শরিফুল হাসান
আধাঘন্টার এই আলাপনটা শুনতে পারেন বিশেষ করে কিশোরদার কথাগুলো। নতুন করে জীবনবোধ জাগবে। আসলে কিশোরদার ভাবনা, মূল্যবোধ, স্বেচ্ছাসেবী কাজসহ নানা বিষয়ে কথা শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল সব ছেড়ে কিশোরদার মতো হই। আমার এই জীবনে অল্প যে কয়েকজন মানুষ আমাকে ভীষণ প্রভাবিত করেছে Kishor Kumar দা তাদের অন্যতম।
অসাধারণ সব কার্যক্রমের জন্য মানুষের মন ছুয়েছে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন। স্বেচ্ছাসেবী এই সংস্থাটির প্রতিষ্ঠাতা কিশোর কুমার ২০২৩ সালে একুশে পদক পেয়েছেন। এর আগে তিনি ব্রিটিশ রানীর কাছ থেকে ‘কমনওয়েলথ পয়েন্টস অব লাইট’ পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। জাপান ও কাতার সরকার তাকে স্বীকৃত দিয়েছে।
তবে পুরুস্কার পাওয়াকে একেবারেই বড় করে দেখতে রাজি নন কিশোর। আমার কেন জানি মনে হয় কিশোরদা পুরুস্কার পেয়ে ধন্য হন না বরং পুরস্কারগুলোর সম্মান বাড়ে কিশোরদাকে স্বীকৃতি দিয়ে। যাই হোক কিশোরদা ঢাকায় আসবেন সেটা গত মাসেই জানি। তাঁর সাথে কথা ছিল ঢাকায় আসলে আগেরবারের মতো এবারো আমার সাথে আড্ডা দেবেন। ডেইলি স্টারে তাঁর একটা সাক্ষাতকার নেব।
তারিখটাও অগে থেকে ঠিক করা ছিল ১২ ফেব্রুয়ারি। কে জানতো এই দিনই তাঁর একুশে পদক পাওয়ার ঘোষণা আসবে? গতকাল তাই আলাপের শুরুটাই করলাম একুশে পদক নিয়ে। কিশোরদার কথা, বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন এ স্বীকৃতি পায়নি, পেয়েছে এ দেশের মানুষ। যেসব তরুণ দিনের পর দিন স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করছেন, যাঁরা সহায়তা করছেন অথবা যে গণমাধ্যমকর্মীরা বিদ্যানন্দের ভালো কাজগুলো মানুষের সামনে তুলে ধরছেন—এ অর্জন সবার।
স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের শুরু ২০১৩ সালে। চট্টগ্রামের প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কম্পিউটার প্রকৌশল বিভাগে স্নাতক করেছেন ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান কিশোর কুমার দাস। তাঁর সাথে আমার ঘনিষ্ঠতা করোনার শুরুরসময়টাতে। হঠাৎ করে তিনি যখণ জানালেন তিনি বিদ্যানন্দ থেকে পদত্যাগ করবেন ডেইলি স্টারের Syed Ashfaqul Haque বললেন যে করেই হোক কিশোর কুমারের একটা সাক্ষাতকার নাও।
কিশোরদা থাকেন পৃথিবীর আরেক প্রান্তে আন্দেজ পর্বতমালার নিচে পেরুতে। তাঁকে খুঁজে বের করা, সাক্ষাতকার নেওয়া আমার জীবনের একটা কঠিন কিন্তু দারুণ আনন্দময় মুহুর্ত ছিল। সেই থেকে গত তিন চার বছর ধরে কিশোরদার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা। ঘনিষ্ঠতা মানে আমি তাঁর কাছ থেকে শিখি। তাঁর জীবনযাপন দেখি।
এতো নির্মোহ একটা মানুষ কী করে হয়? ২০১৩ সালে ‘পড়ব, খেলব, শিখব’ স্লোগান নিয়ে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের পড়ালেখার সুযোগ করে দেওয়ার মাধ্যমে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের গোড়াপত্তন করেন কিশোর কুমার। ক্রমেই বিদ্যানন্দের ছায়াতলে যুক্ত হতে থাকেন অনেক তরুণ স্বেচ্ছাসেবী। দেশ-বিদেশের অসংখ্য মানুষ এখন এতে যুক্ত। কিশোরদাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, এই যে মানুষের পাশে দাঁড়ানো, সেই মানবিক মূল্যবোধের তো বেশ সংকট দেশে। সহাস্যে কিশোর কুমারের উত্তর, ’আমি খুব ছোট মানুষ।
তবে আমার মনে হয় আমরা পুরো মানবজাতি একটা সমস্যায় আছি। দেখেন অন্য সব প্রাণী দলবেঁধে একসঙ্গে থাকে। শেয়ার করে খাবার খায়। আমাদের বোধহয় সবাইকে নিয়ে বাঁচার, শেয়ার করার শক্তিটা কমছে। আমরা একে অপরের প্রতি নির্দয় আচরণ করি। আমাদের মূল্যবোধ কমছে’। মূল্যবোধের এই সংকটের কোন পরিত্রাণ দেখেন কী না?
তরুণ প্রজন্মের জন্য কিছু বলবেন? কিশোর কুমারের উত্তর, তরুণ প্রজন্মকে আমি দায়ী করবো না বা বলবো না, বলবো নীতি নির্ধারকদের। দেখেন আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে মূল্যবোধটা যেন বাড়ানো হয়। আমি প্রকৌশল বিদ্যায় লেখাপড়া করেছি। আমাদের কতোটুকু মূল্যবোধ শেখানো হয়? আমাদের লেখাপড়াজুড়ে মূল্যবোধ কতোটা আছে? আমি মনে করি আমাদের শিক্ষায় মানবিক মূল্যবোধ বাড়াতে হবে।
শুরু করতে হবে পরিবার থেকে।’ কেমন বাংলাদেশ বা কেমন পৃথিবী দেখতে চান? সহাস্যে উত্তর কিশোর কুমারের ‘ছোটবেলা থেকে শুনি সোনার বাংলা। আমার তখন মনে হতো আমরা খুব ভালো। আমরা শ্রেষ্ঠ। আমি যখন বিদেশে যাওয়া আসা শুরু করলাম তখন দেখলাম সবাই ভাবছে তারাই সুপরিয়ির। আসলে আমরা সব জাতি নিজেকে সুপরিয়ির ভাবি। এটা একটা সমস্যা।’ কিশোর কুমার বলেন, ‘আমাদের কারোই সুপিরিয়র ভাবা উচিত না। আমি এমন দেশ চাই, এমন একটা পৃথিবী চাই যেখানে কেউ কাউকে সুপিরিয়র ভাববে না।
এই ভাবনা বহু সংকটের সমাধান করে দিতে পারি। দেখেন পৃথিবীতে যথেষ্ঠ খাবার ও সম্পদ আছে। কেউ কাউকে সুপরিয়র ভাবার দরকার নেই। দরকার সবাই মিলে বাঁচার। একসঙ্গে বাঁচার। মূল্যবোধ নিয়ে বাঁচি। মানবিক হই সবার প্রতি’। কেউ চাইলে আলাপনটা শুনতে পাবেন। মানবিক মানুষ হওয়ার ইচ্ছেটা আরেকটু চাঙ্গা হবে। মনে হবে জীবন নিয়ে নতুন করে ভাবি।