ফিলিস্তিনে এই বর্বরতা বন্ধ হোক

Spread the love

শরিফুল হাসান

গাজায় ছয় দিনে ছয় হাজারের বেশি বোমা নিক্ষেপ করেছে ইসরায়েল। হত্যা করা হয়েছে কয়েক হাজার মানুষকে যাদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু। ইউনিসেফ বলেছে, ইসরায়েলের হামলায় এখন পর্যন্ত ৪৬৯ শিশু নিহত হয়েছে। ১০ লাখ শিশুর দুঃস্বপ্নে দিন কাটছে। শুধু নারী শিশু হত্যা নয়, হামলা থেকে বাদ পড়ছে না আবাসিক ভবন থেকে শুরু করে অ্যাম্বুলেন্স, হাসপাতাল, এমনকি গণমাধ্যমের কার্যালয়ও। এখন পর্যন্ত ১৫টি হাসপাতাল বিধ্বস্ত হয়েছে। মৃতের সংখ্যা এতো দ্রুত বাড়ছে যে কবরস্থানগুলোতে আর কবর দেওয়ার জায়গা হচ্ছে না। টানা হামলা এবং অবরোধে গাজার মানবিক পরিস্থিতি শোচনীয় হয়ে উঠেছে। পানি নেই বিদ্যুৎ নেই।

গাজায় যা হচ্ছে সেটা মানবতাবিরোধী অপরাধ ছাড়া আর কিছু নয়। এবার বোমা হামলায় নিষিদ্ধ সাদা ফসফরাস ব্যবহার করছে ইসরায়েল। এই সাদা ফসফরাস মানুষকে মারাত্মকভাবে দগ্ধ করে। দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্যগত ঝুঁকিতে ফেলে। এসব কারণে জনবহুল এলাকায় সাদা ফসফরাসের ব্যবহার বেআইনি।

অবশ্য ইসরায়েলের জন্য তো আবার আইন প্রযোজ্য নয়!খেয়াল করে দেখুন, দিনের পার দিন, বছরের পর বছরে ধরে ইসরায়েল মানবতাবিরোধী অপরাধ করলেও তা নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কথা বলছে না। এই যে কয়েকদিন ধরে বোমায় জ্বলছে ফিলিস্তিন, জ্বলছে নারী-পুরুষসহ সব বয়সী মানুষ সেগুলো কেউ দেখেও দেখছে না। হাজার হাজার মানুষ মরছে, লাখ লাখ মানুষ ইসরায়েলি হামলায় বাস্তুচ্যুত!

আফসোস এর মধ্যেই আবার ফিলিস্তিনির উত্তর গাজার সব বেসামরিক বাসিন্দাকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে উপত্যকার দক্ষিণে পালাতে বলেছে ইসরায়েল! জাতিসংঘ আদেশটি প্রত্যাহার করতে ইসরায়েলের প্রতি আহ্বান জানালেও পাত্তা দিচ্ছে না ইসরায়েল। উল্টো জাতিসংঘ কর্মীসহ আশ্রয়শিবিরে থাকা ফিলিস্তিনি শরণার্থীদেরও তারা এলাকা ছাড়তে বলেছে। হয়তো সামনে রচিত হবে বর্বরতার নতুন ইতিহাস! ইসরায়েলের এমন অত্যাচার বহু বছর ধরে চলছে। পশ্চিমা বিশ্বের সহায়তা রাজনৈতিকভাবে ফিলিস্তিনকে বিশ্বের মানচিত্র থেকে মুছে দেওয়ার সব ধরনের চেষ্টা করে যাচ্ছে ইসরায়েল।

আফসোস ফিলিস্তিনে এমন মানবতাবিরোধী অপরাধ হলেও সেটি বন্ধের আহবান না জানিয়ে উল্টো ইসরায়েলের পাশে থাকার ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্লিঙ্কেন ইসরায়েল সফরে গিয়ে বলেছেন, ‘যত দিন আমেরিকা আছে, তত দিন আপনাদের একা লড়তে হবে না।’

কেবল যুক্তরাষ্ট্র নয় ফিলিস্তিনে যে দিনের পর দিন মানবতাবিরোধী অপরাধ চলছে সে ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রভাবশালী সদস্যরা নিরব। এমন নয় যে ইসরায়েলের অপরাধ সম্পর্কে তারা জানে না। বরং নিজেদের দূতাবাসের কর্মকর্তাদের গোপন তারবার্তা এবং মানবাধিকার সংস্থাগুলোর অসংখ্য প্রতিবেদনে তারা জাতিবিদ্বেষী রাষ্ট্র ইসরায়েলের সব অপরাধের কথা জানে।

এই যে ফিলিস্তিনি সাধারণ মানুষ, নারী শিশুদের অভুক্ত রাখা হচ্ছে, তাদের পানি পান করতে দেওয়া হচ্ছে না, বিদ্যুৎ-জ্বালানি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, যথাযথ চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে এবং তাদের ওপর ক্রমাগত বোমা হামলা করা হচ্ছে এগুলো মানবতাবিরোধী অপরাধ। তারপরও তারা চুপ থাকে। সমর্থন দেয় ইসরায়েলকে। কাজেই ফিলিস্তিনে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায় যতোটা ইসরায়েলের ততোটা পশ্চিমাদের‌।

কেউ কেউ বলতে পারেন এবার তো হামাস তো হামলা চালালো আগে। ইসরায়েলও এই যুক্তি দিয়ে ফিলিস্তিনকে শেষ করে দিতে চাইছে। কোনভাবেই একজন মানুষ হত্যাও কাম্য নয়। ইসরাইলের একজন মানুষের মৃত্যুও বেদনার। তবে একটু পেছনে ফিরলেই দেখা যাবে কীভাবে এর সূত্রপাত। বাস্তবে ইহুদিদের জন্য প্রতিষ্ঠিত ইসরায়েল নামে কোন রাষ্ট্র ছিল না এই পৃথিবীতে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটেনের প্রয়োজনে দুর্লভ বোমা তৈরির উপকরণ কৃত্রিম ফসফরাস তৈরি করতে সক্ষম হন ইহুদি বিজ্ঞানী ড. হেইস বাইজম্যান৷ ফলে আনন্দিত ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী জানতে চাইলেন কী ধরনের পুরস্কার তিনি চান? ড. হেইস বলেন, ইহুদিনের জন্য এক টুকরো ভূমি চান তিনি। এই দাবিকে সমর্থন জানাতেই যেন ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী লর্ড আর্থার বালফোর ১৯১৭ সালের ২ নভেম্বর জায়নবাদী নেতা ব্যারন রথচাইল্ডকে চিঠি দিয়ে প্রথম জায়নবাদ নামক উগ্র ইহুদি জাতীয়তাবাদকে স্বীকৃতি দেন, যা মহা বিপর্যয়ের দ্বার খুলে দেয়। এটি কালক্রমে বালফোর ঘোষণাপত্র নামে পরিচিতি পায়। এর মধ্য দিয়ে ব্রিটিশ সরকার ফিলিস্তিনে ইহুদি জনগণের জন্য জাতীয় আবাসভূমি গড়ে তোলার বিষয়ে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে।

পরের ইতিহাস শুধুই কালিমার। ১৯২০ সালে জাতিপুঞ্জ ঘোষণার মাধ্যমে ব্রিটিশরা ম্যান্ডেটরি প্যালেস্টাইন প্রতিষ্ঠা করে এবং যুক্তরাজ্য প্যালেস্টাইনের শাসনভার গ্রহণ করে। এরপর বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে দলে দলে ইহুদিরা ফিলিস্তিনে জড়ো হতে থাকে। ব্রিটিশ শাসন চলে ১৯৪৮ সালের মে মাস পর্যন্ত। ব্রিটিশরা ফিলিস্তিনের শাসনভার গ্রহণ করার পর থেকেই সেখানকার ৯০ শতাংশ বা তারও বেশি আরব অধিবাসীর সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ ও দমননীতি শুরু করে। ফিলিস্তিনিরা সন্ত্রাসবাদী বলে ইসরায়েল ও পশ্চিমা বিশ্ব দশকের পর দশক ধরে প্রচারণা চালানো হচ্ছে অথচ ইসরায়েল রাষ্ট্রের জন্মই হয়েছে সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে। ব্রিটিশ বাহিনীর সহযোগিতায় গড়ে ওঠা ইহুদি মিলিশিয়া হাগানাহ, ইরগুন ও স্ট্যার্ন গ্যাং হত্যা, সন্ত্রাস, ধর্ষণ আর ধ্বংসযজ্ঞ সৃষ্টির মাধ্যমে ফিলিস্তিনদের বাধ্য করে ফিলিস্তিন ছেড়ে চলে যেতে৷ আর দীর্ঘ মেয়াদে ইহুদিদের জন্য ঈশ্বর ‘প্রতিশ্রুত ভূমি’ (প্রমিজড ল্যান্ড) ফিরিয়ে দেওয়ার কৌশল হিসেবে ইহুদি সেটেলারদের বিভিন্নভাবে অগ্রাধিকার সুবিধা দিতে থাকে।

বালফোর ঘোষণার ২০ বছর পর ১৯৩৭ সালে ব্রিটিশ সরকারের নিয়োগকৃত পিল কমিশন ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে একটি ছোট ইহুদি রাষ্ট্র গঠন করে সেখানকার আরবদের পূর্বে ট্রান্স জর্ডান ও পশ্চিমে মিসরসংলগ্ন বৃহত্তর অংশে স্থানান্তরের এবং জেরুজালেম ও বেথলেহেমকে দুই রাষ্ট্রের মধ্যে একটি ছিটমহল হিসেবে রাখার প্রস্তাব দেয়। আরবেরা এটি প্রত্যাখ্যান করলেও জায়নবাদী নেতারা এতে সমর্থন দেন। কেননা পিল কমিশন অন্যায়ভাবে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ভিত্তি তৈরি করে দেয়।১৯৪৮ সালের ১৪ মে ফিলিস্তিনে ব্রিটিশ ম্যানডেট বা শাসন শেষ হলে ওইদিনই মানে ১৯৪৮ সালের ১২ মে রাত ১২টা এক মিনিটে ইসরায়েল রাষ্ট্র ঘোষণা করে ইহুদি জায়নবাদীরা, যাদের প্রধান ছিলেন দাভিদ বেন গুরিয়ন (পরবর্তীতে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী)৷ মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান ১০ মিনিটের ভেতর ইসরায়েলকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এরপর আল নাকবা বা মহাবিপর্যয় নেমে আসে ফিলিস্তিনিদের ওপর। জীবন বাঁচাতে নিজ ঘরবাড়ি ছেড়ে নিঃস্ব অবস্থায় রাতারাতি লাখ লাখ ফিলিস্তিনি প্রাণ রক্ষায় ছুটে পালাতে থাকে। সেদিন পশ্চিমা বিশ্ব চুপ থেকে ইসরায়েলের স্বার্থ দেখেছে।

১৯৬৭ সালে ইসরায়েলি দখলদারি আরও পোক্ত হয় গোলান উপত্যকা, পূর্ব জেরুজালেম ও পশ্চিম তীরে কর্তৃত্ব স্থাপনের মধ্য দিয়ে। সেদিনও পশ্চিমারা চুপ ছিল। এই যে আরবদের ফিলিস্তিন রাষ্ট্র দখল করে নিয়ে ইহুদিরা ইসরায়েল রাষ্ট্র বানালো, এরপর গত ৭০-৮০ বছর ধরে অব্যাহত গণহত্যা চালাচ্ছে, নারী শিশুসহ নির্বিচারে সাধারণ মানুষ হত্যা করছে সেগুলো দেখেও পুরো পৃথিবী চুপ। নানা লোভ আর বিভেদের দ্বিধা-দ্বন্দে জর্জরিত আরবরা। ফলে পশ্চিমা মোড়লরা প্রকাশ্যে ইসরায়েলের পাশে থেকে গণহত্যার বৈধতা দিচ্ছে। ভীষণ আফসোস লাগে,এই ২০২৩ সালে এসেও রোজ বোমা পড়ছে, সাদা ফসফরাসে পুড়ছে মানুষ, পুড়ছে নারী-শিশুরা, পুড়ছে ঘরবাড়ি, চলছে নির্বিচারে মানুষ হত্যা। অথচ সারা পৃথিবী শুধু চুপচাপ দেখছে।

জানি না পৃথিবীতে এমন গণহত্যা আর কতোদিন চলবে! রোজ যারা মানবতার বুলি আওড়ায় পৃথিবীজুড়ে, জানি না কবে তাদের বোধ জাগবে! জানি না পৃথিবীর সব মানুষ কবে একযোগে জেগে উঠে বলবে, আর একজন মানুষও হত্যা নয়! ইতিহাস স্বাক্ষী বাংলাদেশের একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে একজন মানুষ হিসেবে ইসরায়েলের এই বর্বরতার প্রতিবাদ জানাচ্ছি এবং সবাইকে প্রতিবাদ করে এই বর্বরতা বন্ধের আহবান জানাই।

All reactions:865Nur E Shafa Ankhi, Md. Shamsul Islam and 863 others3886LikeCommentShare

Leave a Reply

Your email address will not be published.