ধান- নদী -খাল এই তিনে বরিশাল!

Spread the love

শরিফুল হাসান

ধান- নদী -খাল এই তিনে বরিশাল। আমাকে যদি কেউ জিজ্ঞেস করেন এই মুহূর্তে বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দর ও বসবাসযোগ্য বিভাগীয় শহর কোনটি রাজশাহীর পরেই বলব বরিশালের নাম। সাংবাদিকতা বা কাজের সুবাদে আমি ঠিক কতোবার এই শহরে এসেছি হিসেব নেই। নিরিবিলি এই শহরটির সবুজ প্রকৃতি বিশেষ করে কীর্তনখোলা নদী আমার বেশ ভালো লাগে।

জেলার ইতিহাস বলছে, চতুর্দশ শতাব্দী পর্যন্ত বরিশাল অঞ্চল চন্দ্রদ্বীপ নামে প্রসিদ্ধ ছিল। মুসলিম শাসনের আধিপত্য বিস্তার কালে রাজা দনুজমর্দন কর্তৃক ‘চন্দ্রদ্বীপ’ নামে এ স্বাধীন রাজ্যটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এর আগে এ অঞ্চল ‘বাকলা’ নামে পরিচিত ছিল। মূলত বাকলা বন্দরে আরব ও পারস্যের বণিকরা বাণিজ্য করতে আসতেন। ১৭৯৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এই জেলা বাকলা-চন্দ্রদ্বীপ নামে পরিচিত ছিল। ব্রিটিশরা আসার পর বাকেরগঞ্জে ম্যাজিস্ট্রেসি প্রতিষ্ঠায় ১৭৯৭ সালে বাকলা-চন্দ্রদ্বীপ নিয়ে বাকেরগঞ্জ জেলা প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮০১ সালের ১ মে জেলার সদর দপ্তর বর্তমানে বরিশাল শহরে স্থানান্তরিত করেন।

পরবর্তীতে বরিশাল নামেই এই জেলা পরিচিতি পায়। বরিশালের ইতিহাস গ্রন্থে সিরাজউদ্দিন আহমেদ বলেছেন ‘বাঙ্গালী জাতির আদি বাসস্থান ছিল চন্দ্রদ্বীপ’। এখানকার কুলিনসমাজ ‘বাকলা সমাজ’ নামে খ্যাত ছিল।

৭ম শতকে এখানে সামন্ত প্রথা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর তালুকদার জমিদারগণ সমাজে প্রথম শ্রেণী হিসেবে বিবেচিত হতেন। দেশের অন্যান্য অঞ্চলের সাঁওতাল, গারো, হাজং, মগ ও চাকমাদের মতো বরিশাল অঞ্চলে ‘চন্দ্রভদ্র’ নামে এক জাতির বাস ছিল। কেন এই জেলার নাম বরিশাল তা নিয়ে অনেক অনেক মতভেদ আছে।

কেউ কেউ বলেন বড় বড় শালগাছের কারণে (বড়+শাল= বরিশাল); পর্তুগীজ বেরী ও শেলীর প্রেম কাহিনীর জন্য বরিশাল; বড় বড় লবণের গোলার জন্য বরিশাল। এই গিরদে বন্দরে (গ্রেট বন্দর) ঢাকার নবাবদের বড় বড় লবণের চৌকি ছিল। লবণের বড় বড় চৌকি ও লবণের বড় বড় দানার জন্য ইংরেজ ও পর্তুগীজ বণিকরা এ অঞ্চলকে ‘বরিসল্ট’ বলত। এ বরিসল্ট পরিবর্তিত হয়ে বরিশাল হয়েছে বলে অনেকের ধারণা।

পাকিস্তান আমলে বরিশাল জেলায় মোট ০৬টি মহকুমা ছিল। ১৯৬৯ সালে পটুয়াখালী ও বরগুনা মহকুমার সমন্বয়ে পটুয়াখালী জেলা গঠন করা হয়। পরবর্তীতে প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাসের ফলে ১৯৮৪ সালে বরগুনা একটি নতুন জেলা হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এছাড়া, তৎকালীন বরিশাল জেলার ঝালকাঠী, পিরোজপুর ও ভোলা মহকুমাকেও জেলায় উন্নীত করা হয়। বর্তমানে এ বিভাগে জেলার সংখ্যা মোট ০৬টি।

জেলাগুলো হলো : বরিশাল, পটুয়াখালী, ভোলা, পিরোজপুর, বরগুনা ও ঝালকাঠী।বরিশাল আজ দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ নদীবন্দর। বাংলাদেশের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনে বরিশাল অসাধারণ স্থান দখল করে আছে। বাঙালির অনেক কীর্তি আর কৃতিত্বের সাথে জড়িয়ে আছে বরিশালের নাম।

শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, কবি সুফিযা কামাল, কবি জীবনানন্দ দাশ, চারণকবি মুকুন্দ দাস, সমাজসেবক অশ্বিনী কুমার দত্ত, বীরশ্রেষ্ঠ মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরসহ আরো অনেক কীর্তিমান জন্ম নিয়েছেন বরিশালে। বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন, স্বাধীনতা আন্দোলনসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক আন্দোলনে বরিশাল উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে। বাংলার শস্য ভান্ডার বরিশাল একদা ‘এগ্রিকালচারাল ম্যানচেস্টার’ হিসেবে পরিচিত ছিল। বরিশালের অর্থনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছিল বাংলার অর্থনীতি।

সুজলা-সুফলা-শস্য-শ্যামলা এ অঞ্চল প্রাচীনকাল থেকে দিয়ে এসেছে অফুরন্ত ধন-সম্পদ আর সীমাহীন প্রাচুর্য। প্রাচীনকাল থেকে পলি গঠিত উর্বর এ অঞ্চল ছিল কৃষির জন্য উৎকৃষ্ট এবং বসবাসের জন্য উত্তম। কৃষিই ছিল এ দেশের অর্থনীতির মূল উৎস। পর্যটক রালফ ফিস ১৫৮০ সালে বাকলাকে অত্যন্ত সম্পদশালী আখ্যায়িত করে এখানকার প্রচুর চাল, কার্পাস, রেশমবস্ত্র ও সুবৃহৎ ঘরের কথা উল্লেখ করেছেন। এ কারণেই প্রাচীন কাল থেকে এ অঞ্চল বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের জনগোষ্ঠীকে আকর্ষণ করে আসছে।

প্রাচুর্যের কারণে বাকলায় সাগরপথে আরব বণিকগণ বাণিজ্য করতে আসতেন। আজকের মধ্যপ্রাচ্যের ন্যায় সেকালে এ ভূ-খন্ডটি ছিল বিশ্ববাসীর অন্যতম লোভনীয় অঞ্চল। মেঘনা, আড়িয়াল খাঁ, কীর্তনখোলা, তেঁতুলিয়া, নয়াভাঙ্গা, জয়ন্তি, স্বরূপকাঠি, হাতরা, আমতলিসহ অনেক নদী আছে এখানে। আছে অসংখ্য খাল। তবে আফসোসের বিষয় হলো দখল আর অবহেলায় এসব খাল দখল হচ্ছে। ধ্বংস হচ্ছে।‌ এগুলো ভবিষ্যতের জন্য শঙ্কার।

তবে শিল্পায়ন না হওয়ায় এবং প্রচুর কৃষিজমি থাকার কারণে আজও দেশের খাদ্যশস্য ও মৎস্য উৎপাদনের অন্যতম মূল উৎস বরিশাল। অবশ্য শিল্প কারখানা সেভাবে না থাকার কারণে এখানকার অর্থনীতিও কৃষি নির্ভর। অবশ্য আগামী মাস থেকে পদ্মা সেতু চালু হলে খুব দ্রুত বদলে যাবে বরিশালের অর্থনীতিসহ বহু কিছু। তবে এজন্য যথাযথ পরিকল্পনা দরকার। সেটা ঠিকমতো হলে বরিশাল যে বাংলাদেশের আরো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। সবাইকে বরিশাল থেকে শুভ সকাল। শুভ সকাল বাংলাদে

Leave a Reply

Your email address will not be published.