দুর্ঘটনার পর জানা যায় ফিটনেস নেই!

Spread the love

শরিফুল হাসান

বহুবার লিখেছি এই দেশে বাস বা লঞ্চের যে কোন দুর্ঘটনার পর জানা যায় ফিটনেস নেই। আগুন লাগার পর জানা যায় ভবনের অনুমোদন নেই। এর আগে সব কর্তৃপক্ষ ঘুমিয়ে থাকে। এই যে মাদারীপুরের শিবচরে বাস খাদে পড়ে ১৯ জন মারা যাবার পর জানা যাচ্ছে ইমাদ পরিবহনের বাসটির চলাচলের অনুমতি ছিল না। বাসটির ফিটনেস সনদের মেয়াদও পেরিয়ে গেছে। আরো জানা যাচ্ছে, চার বছর আগেও বাসটি গোপালগঞ্জে দুর্ঘটনায় পড়েছিল। সেই দুর্ঘটনায় পুলিশের একজন উপরিদর্শকসহ চারজন মারা যান।

এর পর থেকে বাসটির চলাচলের অনুমতি স্থগিত রাখা হয়েছিল। অথচ এরপরেও গত চারবছর ধরে বাসটি চলছে। আমাদের পুলিশ, আমাদের কোন কর্তৃপক্ষ দেখেনি। এখন ১৯ জন মানুষের মৃত্যুর পর সব কর্তৃপক্ষ জানাচ্ছে বাসটির অনুমোদন নেই। আচ্ছা এতোদিন কী সবাই ঘুমিয়ে ছিলেন?লিখতে লিখতে ক্লান্ত লাগে। তাও লিখি। এই দেশে দেখবেন ট্রাফিক পুলিশ রাস্তায় গাড়ির কাগজপত্র দেখছে। কিন্তু খুব সময়েই দেখবেন তারা বাস-ট্রাকের কাগজপত্র দেখে। অধিকাংশ সময় দেখবেন প্রাইভেট কার কিংবা মোটরসাইকেল। অথচ পুলিশের চোখের সামনেই এই শহরে লক্করঝক্কর বাস চলছে। চলছে ফিটনেস বিহীন ট্রাক।হেডলাইট নেই, ব্যাকলাইট নেই, ফিটনেস নেই।

কিন্তু কেউ সেসব দেখে না। অবশ্য পুলিশকে শুধু দোষ দিয়ে লাভ কী? পুলিশকে হত্যা করে পুড়িয়ে মারার আসামিকে ধরেও যেখানে ছেড়ে দেওয়া হয়, পুলিশ হত্যা মামলার পলাতাক আসামি যেখানে বিদেশে চলে যান নিরাপদে, ইচ্ছমতো দেশে আসেন, সেখানে সাধারণ মানুষের কী অবস্থা বোঝাই যায়। জবাবদিহিতা বলে তো আর কিছু নেই এখানে। এই যে দুর্ঘটনার পর বিআরটিএ আজ বলছে, বাসের ফিটনেস ছিল না এতোদিন তাহলে তারা কী করেছে? শুধু বিআরটিএ না, সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপোতে ৫০ জন মানুষ পুড়ে মরার পর শুনবেন রাসায়নিক মজুতের অনুমোদন ছিলো না।

লঞ্চ ডুবলে ঘটনার পর শুনবেন লঞ্চে ত্রুটি ছিল। ভবনে আগুন লাগার পর জানবেন যথাযথ অনুমোদন নেই। মাতালের মতো গাড়ি চালিয়ে মানুষ হত্যার পর জানা যাবে চালকের লাইসেন্স নেই। অথচ এসব তদারকের দায়িত্বে নানা কর্তৃপক্ষ আছে! কিন্তু কারো কোন জবাবদিহিতা নেই। এ এক বিস্ময়কর দেশ। এখানে শত শত মানুষ মরে গেলেও কারো হুঁশ হয় না। দায়িত্ব অবহেলায় কারো শাস্তি হয় না। তবে যে কোন ঘটনার পর তদন্ত কমিটি হবে, কয়েকদিন কথা হবে, তারপর আমরা ফের অপেক্ষা করি নতুন কোন দুর্ঘটনার! ভীষন কষ্ট লাগে।

সাংবাদিক হিসেবে গত দুই দশকে কতো দুর্ঘটনা আর কতো যে লাশ দেখেছি! এই দেশের প্রত্যেকটা দুর্ঘটনা আর মৃত্যুর কারণ খুঁজেন। দেখবেন অনিয়ম, দুর্নীতিসহ তদারককারী কর্তৃপক্ষের অবহেলা পদে পদে। বিআরটিএ বলেন, ওয়াসা বলেন, তিতাস বলেন, রাউজক বলেন, প্রত্যেকটা সরকারি সেবা সংস্থার বেহাল দশা। আচ্ছা স্বাধীনতার তো ৫২ বছর হলো! এভাবে আর কতদিন চলবে? স্বজন হারাদের এই আর্তনাদ আর কতোকাল চলবে? আর কতো মানুষ মরলে আমাদের হুশ হবে? আর কতো?

এই যে একজন বাবা তার বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া সন্তানকে হারিয়ে চিৎকার করছেন, মারা যাচ্ছেন ঊর্ধ্বতন একজন সরকারি কর্মকর্তা, মারা যাচ্ছে মানুষ! আচ্ছা আর কতো শতো মানুষ মরলে সেই চিৎকার আমাদের কানে যাবে? নীতি নির্ধারকদের বোধ জাগবে? আর কতো শতো মানুষ মরলে তদারকি কর্তৃপক্ষের জবাবদিহিতা আসবে?

এই যে ঢাকা শহরটাকে আমরা মেরে ফেলছি, ধ্বংস করছি পুরো দেশ এর শেষ কোথায়? একবার ভাবেন আপনি মন্ত্রী হন আমলা হন কোটি টাকার মালিক হন যাই হন ঢাকার যে কোন দুর্ঘটনায় যে কেউ মারা যেতে পারে। মনে রাখবেন যতো কোটি টাকা দামের গাড়িতেই আপনি চড়েন যতো বড়ে পদেই থাকেন আপনাকে ঘন্টার পর ঘন্টা যানজটে বসে থাকতে হবে। অথচ গণপরিবহন ব্যবস্থা ঠিক করে এই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব।

আমি বিশ্বাস করি, নীতি নির্ধারকের চাইলে, আমরা সবাই মিলে চাইলে এই দেশের প্রত্যেকটা সমস্যার সমাধান সম্ভব। এজন্য প্রয়োজন সুশাসন। প্রয়োজন জবাবদিহিতা। আপনারা যারা দেশ চালান, আপনারা যারা ক্ষমতাবান, আপনারা যারা নীতি নির্ধারক, আপনাদের কাছে হাতজোড় করে বলি, সুশাসন প্রতিষ্ঠা করুন। জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা করুন। এই দেশটা আমাদের! যারা মরছে আমাদের দেশের মানুষ তাঁরা। আমাদের স্বজন। কাজেই চলেন সবাই মিলে দেশটাকে ঠিক করি। আপনাদের দোহাই লাগে জেগে উঠুন!

Leave a Reply

Your email address will not be published.