শরিফুল হাসান
গণ-আদালত থেকে ট্রাইব্যুনাল। ১৯৯২ থেকে ২০১৩। শহীদজননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিতে দেশব্যাপী তীব্র আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। ১৯৯২ সালের ২৬ মার্চ প্রতিষ্ঠিত হয় গণ-আদালত। প্রতীকী বিচারে জামায়াতের সে সময়ের আমির গোলাম আযমের অপরাধ মৃত্যুদণ্ডতুল্য বলে রায় দেয় গণ-আদালত। এর প্রায় ২১ বছর পর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রথম রায়ে যুদ্ধাপরাধী আবুল কালাম আযাদের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ হলো।যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে সোচ্চার নাগরিকেরা মনে করেন, এখন যে বিচার চলছে, তা জাহানারা ইমামের আন্দোলনেরই ফসল। এর আগে মুক্তিযুদ্ধকালে গণহত্যা, ধর্ষণসহ যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য দেশ স্বাধীনের পরই আইন করেছিল সে সময়ের সরকার। কিন্তু বঙ্গবন্ধু হত্যার পর সরকারগুলো এ অবস্থান থেকে সরে আসে। ’৯২ সালে জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে তীব্র আন্দোলনের কারণে এই দাবি আবার জেগে ওঠে। ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির কার্যনির্বাহী সভাপতি শাহরিয়ার কবির প্রথম আলোকে জানান, ’৯১ সালের ২৯ ডিসেম্বর জামায়াতে ইসলামী গোলাম আযমকে দলের আমির ঘোষণা করে। এতে সারা দেশে বিক্ষোভ শুরু হয়। শহীদজননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ’৯২ সালের ১৯ জানুয়ারি গঠিত হয় একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। ১১ ফেব্রুয়ারি সমমনা ৭০টি দল ও সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত হয় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি। এর আহ্বায়ক হন জাহানারা ইমাম।পরের বছরের ২৬ মার্চ সমন্বয় কমিটি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গণ-আদালত বসিয়ে গোলাম আযমের যুদ্ধাপরাধের প্রতীকী বিচার করে। গণ-আদালতে গোলাম আযমের বিরুদ্ধে ১০টি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আনা হয়। ১২ সদস্যের গণ-আদালতের চেয়ারম্যান জাহানারা ইমাম ১০টি অপরাধ মৃত্যুদণ্ডযোগ্য ঘোষণা করে রায় দেন এবং ওই রায় কার্যকর করতে সরকারের প্রতি দাবি জানান।কিন্তু তখন বিএনপির সরকার জাহানারা ইমামসহ ২৪ জন বিশিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা করে। হাইকোর্ট তাঁদের জামিন মঞ্জুর করেন। ১২ এপ্রিল জাহানারা ইমাম পদযাত্রা করে গণ-আদালতের রায় কার্যকর করার দাবিসংবলিত স্মারকলিপি নিয়ে সংসদে যান। ১০০ জন সাংসদ গণ-আদালতের রায়ের প্রতি সমর্থন জানান। এ সময় গণ-আদালতের রায় বাস্তবায়নের আন্দোলন আরও বেগবান হয়। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবির আন্দোলনকে সমর্থন দেয় ইউরোপীয় পার্লামেন্ট।১৯৯৩ সালের ২৬ মার্চ গণ-আদালতের বার্ষিকীতে জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গঠিত গণতদন্ত কমিশন আরও আটজন যুদ্ধাপরাধীর নাম ঘোষণা করে। তাঁরা হলেন: আব্বাস আলী খান, মতিউর রহমান নিজামী, মো. কামারুজ্জামান, আবদুল আলীম, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, মাওলানা আবদুল মান্নান, আনোয়ার জাহিদ ও আবদুল কাদের মোল্লা।১৯৯৪ সালের ২৬ মার্চ পাঁচ লাখের বেশি মানুষের উপস্থিতিতে বিশাল জনসমাবেশে গণতদন্ত কমিশনের চেয়ারম্যান কবি বেগম সুফিয়া কামাল জাহানারা ইমামের হাতে জাতীয় গণতদন্ত কমিশনের প্রতিবেদন হস্তান্তর করেন। জাহানারা ইমামের বিরুদ্ধে যে মামলাটি হয়েছিল ১৯৯৬ সালে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার শহীদজননীসহ ২৪ জনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের সেই মামলাটি প্রত্যাহার করে। আর বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার শুরু করে। গতকাল এর প্রথম রায় হয়।বর্তমান সরকারের আগে যুদ্ধাপরাধের বিচারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল দেশ স্বাধীনের পরপরই। ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি এ জন্য ‘দালাল আইন (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) আদেশ’ জারি করে সরকার। ১৯৭৩ সালে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার আগে পর্যন্ত ৩৭ হাজার ৪৭১ জন দালালকে গ্রেপ্তার করে ওই আইনের আওতায় ৭৩টি বিশেষ ট্রাইব্যুনালে বিচার শুরু করা হয়। তখন দুই হাজার ৮৪৮টি মামলার বিচার সম্পন্ন হয়। রায়ে ৭৫২ জন বিভিন্ন মেয়াদে দণ্ডিত হন। এরপর যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন করা হয় ১৯৭৩ সালে (১৯ নম্বর আইন)। ওই আইনে গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার করার সিদ্ধান্ত হয়। তবে ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড-পরবর্তী সরকারগুলো যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বদলে তাঁদের রাষ্ট্রক্ষমতায় পুনর্বাসিত করে। এরই ধারাবাহিকতায় দেশে ফেরেন গোলাম আযম।



