চলুন জীবনের চাপের গ্লাসটা নামিয়ে রাখি

Spread the love

শরিফুল হাসান

মনোবিজ্ঞানী তাজুল ইসলাম যখন অর্ধেক পানির একটা গ্লাস নিয়ে সবার সামনে এলেন উপস্থিত বেশিরভাগ মানুষই মনে মনে হাসলেন। বেদনা, অসহায়ত্ব কিংবা জীবনের প্রচণ্ড চাপ কীভাবে সামলাতে হয় সেই বিষয়ে আজ দেশের প্রতিষ্ঠিত কিছু মানুষের সঙ্গে কথা বলতে এসেছেন এই মনোবিজ্ঞানী। সরকারি-বেসরকারি নানা চাকুরিজীবী, ব্যাংকার, প্রকৌশলী, ডাক্তার, সাংবাদিক, বিচারকসহ নানা পেশার মানুষ আজকের শ্রোতা। সে কারনেই হেলাল আহমেদ যখন একটা গ্লাসে অর্ধেক পানি হাতে নিলেন, বেশিরভাগই ধারণা করলেন, এই মনোবিজ্ঞানী জিজ্ঞাসা করবেন গ্লাসটা কী অর্ধেক খালি না অর্ধেক পূর্ণ? কিন্তু বাস্তবের প্রশ্নটা শুনে সবাই চমকে গেলেন। মনোবিজ্ঞানী তাজুল ভিন্ন এক প্রশ্ন করে বসলেন সবাইকে। জানতে চাইলেন, এই গ্লাসের ওজন কতো? ‌

উপস্থিত বেশিরভাগই উত্তর খুঁজে পাচ্ছিলেন না। বিজ্ঞান বিষয়ে লেখাপড়া করেছেন এমন কেউ একজন বললেন, ২৫০ গ্রাম। আরেকজন বললেন, ৩০০ গ্রাম। এভাবে এ‌কেকজন একেকটা উত্তর দিলেন।সবার উত্তর শুনে মনোবিজ্ঞানী স্মিত হেসে বললেন, আসলে এই গ্লাসের ওজন কোন ব্যাপার না। কারন, সেটি নির্ধারন করবে আপনি কতোক্ষণ ধরে সেটি ধরে থাকবেন তার ওপর!উত্তরটা সবার মাথার ওপর দিয়ে গেল। প্রশ্ন ভরা দৃষ্টিতে উপস্থিত সবাই তাকিয়ে থাকলে মনোবিজ্ঞানীর দিকে।

এরপর ব্যাখা শুরু করলেন মনোবিজ্ঞানী। তিনি বলতে শুরু করলেন, ধরুন আপনি এক মিনিট গ্লাসটা ধরে থাকলেন। আপনার কাছে তখন মনেই হবে না এই গ্লাসের কোন ওজন আছে। বরং আপনি গ্লাসটা হাতে নিয়ে হাসতে হাসতে এর ওর সাথে গল্প করতে পারবেন। নানা কাজও করতে পারবেন। নানান ভাবনা ভাবতে পারবেন। কিন্তু যদি আপনাকে টানা এক ঘন্টা এই গ্লাস ধরে রাখতে হয়, আপনার আঙ্গুলগুলো ব্যাথা হয়ে যাবে। আপনি প্রচন্ড বিরক্ত হবেন। আর যদি সেটা ছয় ঘন্টা ধরে রাখতে হয়, কিংবা ১২ ঘন্টা! আপনার যন্ত্রনা তখন ভয়াবহ আকার ধারন করবে!ততোক্ষণে সবাই ভাব‌তে শুরু করেছে। আসলেই তো তাই। ১২ ঘন্টা ধরে কীভাবে একটা গ্লাস ধরে রাখা যায়!

মনোবিজ্ঞানী বলে চলছেন যদি ধরেন ২৪ ঘন্টা আপনাকে ধরে রাখতে হয় গ্লাসটাকে তাহলে আপনার পুরো শরীরই অসাড় হয়ে যাবে। আচ্ছা আপনাকে যদি বলা হয়, এক সপ্তাহ ধরে রাখতে হবে। কিংবা এক মাস। কেউ কেউ তখন পাগল হয়ে আত্মহত্যার কথাও ভাবতে পারেন। আর যদি বলা হয় আজীবন ধরে থাকতে হবে! পুরো পৃথিবীই তখন আপনার কাছে অর্থহীন মনে হবে। এমনকি বেঁচে থাকাও। অথচ ভেবে দেখেন গ্লাসটির ওজন এক বিন্দু বাড়েনি, কমেওনি। আসলে আপনি কতোক্ষণ ধরে ছিলেন সেটার উপর নির্ভর করেছে এটা কতো ভারী! মানুষের জীবনের কষ্ট, যন্ত্রণা, বেদনা, চাপও ঠিক তেমন।

মনোবিজ্ঞানী বলে চলেছেন, মানুষের জীবনে যতো কষ্টই থাকুক কিংবা যতো চাপ, সেটি আসলে কতোটা ভারী হবে তা নির্ভর করে কতোক্ষণ আপনি সেটা বহন করে যাচ্ছেন। কাজেই সুস্থভাবে বাঁচতে চাইলে এইসব চাপ মুহুর্তের মধ্যে জীবন থেকে বাদ দিন। মুহুর্তের মধ্যে না পারলে সময় নিন। যতো দ্রুত সম্ভব ঝেড়ে ফেলুন। কারণ যতো সময় আপনি সেটা নিয়ে ভাববেন, যতো সময় সেটা ধরে থাকবেন আপনার জীবন ততোই যন্ত্রনাময় হয়ে উঠবে। একসময়ে আপনি আর এই যন্ত্রণা ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারবেন না। কিছুতেই মনোযোগ দিতে পারবেন না। আপনার পুরো জীবন তখন অসাড় হয়ে যাবে।

আশা করছি আমার এই লেখাটার অর্থ বুঝেছেন। বছর সাতেক আগে আমি ইন্টারনেটে ইং‌রে‌জি‌তে ছোট্ট একটা লেখা পেয়েছিলাম যার মূল কথা কোন যন্ত্রণা আঁকড়ে ধরে থাকবেন না। আসলে মনোবিজ্ঞান নিয়ে আবার পড়াশোনা নেই বললেই চলে। কিন্তু মাঝে মাঝে মনে হয় আমি বোধহয় মানুষের দুঃখ কষ্ট যন্ত্রণা বুঝতে পারি বা অন্তত বোঝার চেষ্টা করি। সে কারণেই এই লেখাটা লিখি ছয় বছর আগে যার উদ্দেশ্য ছিল, মানুষকে বোঝানো, নিজেকে বোঝানো যে যন্ত্রণা বা চাপ আঁকড়ে থাকতে নেই।

আমাদের নগরজীবনে এমনিতে নানা সংকট। এর মধ্যে গত বছর থেকে করোনা মহামারী চলেছ। অনেকে চাকুরি হারাচ্ছেন। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ। মানসিক চাপ নানান ভাবে আমাদের ঘিরে ধরেছে। তাই মনে হলো লেখাটা আজ আবার শেয়ার করি। একটু ভেবে দেখেন, আপনার আমার প্রত্যেকের জীবনে অনেক যন্ত্রণা, অনেক কষ্ট আছে। কারো ব্যক্তি জীবনের কষ্ট, কারো পারিরাবারিক, কেউ চাকু‌রি খুঁজছেন, কেউ চাকু‌রি নি‌য়ে হতাশ, কেউ চাকরি ছেড়ে দিতে চাইছেন, কাউকে আবার চাকরি ছেড়ে দিতে চাইছে, কারও আবার সামা‌জিক বা পারিবারিক নানা সংকট। আসলে সংকট বা চাপ ছাড়া কারও জীবন নেই।

মনে রাখবেন, যা হবার তা হবেই। কাজেই যা হবার তা হোক। নিজে কোন কিছু জটিল না করে সরলপথে চলুন। পারলে আরেকজনের বিপদে পাশে থাকুন। মানবিক হন। আর জীবনের কষ্ট বা চাপের সেই গ্লাসটা চলুন নামিয়ে রাখি। যত দ্রুত এই চাপটা নামাতে পারবেন ততই স্বস্তি। ভালো থাকুন সবাই। ভালো থাকুক প্রিয় বাংলাদেশ।

Leave a Reply

Your email address will not be published.