফিউর রহমানের ব্যাংক হিসাব থেকে গতকাল ৯৫ লাখ টাকা জব্দ করা হয়েছে।অতীতের যত প্রশ্নপত্র ফাঁস: প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ নিয়ে দেশে প্রথম আলোচিত ঘটনা ঘটে ১৯৭৯ সালের এসএসসি পরীক্ষায়। তখন প্রথমবারের মতো তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়। কমিটির প্রতিবেদনে প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনার জন্য সেই সময় সাভারের সার্কেল অফিসার (উন্নয়ন), ব্যাংকের এক কর্মকর্তা এবং সাভার অধরচন্দ্র হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষককে দায়ী করা হয়েছিল। প্রশ্নপত্রের সিলমোহর করা প্যাকেট কেটে ওই বছর প্রশ্নপত্র ফাঁস করা হলেও শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক কারণে দায়ী ব্যক্তিদের কিছু হয়নি। এরপর এসএসসি পরীক্ষাতেই প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা ঘটে ’৯১ ও ’৯৭ সালে। কিন্তু কারও শাস্তি হয়নি। ’৯৯ সালের এসএসসি পরীক্ষার আগে ভোলার একটি কেন্দ্র থেকে ইংরেজি দ্বিতীয় পত্র পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় পরীক্ষা বাতিল করে গঠন করা হয় তদন্ত কমিটি। কিন্তু কারও শাস্তি হয়নি। ২০০৩ সালের পর নিয়মিতই বিভিন্ন পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হতে থাকে। ২০০৪ সালে ১৩টি সরকারি মেডিকেল কলেজে এমবিবিএস পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়। ওই বছরই দেশের অন্যতম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজে ভর্তি পরীক্ষা, কৃষি ব্লক সুপারভাইজার পরীক্ষা, ডিগ্রি পরীক্ষা, প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়। ২০০৫ সালে ফাঁস হয় ২৫তম বিবিএসের লিখিত ও ২৭তম বিসিএস পরীক্ষার প্রিলিমিনারি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র। ২০০৬ সালে ২৭তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষা ও এমবিবিএস পরীক্ষার প্রশ্নপত্রও ফাঁস হয়।২০০৭ সালে আবারও এমবিবিএস ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়। ২০০৮ সালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স পরীক্ষার প্রশ্নপত্র আবারও ফাঁস হয়। দেশব্যাপী এ ঘটনায় রাস্তায় নেমে আসেন শিক্ষার্থীরা।