শরিফুল হাসান
রাজধানী শহরে ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর পরদিন গতকাল ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের নারায়ণগঞ্জ অংশের বিভিন্ন এলাকায় তাণ্ডব চালিয়েছে হেফাজতে ইসলাম। তারা গাছ ফেলে সড়ক অবরোধ করে এবং হাইওয়ে পুলিশের ফাঁড়িসহ বিভিন্ন স্থাপনা ও সড়কে আগুন দেয়। এ সময় পুলিশ-র্যাব-বিজিবির সঙ্গে সংঘর্ষে ২০ জন নিহত হন। আহত হন দেড় শতাধিক। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে দুই পুলিশ ও বিজিবির এক সদস্য রয়েছেন।এ ছাড়া গতকাল হেফাজতে ইসলামের সড়ক অবরোধকালে চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে পুলিশের গুলিতে সংগঠনটির দুই কর্মী এবং সেনাবাহিনীর এক সদস্যসহ ছয়জন নিহত হয়েছেন। হেফাজতের কর্মীরা সেখানেও তাণ্ডব চালান। আর বাগেরহাটে নিহত হয়েছেন হেফাজতের এক কর্মী। এ নিয়ে গতকাল মোট ২৭ জন নিহত হলেন। আগের দিন রোববার রাজধানীতে ব্যাপক সহিংসতায় মারা যান ২২ জন।গতকাল সোমবার ভোর থেকে দুপুর পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার সিদ্ধিরগঞ্জ, সাইনবোর্ড থেকে সানারপাড়-শিমরাইল হয়ে সোনারগাঁ উপজেলার কাঁচপুর পর্যন্ত পাঁচ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এর ফলে বেলা তিনটা পর্যন্ত ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে যান চলাচল বন্ধ থাকে।পুলিশ বলছে, হেফাজতের অবরোধ সরাতে গেলে কর্মীরা হামলা চালান। এতে সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়। এ সময় কাঁচপুর পুলিশ ফাঁড়ি, সিদ্ধিরগঞ্জের পুলিশ ক্যাম্প, বিদ্যুৎ কার্যালয় ও কুয়েত প্লাজা মার্কেটে হামলা-ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। পুলিশ, বিজিবির তিনটি গাড়িসহ ২০টি যানবাহনে আগুন দেওয়া হয়। পুলিশ ও র্যাব কয়েক হাজার কাঁদানে গ্যাসের শেল ও রাবার বুলেট ছোড়ে। একপর্যায়ে গুলি শেষ হয়ে গেলে বিজিবি ও পুলিশের অতিরিক্ত সদস্য সেখানে যান।নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক মনোজ কান্তি বড়াল প্রথম আলোকে বলেন, হেফাজত নারকীয় তাণ্ডব চালিয়েছে। পুলিশ, র্যাব-বিজিবি কেউই হামলা থেকে রেহাই পায়নি। নির্বিচারে সরকারি দপ্তর ও যানবাহনে আগুন দেওয়া হয়েছে।বিভীষিকাময় ছয় ঘণ্টা: প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, গতকাল ফজর নামাজের পর হেফাজতের হাজার হাজার কর্মী সিদ্ধিরগঞ্জ থানার সানারপাড় এলাকায় মাদানীনগর দারুল উলুম মাদ্রাসার সামনে জড়ো হতে থাকেন। ঢাকা থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হেফাজতের অনেক কর্মী তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন। ফজর নামাজের পর তাঁরা গাছের গুঁড়ি ও বাঁশ ফেলে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ করেন।পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, মহাসড়ক থেকে তাঁদের সরে যাওয়ার অনুরোধ জানালে তাঁরা পুলিশকে লক্ষ করে ইটপাটকেল ছোড়েন। পুলিশ ধাওয়া দিলে তাঁরা মাদ্রাসার ভেতরে আশ্রয় নেন। পুলিশ ওই মাদ্রাসায় তল্লাশি চালানোর জন্য ঢোকার চেষ্টা করলে পেছনের বাগমারা জামে মসজিদের মাইক থেকে বলা হয়, যুবলীগ, ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের সঙ্গে নিয়ে পুলিশ মাদ্রাসায় হামলা চালিয়েছে। সবাই প্রতিরোধ করুন।মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মুফতি মোহাম্মদ ফায়জুল্লাহ হামলার অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘আমাদের মাদ্রাসার ছাত্ররা হেফাজতের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়, বরং বহিরাগতরা মাদ্রাসার ভেতরে ঢুকে তাণ্ডব চালায়। তখন পাশের মসজিদ থেকে তাদের প্রতিহত করার ঘোষণা দেওয়া হয়।’ওই ঘোষণার পর হেফাজতের সমর্থকেরা লাঠিসোঁটা, রামদা ও দেশি অস্ত্র নিয়ে পুলিশের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। পুলিশ কাঁদানে গ্যাসের শেল ও রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে।প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, হেফাজতের কর্মীদের আক্রমণে প্রথমে অসহায় হয়ে পড়ে পুলিশ। পরে যোগ দেয় র্যাব ও বিজিবি। এরপর সানারপাড়, সাইনবোর্ড, চিটাগাং রোড, হিরাঝিল, মৌচাক ও কাঁচপুরের ৫০টি স্থানে দুই পক্ষের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়।নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আশরাফুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, হেফাজতের কর্মীরা সানারপাড় এলাকায় ২৬ জন পুলিশের একটি দলের ওপর চারদিক থেকে হামলা করে কোপাতে থাকেন। এখানে কোপের আঘাতে পুলিশের দুই সদস্য কনস্টেবল ফিরোজ ও জাকারিয়া গুরুতর আহত হন। ঢাকায় নেওয়া হলে তাঁরা মারা যান। শিমরাইল মোড় এলাকায় হামলা হয় বিজিবি-র্যাবের গাড়িতেও। এতে বিজিবির নয় সদস্য আহত হন এবং চারজনকে গুরুতর অবস্থায় ঢাকায় পাঠানো হয়। ঘটনার সময় দায়িত্ব পালনকালে নিউ এজ পত্রিকার আলোকচিত্রী সৌরভ লস্করের ক্যামেরা ছিনিয়ে নেয় হেফাজতে ইসলাম।হেফাজতের কর্মীরা সকালেই কাঁচপুর হাইওয়ে থানা ও পুলিশ ফাঁড়িতে আগুন ধরিয়ে দেন। এর আগে সাইনবোর্ড এলাকায় ট্রাফিক পুলিশ বক্সেও আগুন দেওয়া হয়। শিমরাইল এলাকায় তিতাস গ্যাস ও ডেসকোর আঞ্চলিক অফিসে হামলা ও আগুন দেওয়া হয়। এ ছাড়া বিআরটিসির দুটি বাস, জ্বালানি তেল বহনকারী ট্যাংকারসহ ১০টি গাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ভাঙচুর করা হয় অর্ধশতাধিক যানবাহন। বিকেলের দিকে আরও পুলিশ ও বিজিবি এলে পরিস্থিতি শান্ত হয়।নিহতদের পরিচয়: হামলায় বিজিবির নায়েক সুবেদার শাহ আলম (৪০), পুলিশের কনস্টেবল ফিরোজ (৩৫) ও জাকারিয়া (২৮) নিহত হয়েছেন। তাঁদের কুপিয়ে, পিটিয়ে ও ইট দিয়ে মাথা থেঁতলে হত্যা করা হয়।প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, কাঁচপুর ও সিদ্ধিরগঞ্জ শিল্পাঞ্চলের বিভিন্ন কারখানার শ্রমিক, কর্মচারী কর্মস্থলে যাওয়ার পথে সংঘর্ষের মাঝে পড়েন। তাঁদের অনেকে মারা গেছেন।নিহত ব্যক্তিরা হলেন সিদ্ধিরগঞ্জের পাইনাদি নতুন মহল্লার আলী আহম্মেদের ছেলে সিএনজিচালক জসিমউদ্দিন (৩২), ইদ্রিস আলীর ছেলে হান্নান (৩২), মাদানীনগরের আবদুল খালেকের ছেলে পলাশ (২৫), নিমাইকাঁসারী এলাকার শহীদুল্লাহর ছেলে সুতা ব্যবসায়ী নাজির আহম্মেদ (৩০), একই এলাকার কায়কোবাদের ছেলে দনিয়া কলেজের এইচএসসি দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ওসমান গনি (১৮), ডেমরার বাচ্চু বাবুর্চির ছেলে পোশাক কারখানার কর্মী রুবেল (২৫), একই এলাকার ভ্যানচালক সাদেক (৩২), সিদ্ধিরগঞ্জের পূর্ব নিমাইকাঁসারীর আবু মুন্সীর ছেলে রিকশাচালক হাবিবুল্লাহ (৩৪), পূর্ব বাগমারার এনামুল হকের ছেলে মাজহারুল ইসলাম (১৬), শহরের সমবায় সুপার মার্কেটের ফাহিম ফ্যাশনের কর্মচারী সাইফুল (৩৬), শরীয়তপুর জেলার নড়িয়া থানার উপসি গ্রামের আলী হোসেনের ছেলে বাবু গাজী (৩৬), সিদ্ধিরগঞ্জের রসুলবাগের আলী আকবর স্কুলের শিক্ষক নাজমুলের ছোট ভাই খালেদ (১৬), ডেমরার ধলেশ্বরে মোকাররম মিয়ার ছেলে সাইদুল (২৮), জুয়েল (২৫), চাঁদপুরের তাহের কারীর ছেলে নিমাইকাঁসারীর বাসিন্দা রাজমিস্ত্রি আবদুল গফুর (৩৫), কাভার্ড ভ্যানের হেলপার মিজানুর রহমান (২০) এবং চাঁদপুরের খাসেরবাড়ী এলাকার বাবুলের ছেলে মাছুম (৩৫)।নারায়ণগঞ্জের খানপুরে অবস্থিত ২০০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা নাজিমউদ্দিন জানান, তাঁর হাসপাতালে আহত অবস্থায় এসেছেন ২৯ জন সাধারণ মানুষ, ১৪ জন পুলিশ ও বিজিবির নয়জন সদস্য। তাঁদের মধ্যে বিজিবির চারজন ও পুলিশের তিনজনকে ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। এ ছাড়া গুরুতর আহত ২২ জনকে ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। শহরের মণ্ডলপাড়ায় অবস্থিত ১০০ শয্যাবিশিষ্ট নারায়ণগঞ্জ জেনারেল (ভিক্টোরিয়া) হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান জানান, তাঁর হাসপাতালে তিনটি লাশ ময়নাতদন্তের জন্য পুলিশ দিয়ে গেছে। তবে পুলিশ নাম-পরিচয় না দেওয়ায় সেগুলোর ময়নাতদন্ত করা হয়নি।প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, পুলিশের আহত সদস্যদের মধ্যে সুবেদার সোলায়মান হককে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে, কনস্টেবল মাহবুব, তানভীর আহমেদ, আনোয়ার, হাসান আলী, মোয়াজ্জেম, নাহিন, কামরুজ্জামান, সাহেব আলী, গুলজার, মোয়াজ্জেম, তাজুল ইসলাম, এএসআই মমতাজকে নারায়ণগঞ্জ ২০০ শয্যা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। বিজিবির আহত সদস্যদের মধ্যে লাভলু, আনোয়ার, ইসমাইলকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ও মোস্তাকিন, আলম, হামিদ, গুলজারকে নারায়ণগঞ্জ ২০০ শয্যার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। গুরুতর আহত ২১ জনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।সাংবাদিকেরা হামলার শিকার: সাংবাদিক দেখামাত্রই তাঁদের ওপর হামলা চালান হেফাজতের কর্মীরা। হামলার শিকার হন যুগান্তর পত্রিকার ফটো সাংবাদিক শামীম নূর। তাঁকে উদ্ধার করতে গিয়ে প্রহূত হন ওই পত্রিকার ফতুল্লা প্রতিনিধি জাবেদ আহমেদ। সকাল পৌনে সাতটায় হেফাজতের রোষানলে পড়েন বাংলানিউজের তানভীর হোসেন। এ ছাড়া চ্যানেল আইয়ের গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়, মারধর করা হয় রিপোর্টার রিজওয়ান কাদের ও ক্যামেরাম্যান হাবিবকে। হামলার শিকার হন জনকণ্ঠের আলোকচিত্রী শিপন আহমেদ, ইত্তেফাকের তাপস সাহা, দৈনিক সমকালের মেহেদী হাসান ও দৈনিক দেশের আলোর মোহাম্মদ কাইউম।আড়ালে জামায়াত: সানারপাড়, সাইনবোর্ড ও শিমরাইল মোড় এলাকায় তাণ্ডবের সময় জামায়াত-শিবিরের অনেক কর্মী অংশ নিয়েছেন বলে জানিয়েছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা। এ ছাড়া হিরাঝিলসহ কয়েকটি এলাকায় হেফাজতের কর্মীদের সঙ্গে বিএনপির কর্মীরাও হামলায় অংশ নেন। পুলিশ সুপার সৈয়দ নুরুল ইসলাম অভিযোগ করেন, হামলায় অনেক জামায়াত-শিবির ও বিএনপির কর্মীরা হেফাজতের সঙ্গে ছিলেন।