শরিফুল হাসান
৫১ বছর আগে আজকের দিনে যাত্রা শুরু করেছিল বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক। যুদ্ধবিদ্ধস্ত বাংলাদেশ গড়ার জন্য স্যার ফজলে হাসান আবেদ যে ব্র্যাক গড়েছিলেন সেই ব্র্যাক আজ পৃথিবীর শীর্ষ বেসরকারি সংস্থা। শুধু বাংলাদেশ নয়, ব্র্যাক আজ আলো ছড়াচ্ছে পৃথিবীর নানা দেশে। সাংবাদিক হিসেবে এদেশের বহু মানুষের সাথে মেশার সুযোগ হয়েছে। দেখেছি অনেক প্রতিষ্ঠান। বেশিরভাগ সময় মনে হয়েছে, কী সরকারে কী সরকারের বাইরে এ দেশে অনেক বড় মানুষ আছেন। তারা অনেকেই অনেক কাজ করেছেন। কিন্তু ব্যক্তি পরিচয় ছাড়িয়ে সত্যিকারের একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন এমন লোক বিরল। সবাই ভেবেছে আমার প্রতিষ্ঠান। আমার জিনিষ। আর এখানেই স্যার ফজলে হাসান আবেদের স্বার্থকতা।
তিনি শুরু থেকে ব্র্যাককে একটি প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর ওপর দাঁড় করিয়েছেন। আর এই প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোই আজ ব্র্যাকের মূল শক্তি। শুরুতেই লিখেছি, মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে ব্র্যাকের জন্ম। ১৯৭০ সালের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ের পর ভোলার মনপুরাতে গিয়ে মানুষের কষ্ট আর ভোগান্তি দেখে ব্র্যাক প্রতিষ্ঠার ভাবনা এসেছিল স্যার ফজলে হাসান আবেদের মাথায়। আর মুক্তিযুদ্ধ সেটিকে বাস্তব করে।
১৯৭১ সালে যখন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয় স্যার আবেদ তখন শেল কোম্পানির শীর্ষ কর্মকর্তা। ব্রিটেন থেকে লেখাপড়া করে এসেছেন। আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা হিসেবে চলাফেরার জন্য যুদ্ধের সময় তাকে বাঘের ছাপওয়ালা পরিচয়পত্র দেওয়া হলো। তিনি যেখানে ইচ্ছে যেতে পারবেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী লোকজনের একটা বড় অংশ তখন ভারত চলে গেলো। ফজলে হাসান আবেদ ঠিক করলেন তাঁর যেহেতু অনেক বন্ধুবান্ধব আছে ইংল্যাণ্ডে কাজেই তিনি সেখানে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করবেন। বাংলদেশের মুক্তিযুদ্ধের জন্য তহবিল গড়বেন যেই তহবিল দিয়ে অস্ত্র কেনা হবে, মুক্তিযুদ্ধে সাহায্য করা হবে। স্যার আবেদের কাছে ব্রিটিশ পাসেপোর্ট ছিল। সেই পাসপোর্টে তিনি পাকিস্তানের শেল অফিসে গেলেন। উদ্দেশ্য সেখান থেকে লন্ডনের ফ্লাইট ধরবেন।
কিন্তু তার আগেই পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর লোকজন তাকে ধরে নিয়ে গেল। আবেদ ভাইয়ের বন্ধু সরকারের উপ সচিব আসাফউদ্দোলা তখন বিষয়টি জানালেন ব্রিটিশ হাইকমিশনে যে তোমাদের একজন নাগরিককে পাকিস্তানের আইএসআই আটকে করেছে। ব্রিটিশ হাইকমিশন তৎপর হলো। এর দদিন পর স্যার আবেদকে ছাড়া হলো। পাকিস্তান থেকে তখন কাউকে ব্রিটেনে যেতে হলে বিশেষ অনুমতি নিতে হতো। আবেদ ভাই সেই অনুমতির অপেক্ষা না করে আফগানিস্তান চলে গেলেন। সেখান থেকে টেলিগ্রাম করে লন্ডনে থেকে টিকিট আনালেন। এরপর ইসতানবুল হয়ে গেলেন লন্ডনে। শুরু হলো নতুন এক যুদ্ধ।
ব্রিটেনে বসে বিদেশি ও বাংলাদেশি বন্ধুদের মিলে স্যার আবেদ শুরু করলেন অ্যাকশন বাংলাদেশ। শুরু হলো বাংলাদেশের জন্য প্রচারণা ও তহবিল সংগ্রহ। আর বিদেশি সব গণমাধ্যমে জানালেন বাংলাদেশের গণহত্যার কথা। এই যে দেশের স্বাধীনতা ও মুক্তির জন্য লড়াই তা আর কখনো থামাননি আবেদ ভাই। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর গ্রামে গিয়ে মানুষের জন্য কাজ করবেন বলে গড়ে তুললেন বাংলাদেশ রিহ্যাবিলেশন অ্যাসিসটেন্ট কমিটি সংক্ষেপে-ব্র্যাক। ব্র্যাকের পরিচালনা পর্ষদের প্রথম চেয়ারম্যান ছিলেন কবি সুফিয়া কামাল। জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকসহ আরও অনেকেই যুক্ত হলেন তাতে। প্রতিষ্ঠান তো হলো টাকা আসবে কোথা থেকে? লন্ডনে নিজের ফ্ল্যাটটি বিক্রি করে দিলেন তিনি। সেই টাকা দিয়ে শুরু হলো ব্র্যাকের কাজ।
সেই যে শুরু আজ সেই প্রতিষ্ঠানের বয়স ৫০ বছর। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বেসরকারি সংস্থা আজ ব্র্যাক। শুরুটা হয়েছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের পর ভারত থেকে প্রত্যাগত উদ্বাস্তুদের ত্রাণ ও পুনর্বাসনে সহায়তামূলক কর্মকান্ডের মাধ্যমে। পরবর্তী সময়ে ব্র্যাক বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে দারিদ্র্য দূরীকরণ এবং দরিদ্র জনগণের ক্ষমতায়নের মতো দীর্ঘমেয়াদি বিষয়ে মনোনিবেশ করে। বর্তমানে ব্র্যাক শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, মানবাধিকার, ক্ষুদ্রঋণ, নারী ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ক্ষমতায়ন প্রভৃতি কার্যক্রমের মাধ্যমে দরিদ্র মানুষের জীবনমান পরিবর্তনের লক্ষ্যে নানা কর্মসূচি পরিচালনা করছে।
ব্র্যাকের অতীত ইতিহাস যে কাউকে মুগ্ধ করবে। অবাক হয়ে ভাববেন, একটা প্রতিষ্ঠান কী করে এতো কাজ শুরুর সাহস করলো। ১৯৬৮ সালে খাবার স্যালাইন তৈরি হলেও দেশের মানুষ জানতো না। ফলে ডায়রিয়ায় প্রচুর লোক মারা যতেো। ব্র্যাক বাড়ি বাড়ি খাবার স্যালাইন নিয়ে গেলো। সারা বাংলাদেশের প্রতিটি বাড়িতে গিয়ে একজন নারীকে লনবগুড়ের স্যালাইন বানানো শেখাতে ব্র্যাকের সময় লেগেছিল দশ বছর। ফলাফল ডায়রিয়ায় মানুষের মৃত্যু কমে এলো। বাংলাদেশে গর্ভবতী মায়েদের মৃত্যু কমাতে এবং শিশু মৃত্যুর হার কমানোর জন্য টীকা প্রদাণের যে কর্মসূচি তাতে ব্র্যাকের ভূমিকা বিশাল। ১৯৮০ সালে ব্র্যাক সরকারকে টীকা শুরুর প্রস্তাব দিলেও সরকার ১৯৮৬ সালে পুরোদমে কাজটি শুরু করতে রাজি হলো। ভাবতে ভালো লাগে একটা প্রতিষ্ঠানকে সরকার কতোটা আস্থায় নিলে বলতে পারে দেশের চার বিভাগের মধ্যে দুটিতে কাজ করবে ব্র্যাক। বাকি দুটোতে সরকার। অবাক করা বিষয় হলো যে দুই বিভাগে ব্র্যাক কাজ করেছিল সেখানে আশি শতাংশ শিশুর টিকাদান সম্পন্ন হয়েছিল। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা স্বৃীকৃতি দিলো ব্র্যাককে।
দেশজুড়ে শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার কমাতে এই টীকা কার্যক্রমের ভূমিকা বিশাল। স্বাস্থ্যের কথা বলবেন? মাতৃমৃত্যু কমাতে কাজ করেছে ব্র্যাক। সারাদেশে স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট ব্যবহারের অভ্যাস করানোর পেছনেও ব্র্যাক কাজ করেছে।ব্র্যাকের উপ আনুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রম বিশেষ করে দরিদ্র পরিবারের সন্তানদের লেখাপড়া শেখানোর কাজটিও মুগ্ধকর। নব্বইয়ের দশকে ব্র্যাকরে ফোকাস ছিল শিক্ষা। বিশেষ করে মেয়েদের পড়ানোর উদ্যোগ ছিল। সারাদেশে ৬৪ হাজার স্কুল চালিয়েছে ব্র্যাক। এক কোটি ২০ লাখ ছেলেমেয়ে শিক্ষার আলো পেয়েছে। এখন স্কুলপড়ুয়াদের মধ্যে মেয়েদের সংখ্যা বেশি। এর পেছনে ব্র্যাক বড় ভূমিকা পালন করেছে। কোটি মানুষের দারিদ্র দূর হয়েছে ব্র্যাকের হাত ধরে। আড়ং থেকে শুরু করে ব্র্যাকের প্রতিটিা কর্মসূচিই সময়ের সাথে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়েছে। আজকে জলবায়ু পরিবর্তন বলেন, তরুণদের দক্ষতা তৈরি, অভিবাসন কিংবা নারীদের অধিকার সব কাজেই আছে ব্র্যাক। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় বলেন, ব্র্যাক ব্যাংক কিংবা বিকাশ ব্র্যাকের পরিধি বহুদূর।
এক জীবনে কী অসাধারণ সব অর্জন স্যার আবেদের। এক কোটিরও বেশি শিশু ব্র্যাক থেকে প্রাথমিক শিক্ষা পেয়েছে। আশির দশকে বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি বাড়ি ঘুরে ঘুরে খাবার স্যালাইন বানানো শিখিয়েছে ব্র্যাক। শিশুদের টিকাদান নিশ্চিত করতে কাজ করেছে। অথচ এতো কাজ করার পরেও তিনি বিনয়ে নত। আর সব কাজের সূচনায় ছিল মানুষ। হয় তাদের সমস্যার সমাধান, নয় তাদের সম্ভাবনা বিকশিত করার চিন্তায় মগ্ন ছিলেন।স্যার আবেদকে নিয়ে বলা গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ড. মুহাম্মদ ইউনুসের কথাগুলো ভীষণ সত্য।
মানুষের জীবন পরিবর্তনে যত কিছু লাগে, প্রত্যেক কাজে স্যার আবেদ শরিক হয়েছেন। শুধু কয়েকটা ছোটখাটো দৃষ্টান্ত স্থাপনের জন্য নয়, সব মানুষের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করে গেছেন এবং তিনি সফল হয়েছেন। বাংলাদেশের ১৭ কোটি মানুষের প্রায় সবাই কোনো না কোনোভাবে স্যার আবেদের সঙ্গে জড়িত।শুধু বাংলাদেশ নয়, দেশের সীমানা ছাড়িয়ে ব্র্যাক কাজ করেছে দেশের বাইরে। কতটা সাহস থাকলে যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তান গড়ার কাজে যেতে পারেন একজন বাংলাদেশি! ২০০২ সালে জাতিসংঘের উন্নয়ন সংস্থার তৎকালীন প্রধান আফগানিস্তানে ভয়াবহ যুদ্ধের মধ্যে তাদের কমিউনিটি স্বাস্থ্য ক্লিনিকগুলোর দায়িত্ব নেওয়ার জন্য পৃথিবীর সব দেশের প্রতিনিধিদের অনুরোধ জানিয়েছিলেন। ঘর-ভর্তি আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিদের কেউ সেদিন সাড়া দেননি। স্যার আবেদ সেদিন হাত তুলে বলেছিলেন, ‘ব্র্যাক কাজ করবে আফগানিস্তানে।’ অবশ্য শুধু আফগানিস্তান নয়, পৃথিবীর ১১টি দেশে এখন কাজ করছে ব্র্যাক।চারটা মূল্যবোধ নিয়ে কাজ করে ব্র্যাক। সততা ও নিষ্ঠা, সৃজনশীলতা ও উদ্ভাবনী মনোভাব, সর্বজনীনতা এবং কার্যকারিতা। আমি মনে করি এসব কারণেই ১৯৭২ সালের ব্র্যাক আজকে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বেসরকারি সংস্থা।
বাংলাদেশের ১২ কোটিরও বেশি লোককে ব্র্যাক তার উন্নয়ন কার্যক্রমের আওতায় নিয়ে এসেছে। দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বর্তমানে ব্র্যাকের এক লাখ কর্মী বিশ্বব্যাপী ১১টি দেশে কাজ করছে। ব্র্যাক আসলে কতো বড়? আমার মঝে মধ্যে মনে হয়, বাংলাদেশের সরকারি কী বেসরকারি কর্মকর্তা, ছাত্র শিক্ষক-পেশাজাবী সবাই যদি দুই-তিনমাসের জন্যে ব্র্যাকে কাজ করতো! তাহলে প্রতিষ্ঠান জিনিষটা সবার বোঝা হয়ে যেত। ফজলে হাসান আবেদ সারাজীবন এই প্রতিষ্ঠান গড়তে চেয়েছেন।
আমার মনে আছে, এক দশক আগের কথা। আমি তখন প্রথম আলোর সিনিয়র রিপোর্টার।এনজিও-বিষয়ক ব্যুরোর তখনকার মহাপরিচালক যিনি একসময়ে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে ছিলেন এবং পরে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ছিলেন, সেই আসাদুল ইসলাম স্যার আমাকে কথায় কথায় বলেছিলেন, বাংলাদেশের বেসরকারি সংস্থাগুলোর কাজ যদি ব্র্যাকের মতো সুন্দর ও স্বচ্ছ হতো তাহলে দেশটা অনেক এগিয়ে যেতো। সেদিন এই কথাটার মানে বুঝিনি। তবে আজ বুঝি প্রতিষ্ঠান কেন জরুরী।
যে কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম বাংলাদেশে বড় মানুষ অনেক আছে কিন্তু সত্যিকারের প্রতিষ্ঠান খুব কম আছে। ব্র্যাককে আমার মনে হয়েছে সত্যিকারের একটা প্রতিষ্ঠান। সৃষ্টিকর্তার তৈরি ধর্ম নিয়ে মানুষে মানুষে ভিন্নমত থাকে, সমালোচনা থাকে, মানুষের গড়া প্রতিষ্ঠান নিয়েও কথা থাকবে কিন্তু ব্র্যাককে আমার মনে হয়েছে বাংলাদেশের একটা অনন্য প্রতিষ্ঠান। ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর দিনে আজ বাংলাদেশের সবার জন্য ভালোবাসা ও শুভকামনা। শুভ কামনা তাদের জন্য যারা গত ৫১ বছর পরিশ্রম করে ব্র্যাককে এই জায়গায় নিয়ে এসেছেন। শুভ কামনা তাদের জন্য যারা বাংলাদেশের সীমানা পেরিয়ে দেশে দেশে কাজ করছে। ব্র্যাকের যে লক্ষ্য নিশ্চয়ই একদিন প্রতিটি মানুষ তাঁর সম্ভাবনা বিকাশের সুযোগ পাবে। মর্যাদাপূর্ণ জীবনের সুযোগ পাবে। আর এভাবেই এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ। এগিয়ে যাক পৃথিবী।