শরিফুল হাসান
সরকারি ছাপাখানা বিজি প্রেসের কম্পোজিটর শহীদুল ইসলাম ফকিরকে গ্রেপ্তার করা গেলেই প্রশ্নপত্র ফাঁসের পুরো চক্রের সন্ধান মিলবে। বেরিয়ে আসবে সব তথ্য। সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের পর পুলিশ, গোয়েন্দা সংস্থা ও সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বারবারই এ কথা বলেছেন। কিন্তু ঘটনার দুই মাস পরও গ্রেপ্তার হননি তিনি।শুধু শহীদুলই নন, ওই ঘটনায় জড়িত সন্দেহে মূল অভিযুক্ত আরও চারজন এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে। তাঁরা হলেন— নীলফামারীর কিশোরগঞ্জের আতিকুল ইসলাম (যিনি ঘটনাস্থল রংপুরের ‘ভিন্ন জগত’ মিলনায়তন বুকিং দিয়েছিলেন), ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করা মোটরসাইকেলের মালিক রংপুর জেলা পরিষদের অফিস সহকারী আলাউদ্দিন, একই অফিসের সহকারী আমজাদ হোসেন ও সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা সুলতান আহমেদ।রংপুরের পুলিশ বলছে, অভিযুক্ত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। তাঁদের বাড়িতেও কয়েক দফায় পুলিশ গেছে। কিন্তু তাঁরা পলাতক, তাই গ্রেপ্তার করা যাচ্ছে না। তবে দুই মাসেও তাঁদের কেউ গ্রেপ্তার না হওয়ায় মামলার ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। পুলিশ এখনো এই মামলার অভিযোগপত্র প্রস্তুত করতে পারেনি।গত ৯ জুলাই সরকারি মাধ্যমিক স্কুলে সহকারী শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পরীক্ষার আগের দিন রংপুরে প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে যাওয়ায় পরীক্ষা স্থগিত করা হয়। প্রাথমিকভাবে এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে বিজি প্রেসের কর্মচারীসহ ১৬৭ জনকে রংপুরের অবকাশকেন্দ্র ভিন্ন জগত থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁদের মধ্যে ২৫ নারীসহ ৬৯ জন হাইকোর্ট থেকে জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। জামিন পাওয়া ৬৯ জনের মধ্যে পিএসসির প্রশাসনিক কর্মকর্তা আবদুর রউফ ও জিপি প্রেসের সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ আলীও রয়েছেন। এই মোহাম্মদ আলীর বিরুদ্ধে প্রশ্নপত্র কেনার জন্য টাকা দেওয়ার অভিযোগ ছিল। প্রশ্নপত্র ফাঁসের পর বিজি প্রেসের অফসেট শাখার ফর্মা প্রুফ প্রেসম্যান আবদুল জলিলকে আটক করা হয়। পরে তাঁর স্বীকারোক্তি অনুযায়ী বিজি প্রেসের ভেতরে রাখা তাঁর ব্যক্তিগত ট্রাংক ও আলমারি থেকে ২৮ লাখ টাকা উদ্ধার করে পুলিশ। জলিল সাংবাদিক ও পুলিশের সামনে প্রকাশ্যে বলেছিলেন, তাঁকে ওই টাকা দিয়েছিলেন জিপি প্রেসের সহকরী পরিচালক মোহাম্মদ আলী।জামিন পাওয়া অন্যরা হলেন পরীক্ষার্থী ও অভিভাবক, যাঁরা প্রশ্নপত্র কেনার জন্য রংপুরে জড়ো হয়েছিলেন। গ্রেপ্তার হওয়া শফিউরের ব্যাংক হিসাব থেকেই এক কোটি ৪৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা উদ্ধার করা হয়। তাঁর বাড়ি রংপুরের সদর উপজেলার উত্তম ইউনিয়নের উত্তম পূর্বপাড়ায়।প্রশ্নপত্র ফাঁসের এত বড় ঘটনা তখন দেশজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি করেছিল। একের পর এক আসামি গ্রেপ্তার, টাকা উদ্ধার ও জিজ্ঞাসাবাদে নানা চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসায় পুলিশের ভূমিকা প্রশংসিত হয়েছিল। কিন্তু দুই মাস পর সব তৎপরতা যেন থেমে গেছে। একে একে জামিনে বেরিয়ে আসছেন আসামিরা।এ-সংক্রান্ত মামলার তদন্ত কর্মকর্তা রংপুরের গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রথম আলোকে বলেন, অভিযুক্ত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। তাঁদের পাওয়া যাচ্ছে না। গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের অধিকাংশই মুক্তি পেয়ে যাচ্ছেন কেন, জানতে চাইলে তিনি বলেন, হাইকোর্টে আবেদন করে তাঁরা জামিন পেয়েছেন। জামিন পাওয়ার বিষয়টি নাগরিক অধিকার। মামলার অভিযোগপত্র দাখিল প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বিষয়টি এখনো সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদের ভিত্তিতে মূল অভিযুক্ত আরও কয়েকজনকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। তাঁরা গ্রেপ্তার না হলে মামলার ভবিষ্যৎ কী হবে, জানতে চাইলে তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, পর্যাপ্ত সাক্ষ্য-প্রমাণ পাওয়া গেলে পলাতকসহ অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হবে।এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বিশ্বজিৎ রায় প্রথম আলোকে বলেন, সুনির্দিষ্ট অভিযোগ না থাকায় আদালত তাঁদের জামিন মঞ্জুর করেন। এর মধ্যে ক্ষেত্রবিশেষে চাকরির বিষয়টিও বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। আসামিপক্ষের আইনজীবী হারুন অর রশিদ জানান, যে অভিযোগে মামলা হয়েছে, সেই অপরাধের উপাদান না থাকায় হাইকোর্ট তাঁদের জামিন মঞ্জুর করেছেন।মূল অভিযুক্তরাই পলাতক: প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় বিজি প্রেস ও শিক্ষা মন্ত্রণালয় দুটি আলাদা তদন্ত কমিটি করে। দুটি প্রতিবেদনেই ওই ঘটনার মূল অভিযুক্ত হিসেবে বিজি প্রেসের কম্পোজিটর শহীদুল ইসলাম ফকিরকে দায়ী করা হয়। পুলিশ জানিয়েছে, শহীদুলের কাছ থেকেই ২৫ লাখ টাকায় প্রশ্নপত্র কিনে নেন বিজি প্রেসের আরেক কর্মচারী গোলাম মোস্তফা। রংপুরে সেই প্রশ্নপত্র বিক্রির দায়িত্ব নেন পিএসসির সাবেক এক সদস্যের আত্মীয় আতিকুল ইসলাম। এই আতিকুলই ভিন্ন জগতে বুকিং দিয়েছিলেন। কিন্তু ঘটনার দুই মাস পরও পুলিশ শহীদুল বা আতিকুলকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি।বিজি প্রেসের সহকারী পরিচালক আলমগীর হোসেন প্রথম আলোকে জানান, ঘটনার পর থেকে শহীদুল অফিসে আসছেন না। ১১ জুলাই তাঁর ঠিকানায় চিঠি দিয়ে ১৩ জুলাইয়ের মধ্যে কাজে যোগ দিতে বলা হয়েছিল। কিন্তু তিনি কাজে যোগ দেননি। এ কারণে তাঁকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। এরপর তাঁর কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। তাঁর তেজগাঁওয়ের বাসায়ও কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না। রংপুরের পুলিশ সুপার সালেহ মোহাম্মদ তানভীর প্রথম আলোকে জানান, শহীদুল যে প্যান্টের ভেতর নকল পকেট তৈরি করে সেখানে প্রশ্নপত্র লুকিয়ে বাইরে নিয়ে আসতেন, পুলিশ তাঁর ঢাকার বাসা থেকে সেই প্যান্টটি জব্দ করেছে।প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিরা তাঁদের স্বীকারোক্তিতে বলেছেন, এই চক্রের সঙ্গে জড়িত সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা সুলতান আহমেদ। প্রশ্নপত্র ফাঁসের সময় ঘটনাস্থল থেকে গ্রেপ্তার হওয়া সরকারি প্রিন্টিং প্রেসের (জিপি) মুদ্রণ শাখার কর্মচারী হামিদুল ইসলাম এবং বিজি প্রেসের কম্পোজিটর গোলাম মোস্তফা তাঁর ভাগনে। তাঁদের বাড়ি রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার গজঘণ্টা ইউনিয়নে। তবে তাঁরা এখন বাড়িতে থাকেন না।সুলতান সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের প্রশাসন-৩ অধিশাখায় কাজ করতেন। গত বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে গেলে ওই শাখার কর্মকর্তারা জানান, সুলতানকে বর্তমানে প্রশাসন-১-এর অধীনে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে। ওই শাখায় গেলে সেখানকার কর্মকর্তারা জানান, ঘটনার পর থেকে সুলতান অফিস করছেন না। সুলতানের চাকরিজীবনের সব কাগজপত্র এখন প্রশাসন-১ শাখার কর্মকর্তা আবুল খায়েরের কাছে।সুলতানের বিষয়ে জানতে চাইলে আবুল খায়ের বলেন, তাঁকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। এরপর তিনি মাসখানেকের ছুটির আবেদন করেন। কিন্তু সাময়িক বরখাস্ত হওয়া কারো ছুটি মঞ্জুর করা যায় না। তাই তাঁর ছুটি মঞ্জুর হয়নি। তাঁর বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, জানতে চাইলে আবুল খায়ের বলেন, প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে তাঁর জড়িত থাকার বিষয়টি তদন্ত করবে পুলিশ। তবে অননুমোদিতভাবে কর্মস্থলের বাইরে থাকায় তাঁর বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলার প্রস্তুতি চলছে। শৃঙ্খলা শাখায় এ ব্যাপারে চিঠি দেওয়া হয়েছে।সুলতানের ব্যবহূত মোবাইল ফোনটি বন্ধ। পল্টনে এক যুগ্ম সচিবের বাসার সঙ্গে তাঁর বাসা ছিল। তবে এখন সেখানে কেউ থাকেন না। সুলতানের সহকারী হিসেবে কাজ করতেন সাঁট মুদ্রাক্ষরিক মুস্তাফিজুর রহমান। সুলতানের অবস্থান সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি জানান, ঘটনার পর তিনি সুলতানের নম্বর মোবাইল সেট থেকে মুছে দিয়েছেন। এখন আর তাঁর খোঁজ জানেন না তিনি।সুলতানের গ্রামের বাড়ি রংপুরে, গজঘণ্টা বাজারের পাশে। ওই বাড়িতে গেলে সুলতানের ভাই অটোচালক আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা ছয় ভাই। পাঁচজনই গ্রামে থাকি। পারিবারিকভাবে আমরা দরিদ্র। এখানে সুলতান আসে না। তবে শহরের সেনপাড়ায় ১৫ শতক জমিতে সে একটি বহুতল ভবন নির্মাণ করছে।’ খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সেনাপাড়ার ওই জমির দাম অন্তত ৭০ লাখ টাকা। সেখানে একটি পাঁচতলা ভবন নির্মাণের কাজ চলছে।প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত হিসেবে নাম এসেছে রংপুর জেলা পরিষদের দুই কর্মচারী আলাউদ্দিন ও আমজাদ হোসেনেরও। তাঁরাও পলাতক। তাঁদেরও বাড়ি গঙ্গাচড়া উপজেলার গজঘণ্টা ইউনিয়নে। রংপুর জেলা পরিষদের সচিব জয়ন্ত কুমার প্রথম আলোকে বলেন, আমজাদ হোসেন অস্থায়ী চাকরি করতেন। আর আলাউদ্দিন অফিস সহকারী। ঘটনার দিন থেকে তিনি অফিসে অনুপস্থিত। আমজাদকে স্থায়ীভাবে এবং আলাউদ্দিনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।রংপুরে প্রশ্নপত্র ফাঁসকারীদের আশ্রয়দাতা হিসেবে ছাত্রলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় কমিটির উপঅর্থ সম্পাদক, বর্তমান রংপুর জেলা আহ্বায়ক কমিটির সদস্য তারিকুল ইসলাম ও জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মুরাদুজ্জামানের নামও এসেছে। তবে পুলিশের গ্রেপ্তারের আগেই তাঁরা আদালত থেকে চার মাসের অগ্রিম জামিন নিয়ে এখন পলাতক। ডিবির ওসি আবদুল মান্নান জানান, ঘটনার পর থেকেই তাঁরা পলাতক। পেলেই তাঁদের গ্রেপ্তার করা হবে।রংপুরের পুলিশ সুপার সালেহ মোহাম্মদ তানভীর প্রথম আলোকে বলেন, এই ঈদেও পুলিশ অভিযুক্ত প্রত্যেককে গ্রেপ্তারের চেষ্টা করেছে। কিন্তু তাঁরা বাড়িতে আসছেন না। মামলার সর্বশেষ অবস্থা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ঘটনার দিন দেশের ৩৮ জেলার ১৬৭ জন গ্রেপ্তার হয়েছেন। এসব জেলায়ও তদন্ত চলছে বলেই অভিযোগপত্র দিতে সময় লাগছে।ঢাকায় একজন গ্রেপ্তার: পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে পীরগঞ্জ উপজেলার ধাপেরহাট মনিকৃষ্ণ সেন ডিগ্রি কলেজের কয়েকজন শিক্ষকের জড়িত থাকারও অভিযোগ আছে। প্রশ্নপত্র ফাঁসের দিন ঘটনাস্থল থেকে ওই কলেজের প্রভাষক আনিসুর রহমান ও তাঁর স্ত্রী শাপলা বেগম গ্রেপ্তার হন। তাঁদের স্বীকারোক্তিতে এ ঘটনার সঙ্গে ওই কলেজের আরও দুজন প্রভাষক মোরতাজা আলী ও আবদুল হাদি জড়িত বলে নাম আসে। পুলিশ বলছে, তাঁরাও পলাতক। কিন্তু গত ২৮ আগস্ট ঢাকার তেজগাঁওয়ের সরকারি বিজ্ঞান কলেজে উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার পরীক্ষা দিতে এসেছিলেন হাদি। পরীক্ষার হলে নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন ও উত্তরপত্র দেখে পরিদর্শক তাঁকে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করেন। আবদুল মান্নান প্রথম আলোকে বলেন, হাদিকে প্রশ্নপত্র ফাঁসের মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। এ ছাড়া ওই কলেজের আরও কয়েকজন শিক্ষকের ওপর নজর রাখা হচ্ছে।