আসাদের শার্ট উড়ছে নীলিমায়

Spread the love

শরিফুল হাসান

জেনে বুঝে প্রতিবাদে নাম লেখানো এক তরুণের নাম আসাদ। তারিখটা ১৯৬৯ সা‌লের ২০ জানুয়ারি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৬ দফা দাবীর স্বপক্ষে এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় অন্যান্য আসামীদের মুক্তির দাবিতে উত্তাল ঢাকা‌। গোটা পূর্ব পাকিস্তানের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট ছিল সেদিন। সেই ধর্মঘট যেন পা‌লিত না হয় সেজন্য পাকিস্তান সরকার ১৪৪ ধারা জা‌রি ক‌রে। এর মধ্যেই মিছিল বের করার সিদ্ধান্ত হয়। রাজপথে দশহাজার ছাত্রের বিশাল মিছিল ১৪৪ ধারা ভেঙ্গে। সামনের সারিতে আসাদ।

পুরো নাম আমানুল্লাহ মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান। জন্ম ১৯৪২ সা‌লের ১০ জুন নর‌সিং‌দি‌তে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের শেষ বর্ষের ছাত্র ছিলেন আসাদ। তখনকার তারুণ্যের স্লোগান ছিলো, এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়। আসাদ ছিলেন সেই মিছিলে?

পূর্ব পরিকল্পনা অনুসারে দুপুরে ছাত্রদেরকে নিয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের পার্শ্বে চাঁন খাঁ’র পুল এলাকায় মিছিল নিয়ে অগ্রসর হচ্ছিলেন আসাদ। পুলিশ তখন তাদেরকে চাঁন খাঁ’র ব্রীজে বাঁধা দেয় ও চলে যেতে বলে। কিন্তু বিক্ষোভকারী ছাত্ররা সেখানে অবস্থান নেয়। আসাদ ও তার সহযোগীরা স্লোগান দিতে থাকে। প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ পুলিশ। থামাতেই হবে আজ এদের। খুব কাছ থেকে আসাদকে লক্ষ্য করে এক পুলিশ অফিসার তখন গুলি করলো। রক্ত রাঙাল রাজপথ। গুরুতর আহত অবস্থায় আসাদকে হাসপাতালে নেয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত বলে ঘোষণা করেন।

এরপর র‌চিত হ‌লো নতুন ইতিহাস। বেলা তিনটায়় কোনো রকম প্রস্তুতি ছাড়াই স্বতঃস্ফূর্তভাবে বের হল জনতার শোক মিছিল। মেয়েদের নেতৃত্বে এই মিছিল অগ্রসর হতে থাকল। সাধারণ জনগণও সমানে যোগ দিতে লাগল। দুমাইল দীর্ঘ মিছিলটি শহরের বিভিন্ন রাস্তা প্রদক্ষিণ করে শহীদ মিনারে এসে শেষ হলো। শোকাতুর ও আবেগে আপ্লুত অগণিত ছাত্র-জনতার মিছিলে শহীদ আসাদের রক্তমাখা শার্ট দেখে বাংলা সাহিত্যের আধুনিক কবি শামসুর রাহমান লিখলেন তাঁর অমর কবিতা “আসাদের শার্ট”।

কবি হেলাল হাফিজ ক্রোধে ফেঁটে পড়ে লিখলেন তাঁর কালজয়ী “নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়” কবিতা। জনপ্রিয় আলোকচিত্র শিল্পী রশীদ তালুকদার তার ক্যামেরায় স্থিরচিত্র হিসেবে ছাত্র-জনতার দীর্ঘ মিছিলসহ আসাদের শার্টের ছবি তুলে রাখলেন।কেন্দ্রীয় প্রতিরোধ কমিটি ২২, ২৩ ও ২৪ জানুয়ারি সারাদেশে ধর্মঘট আহ্বান করল।

২৪ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের ছয় দফা ও ছাত্রদের ১১ দফার ভিত্তিতে সর্বস্তরের মানুষের বাঁধভাঙা জোয়ার নামে ঢাকাসহ সারা বাংলার রাজপথে। সংঘটিত হয় উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান। পতন ঘটল আইয়ুব খানের। আইয়ুব গেট হয়ে গেল আসাদ গেট। এরপর আরেক স্বৈরশাসক ইয়াহিয়া খান ক্ষমতায় বসলেন। পরিস্থিতি শান্ত করতে সাধারণ নির্বাচনের ঘোষণা দিলেন।

১৯৭০ সা‌লের সেই অভূতপূর্ব নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। এরই ধারাবাহিকতায় একাত্তর সালে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। জন্ম নিল স্বাধীন বাংলাদেশ।কী অসাধারণ ইতিহাস। লিখতে লিখতে আমার চোখ ভিজে যাচ্ছে। তরুণ প্রজন্মকে শহীদ আসাদের কথা জানাতেই আজকের সকালটা শুরু করলাম শহীদ আসাদের বৈপ্লবিক লড়াইয়ের গল্প দিয়ে যে গল্প মানে এই বাংলার ইতিহাস। শুভ সকাল শহীদ আসাদ। শুভ সকাল বাংলাদেশ। কবি শামসুর রাহমানের কথাতেই বলি,গুচ্ছ গুচ্ছ রক্তকরবীর মতো কিংবা সূর্যাস্তেরজ্বলন্ত মেঘের মতো আসাদের শার্ট উড়ছে হাওয়ায় নীলিমায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published.