অনন্য এক সৈয়দ আশরাফ

Spread the love

শরিফুল হাসান

ক্ষমতায় গেলে অন্য প্রায় সবার সম্পদ যখন হু হু করে বাড়ে, তখন আপনারটাই শুধু কমেছে। যেটুকু ছিল তাও বিলিয়ে দিয়ে সব সময় ডুবে থাকতেন বইয়ের মধ্যে। সততা, আদর্শ, বিনয় সব দিক থেকেই আপনি ছিলেন অসাধারণ।‌ ছিলেন এই বাংলাদেশের অসাধারণ একজন রাজনীতিবিদ। বলছি সৈয়দ আশরাফের কথা। পুরো নাম সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম।

প্রিয় আশরাফ ভাই, বাংলাদেশের প্রথম ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপ‌তি সৈয়দ নজরুল ইসলামের ছেলে আপ‌নি। সবচেয়ে বড় রাজনৈ‌তিক দ‌ল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন প্রায় এক দশক। পাঁচবারের এম‌পি আপনি, তিনবারের মন্ত্রী। কিন্তু এতো কিছুর পরেও আপনার বিনয় ছিল অসাধারণ। এতো সব পদে থাকার পরেও নিজের চি‌কিৎসার জন্য শহরের বা‌ড়িটা বি‌ক্রি করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। অথচ তখন তিনি মন্ত্রী, আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক।

স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে একজন মন্ত্রী,সাংসদ বিরল যে তার পরিবারের চিকিৎসার জন্যে বাড়ি বেচে দিতে হয়েছে। আমাদের আশরাফ ভাই সেই লোক এতটাই সৎ যে নিজের স্ত্রীর চিকিৎসার ব্যয় জুগিয়েছেন বাড়ী বেচে। অবশ্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁকে একদিন গণভবনে ডেকে স্ত্রীর চিকিৎসার জন্যে এক কোটি টাকার একটি চেক দেন যেটা আশরাফ ভাই ফেরত দিয়ে বলেন, আমি বাড়ি বিক্রি করে দিয়েছি তা দিয়ে স্ত্রীর চিকিৎসা হয়ে যাবে। প্রধানমন্ত্রী তখন তাঁকে জানান যে, একজন মন্ত্রীর স্ত্রী হিসেবে তিনি এই টাকা নিতে পারেন সরকার থেকে। মন্ত্রীর স্ত্রী ও সন্তানের চিকিৎসা ব্যয় বহন করতে পারে রাষ্ট্র এবং তা নিয়মের মধ্যেই পরে। তবুও সেদিন আশরাফ ভাই তা নেন নাই। সম্মানের সাথে ফেরত দিয়েছেন।

শুনলে অবাক হতে হয়, তিনি এতটা সৎ ব্যাক্তি ছিলেন যে, এই বেতনই তার একমাত্র আয় ছিলো এবং তিনি তা দিয়েই চলতেন। মৃত্যুর পরে তার পিএস আশরাফ ভাই সম্পর্কে বলেন – “স্যার দুই তিন মাস পর পর আমাকে এক হাজার টাকা দিয়ে ইসলামপুর পাঠাতেন। তাঁর জন্যে তিনটা পাঞ্জাবি কিনে আনার জন্যে। পাঞ্জাবি গুলোর দাম ছিলো ২০০-২৫০ টাকার মধ্যে৷ তিনটা পাঞ্জাবি ৬০০-৭০০ টাকার মধ্যে নিতে বলতেন বাকীটা আমার যাতায়াত খরচ হিসেবে দিতেন এই এক হাজার টাকার মধ্যে। স্যারকে অনেকে অনেক পাঞ্জাবি উপহার দিতে আসতেন, স্যার কোন দিন একটা সুতাও গ্রহন করতেন না “।

আসলে আপনি সৈয়দ আশরাফ বলেই এটা সম্ভব। কারণ রাজনৈ‌তিক সততার উজ্জ্বল ও বিরল এক দৃষ্টান্ত আপনি। মাত্র ১৯ বছর বয়সেই আপ‌নি যোগ দিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে। আজীবন মুক্তিযুদ্ধের সেই চেতনা লালন করেছেন। সততা ও আদর্শের সাথে কোনরকম আপোষ করেননি। প্রতিক্রিয়াশীলতাকে কোন স্থান দেননি। অসাধারণ এক রাজনৈতিক আদর্শের পুরোপুরি চর্চা করে গেছেন। কিন্তু কোন‌দিন কাউকে অসম্মান করে কথা বলেননি। এমন‌কি বিরোধী দলকেও না।

প্রিয় আশরাফ ভাই, আপনি তখন জনপ্রশাসন মন্ত্রী।‌ বিসিএস সংক্রান্ত একটা নিউজে আপনার বক্তব্য নেয়ার জন্য আপনার বেই‌লি রোডের বাসার সামনে সারা‌দিন দাঁ‌ড়িয়ে ছিলাম। সম্পাদক মতি ভাই সেদিন বলেছিলেন আপনার বক্তব্য নিতে হবে। সবাই জানে আপনার বক্তব্য পাওয়া কঠিন কাজ। ‌এই জায়গা ওই জায়গা ঘুরে না পেয়ে অ‌ফিসার্স ক্লাবে গিয়েছিলাম। কারণ ময়মন‌সিংহ স‌মি‌তির একটা অনুষ্ঠা‌নে আপনার সেখানে যাওয়ার কথা। অনুষ্ঠান শেষে আপনার কাছে প্রশ্নটা করেছিলাম। আপনি সেদিন আমার প্রশ্ন শুনলেও উত্তর না দিয়ে হেসে চলে গিয়েছিলেন। কিন্তু আমি খুব অবাক হয়েছিলাম আপনি উত্তর না দিলেও যথাযথ ব্যবস্থা নিয়েছিলেন। সবার কাছে গল্প শুনে প্রায়ই মনে হতো, যদি আপনার সঙ্গে কোন একদিন গল্প করে যদি কাটিয়ে দিতে পারতাম!

আশরাফ ভাই, ২০১৭ সালের ২৫ অ‌ক্টোবর আপনা‌কে নিয়ে আমি একটা লেখা লিখেছিলাম। তাতে বলেছিলাম, আমাদের রাজনীতিবিদ, শিক্ষক, সাংবাদিক, ডাক্তার, পুলিশ, আইনজীবী, বিচারক, প্রকৌশলী, সরকারি কর্মচারী, উন্নয়ন কর্মী, ব্যবসায়ী সব পেশার মানুষেরই সততা, নৈতিকতা, মূল্যবোধ, পেশাদারিত্ত্ব দিনকে দিন নামছে। কমতে কমতে এমন অবস্থা যে এখন আর অনুসরণ করার মতো খুব বে‌শি কাউকে পাওয়া যায় না। তবে এই নষ্ট সমাজেও আপ‌নি সৈয়দ আশরাফের মতো মানুষ ছিলেন।কিন্তু খারাপ মানুষের চাপে আপনারা পিষ্ট। সমাজের চোখে আপনারা কখনো মাতাল, কখনো বোকা, কখনো ব্যর্থ কখনো আবেগি। তবে আপনাদের মতো বোকা আবেগিরা আছে বলেই এখনো এই দেশটা টিকে আছে। আমি চাই এই দেশে আরো দুই একজন সৈয়দ আশরাফের সংখ্যা বাড়ুক।

আশরাফ ভাই শুনে খুব ভালো লেগেছিল, আমার ফেসবুকের সেই লেখাটা আপনাকে পৌঁছে দি‌য়ে‌ছি‌লেন আপনার বড় বোনের এক অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী বন্ধু পলি আপা। সেই লেখা পড়ে হয়তো মুচ‌কি হেসেছিলেন আপনি। কিন্তু সত্যি বলছি, এই দেশে আপনার মতো নেতা বিরল। ‌আশরাফ ভাই, ২০১৬ সালের কাউন্সিলের আগে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে আপনাকে সরিয়ে দেয়া, এরপর সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া, কোনটাই আমার ভালো লাগেনি। আমি বলবো আপনি কষ্ট পেয়েছিলেন ভীষণ কিন্তু হাসিমুখে সব মেনে নিয়েছিলেন। তবে ভীষণ নিঃসঙ্গ হয়ে গিয়েছিলেন। এরপর স্ত্রীর মৃত্যু আপনাকে আরো নিঃসঙ্গ করল। সেই নিঃসঙ্গতা নিয়েই সবার অগোচরে চলে গেলেন দুই বছরে আগে আজকের দিনে।

২০১৬ সালের কাউন্সিলে প্রধানমন্ত্রী ও সৈয়দ আশরাফ

আশরাফ ভাই, আওয়ামী লীগের ২০১৬ সালের কাউন্সিলে আপনার বলা কথা গুলো আজও আমার কানে বাজে। আপনি বলেছিলেন, আওয়ামী লী‌গের ঘরে আমার জন্ম। আওয়ামী লীগ যখন ব্যথা পায়, আমারও কিন্তু হৃদয়ে ব্যথা লাগে। আওয়ামী লীগের একটা কর্মী যদি ব্যথা পায় সেই ব্যথা আমিও পাই। আপনি বলেছিলেন, আওয়ামী লীগ শুধু একটা রাজনৈতিক দল নয়। হাজারো শহীদের রক্ত, জাতির পিতার রক্ত, জাতীয় চার নেতার রক্ত, হাজার হাজার নেতাকর্মীর আত্মত্যাগ। আওয়ামী লীগ একটা অনুভূতি। প্রিয় আশরাফ ভাই, বুকের মধ্যে কতটা ভালোবাসা থাকলে এমন ভাবে কথা বলা যায় সেটা অনেকেই বুঝবে না।

আশরাফ ভাই, আজ আজ ৩ জানুয়ারি আপনার তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী। কিন্তু আপনি তো পঙ্গপালের মতো কর্মী রাখতেন না। তাই দেখবেন আপনাকে নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ফেসবুক ভেসে যাবে না। আপনার স্মরণে বড় কোন অনুষ্ঠান হবে না। অবশ্য এসবে আপনার কিছু যায় আসে না। বেঁচে থাকতেই আপনি এসবে পাত্তা দেননি, দুনিয়া থেকে বিদায় নেয়ার পর আর তার দরকার কী? আমি মনে করি এই দেশের রাজনীতিবিদের উচিত, আপনার জীবন থেকে শিক্ষা নিয়ে সৎ ও আদর্শের রাজনীতি করা। আশরাফ ভাই, দোয়া ক‌রি ভালো থাকুন পরপারে। বঙ্গবন্ধু, জাতীয় চার নেতাসহ সবাইকে আল্লাহ ভালো রাখুন। আজকে তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকীতে আপনাকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি। আপনার মত রাজনীতিবিদকে স্যালুট।

Leave a Reply

Your email address will not be published.