অনিবন্ধিত রোহিঙ্গাদের সংখ্যা নির্ধারণের উদ্যোগ
শরিফুল হাসান
কক্সবাজারে অবস্থানরত অনিবন্ধিত রোহিঙ্গাদের সঠিক সংখ্যা নির্ধারণের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় পরিসংখ্যান ব্যুরো এ কাজটি করবে। কক্সবাজারে নিবন্ধিত রোহিঙ্গা রয়েছে প্রায় ৩৩ হাজার।
কক্সবাজারের প্রশাসন ও বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) তথ্য অনুযাযী, সীমান্ত রক্ষাকারী বাহিনীর কড়া পাহারা সত্ত্বেও মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ ঠেকানো যায়নি। সুনির্দিষ্ট কোনো জায়গায় তাদের নজরদারিতে রাখা যাচ্ছে না বলে কক্সবাজারের সর্বত্র তারা ছড়িয়ে পড়েছে। ঢুকেছে বিভিন্ন পেশায়। অনেকে কাজের সন্ধানে চট্টগ্রামসহ দেশের অন্যান্য জায়গায় চলে গেছে। অসাধু ব্যক্তিদের সহায়তায় বাংলাদেশি পাসপোর্ট বানিয়ে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশেও পাড়ি জমিয়েছে রোহিঙ্গারা।
মিয়ানমার থেকে বাস্তুভিটা ছেড়ে আসা অনিবন্ধিত রোহিঙ্গাদের সংখ্যা কারও মতে তিন লাখ, আবার কারও মতে চার লাখ। জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৪ সালের শেষে বিশ্বে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫ কোটি ৯৫ লাখে। এমন পরিস্থিতিতে আজ শনিবার অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও পালিত হবে আন্তর্জাতিক শরণার্থী দিবস। দিবসটি উপলক্ষে পাঠানো ইউএনএইচসিআরের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, নিজেদের বাস্তুভিটা ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হওয়া মানুষের সংখ্যা আকস্মিকভাবে বেড়ে গেছে।
বিজিবি, পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, রোহিঙ্গারা অনুপ্রবেশ করে কক্সবাজার সদর, উখিয়া ও টেকনাফসহ বিভিন্ন এলাকায় অস্থায়ীভাবে বসতি গড়েছে। অনেকেই মূল স্রোতে মিশে গেছে। কিন্তু কখনোই তাদের সঠিক সংখ্যা নির্ধারণের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
কক্সবাজারে অনিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা কত—জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘সুনির্দিষ্ট করে এই সংখ্যা বলা যাবে না। কেউ বলে তিন লাখ, কেউ চার লাখ, কেউ আরও বেশি। এর কোনো একটা হবে। তবে সরকার তাদের সঠিক সংখ্যা নির্ধারণের উদ্যোগ নিয়েছে। পরিসংখ্যান ব্যুরো এই কাজটি করবে। তাদের সহায়তা করবে কক্সবাজারের স্থানীয় প্রশাসন। এ কাজটি হয়ে গেলে আমরা বলতে পারব তাদের সঠিক সংখ্যা কত।’ রোহিঙ্গাদের এক জায়গায় রাখা যাচ্ছে না কেন—জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘তারা অনুপ্রবেশ করে ক্যাম্পের আশপাশে বসতি গড়ে। এরপর বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। আস্তে আস্তে মূল স্রোতে মিশে যায়।’
বিজিবির কর্মকর্তারা বলছেন, মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের ২৮৪ কিলোমিটার সীমান্ত¯রয়েছে। পুরো সীমান্তে সব সময় পাহারা দেওয়া সম্ভব নয়। আবার বাংলাদেশি এক শ্রেণির লোক অর্থের বিনিময়ে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশে সহায়তা করে। সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া থাকলে এই অনুপ্রবেশের পাশাপাশি চোরাচালানও বন্ধ হতো।
কক্সবাজার সিভিল সোসাইটির সভাপতি আবু মোরশেদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘কক্সবাজারে প্রায় পাঁচ লাখ রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশকারী পাহাড়-জঙ্গল দখল করে বসতি গড়েছে। বিভিন্ন কাজের পাশাপাশি তারা ইয়াবা বড়ি চোরাচালান ও মানব পাচারে জড়িয়ে গেছে। এমন রোহিঙ্গারা কক্সবাজারের জননিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ।’
কক্সবাজারের পুলিশ সুপার শ্যামল কুমার নাথ বলেন, ‘অনেক কারণেই রোহিঙ্গারা আসছে কিংবা হয়তো আসতে বাধ্য হচ্ছে। কিন্তু আশঙ্কার বিষয় হলো তারা বাংলাদেশে এসে নানা অপরাধে জড়াচ্ছে। তাদের মাধ্যমেই বাংলাদেশে ইয়াবা এসেছে। রোহিঙ্গারা মানব পাচারেও জড়িয়ে আছে। এ ছাড়া আরও অনেক অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। ভবিষ্যতে এই সংকট আরও বাড়বে। কাজেই তাদের সুনির্দিষ্ট কোনো জায়গায় রাখা এবং পরিচয় নিশ্চিত করা জরুরি।’
কক্সবাজারের শরণার্থী কার্যালয়ের (আরআরসি) তথ্য অনুযায়ী, উখিয়া উপজেলার কুতুপালং শরণার্থীশিবিরে এখন তালিকাভুক্ত রোহিঙ্গা ১২ হাজার। কিন্তু সরেজমিনে গেলে স্থানীয় লোকজন জানান, এদের সংখ্যা ৭০ থেকে ৯০ হাজার। কুতুপালং থেকে ৭০ কিলোমিটার দূরে টেকনাফের নয়াপাড়া শরণার্থীশিবিরে তালিকাভুক্ত রোহিঙ্গা ১৮ হাজার। কিন্তু এই শিবিরের কাছেই লেদা এলাকায় আছে অন্তত ২২ হাজার রোহিঙ্গা।
মেরিন ড্রাইভ সড়কের দুই পাশে কলাতলী, বড়ছড়া, হিমছড়ি, দরিয়ানগরসহ আশপাশের এলাকায় পাহাড়ে বসতি গড়েছে রোহিঙ্গারা। এ ছাড়া কক্সবাজার শহরের পাহাড়তলী, লারপাড়া, কলাতলী, আদর্শ গ্রাম, টিঅ্যান্ডটি পাহাড়, সার্কিট হাউস, সিটি কলেজ ও কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল এলাকায় ছোট-বড় ১২টি পাহাড়ে ১৫ হাজারের বেশি ঘরে বসতি প্রায় এক লাখ রোহিঙ্গার।
কক্সবাজার পৌরসভার মেয়র সরওয়ার কামাল বলেন, পাহাড় জঙ্গল সব জায়গায় এখন রোহিঙ্গাদের বসতি। পৌরসভার ভোটার তালিকায়ও ১৭ হাজার রোহিঙ্গা ঢুকে পড়েছিল। পরে তাদের বাদ দেওয়া হয়।
গোয়েন্দা পুলিশ ও স্থানীয় লোকজন জানান, এই জেলার মাছ ধরার নৌকাগুলোতে কাজ করে ৫০-৬০ হাজার রোহিঙ্গা। হোটেল-রেস্তোরাঁ, নির্মাণ, ধান কাটাসহ বিভিন্ন পেশায়ও আছে রোহিঙ্গারা। রোহিঙ্গা পুরুষের পাশাপাশি মেয়েরাও কাজ করছে। সমুদ্রসৈকতে পোনা ধরে প্রায় ৫০ হাজার রোহিঙ্গা নারী ও শিশু। রোহিঙ্গা মেয়েরা চট্টগ্রামের তৈরি পোশাক কারখানায়ও কাজ করছে।
উখিয়া বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ ও উখিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হামিদুল হক চৌধুরী বলেন, কক্সবাজারের বিভিন্ন জায়গার রোহিঙ্গাদের এক জায়গায় রাখা উচিত। বিভিন্ন জায়গায় তাঁরা এই প্রস্তাব দিয়েছেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে রোহিঙ্গাদের নোয়াখালীর হাতিয়ায় সরিয়ে নেওয়ার কথা বলা হচ্ছে। দ্রুত এটি বাস্তবায়ন করা হোক। একই সঙ্গে মিয়ানমার যেন তার নাগরিকদের ফিরিয়ে নেয়, সে ব্যাপারেও আন্তর্জাতিকভাবে চাপ সৃষ্টি করা উচিত।
আরআরসি ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ থেকে ফিরিয়ে নিতে নয় হাজার শরণার্থীর একটি তালিকা মিয়ানমারে পাঠানো হয় দেড় দশক আগে। সেখান থেকে দেড় হাজার জনকে ফিরিয়ে নেওয়ার আশ্বাসও দিয়েছিল মিয়ানমার। কিন্তু ২০০৫ সালের ৫ মে সর্বশেষ তিনজনকে ফিরিয়ে নেওয়ার পর আর কাউকে ফিরিয়ে নেয়নি। আর অনিবন্ধিতদের তাদের নাগরিক হিসেবেই স্বীকার করে না দেশটি।
আন্তর্জাতিক অভিবাসী সংস্থা (আইএমও) বর্তমানে কক্সবাজারের অনিবন্ধিত রোহিঙ্গাদের বিষয়টি তদারিক করছে। প্রতিষ্ঠানটির মুখপাত্র আসিফ মুনীর প্রথম আলোকে বলেন, ‘রোহিঙ্গারা সংকটের কারণেই বাংলাদেশে চলে আসছে। বর্তমানে তিন থেকে পাঁচ লাখ অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা রয়েছে। তাদের বিষয়টি মানবিকভাবে দেখা উচিত। তবে এ ব্যাপারে বাংলাদেশকে সবার সহযোগিতা করা উচিত। আন্তর্জাতিক বিশ্বের আরও তৎপর হওয়া দরকার।’