৩৪তম বিসিএস

Spread the love

মনোনীত হয়েও চাকরি পাচ্ছেন না

শরিফুল হাসান

.
.

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মান ও স্নাতকোত্তর দুটি পরীক্ষাতেই তিনি প্রথম হন। ৩৪তম বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে পেলেন প্রশাসন ক্যাডার। পরিবারের সবাই খুশি। কিন্তু একটি গোয়েন্দা সংস্থার নেতিবাচক প্রতিবেদনের কারণে গেজেটে নাম না ওঠায় চাকরিতে যোগ দিতে পারছেন না এই তরুণী। পুনরায় প্রজ্ঞাপনের জন্য আবেদন করে তিন মাস ধরে ঘুরছেন নানা দপ্তরে। হতাশাভরা কণ্ঠে বললেন, ‘কখনো রাজনীতি করিনি। জানি না কী অপরাধে গেজেটে নাম এল না।’
এই তরুণীর মতো ৩৪তম বিসিএসে উত্তীর্ণ ১৩৪ জনের যোগদানের বিষয়টি ঝুলে আছে নেতিবাচক গোয়েন্দা প্রতিবেদনের কারণে। অতীতে কোনো বিসিএসে এত বেশিসংখ্যক প্রার্থীর আটকানোর ঘটনা ঘটেনি। এই ১৩৪ জনের মধ্যে অন্তত ১০ জন রয়েছেন, যাঁরা বিসিএস (শিক্ষা) ক্যাডার ও প্রথম শ্রেণির নন-ক্যাডার পদে কর্মরত।
নিয়োগবঞ্চিত এই প্রার্থীরা বলছেন, লাখো প্রার্থীর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে উত্তীর্ণ হলেও এখন গেজেটে নাম না ওঠায় চাকরিতে যোগ দিতে পারছেন না। বিষয়টি সামাজিকভাবেও অসম্মানের। হতাশ হয়ে তিন মাস ধরে তাঁরা ছোটাছুটি করছেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন দপ্তরে।
গত শুক্রবার রাজধানীতে ময়মনসিংহের গুণীজন সংবর্ধনা অনুষ্ঠান শেষে জনপ্রশাসনমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি কোনো উত্তর দেননি। অবশ্য মন্ত্রী সেদিনের অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে কোনো কথাই বলেননি। এ সম্পর্কে বক্তব্য জানতে গত শনিবার ফোনে যোগাযোগ করা হয় জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ইসমাত আরা সাদেকের সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ৩৪তম বিসিএসে উত্তীর্ণ অধিকাংশই চাকরিতে যোগ দিয়েছেন। যাঁরা যোগ দিতে পারেননি তাঁদের আবেদন পুনর্বিবেচনায় আছে। ইতিমধ্যে কয়েকজনের পুনর্বিবেচনার আবেদন অনুমোদন করেছেন বলে তিনি জানান।
গত বছরের ২৯ আগস্ট ২ হাজার ১৫৯ জনকে বিভিন্ন ক্যাডারে নিয়োগের সুপারিশ করে ৩৪তম বিসিএসের চূড়ান্ত ফল প্রকাশ করা হয়। এ বছরের ১৬ মে গেজেট প্রকাশিত হলে দেখা যায় ১৫৬ জনের নাম নেই। পরে এঁদের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা সনদসহ বিভিন্ন সমস্যার সমাধান হওয়ায় ২১ জনের গেজেট হয়। তবে বাকিদের মধ্যে ১৩৪ জনের পুনর্বিবেচনার আবেদন অপেক্ষায় আছে। তাঁরা কাজে যোগ দিতে পারেননি। এঁদের মধ্যে প্রশাসন ক্যাডারের ১৪ জন, পররাষ্ট্রের দুজন, পুলিশের ছয়জন, শিক্ষার ৫০ জন রয়েছেন। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীরও একজন আছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘কী কারণে তাঁদের গেজেট হয়নি সেটা গোপনীয় বিষয়। তবে আমরা তাঁদের পুনর্বিবেচনার আবেদন পেয়েছি। সেগুলো যাচাই-বাছাই চলছে।’
একটি গোয়েন্দা সংস্থার মধ্যম সারির একজন কর্মকর্তা বলেন, রাজনৈতিক যোগসূত্রতা পাওয়ায় কয়েকজনের সম্পর্কে নেতিবাচক প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে আবার ভুলও হতে পারে।
নিয়োগবঞ্চিত এই প্রার্থীদের মধ্যে ৮০ জনের সঙ্গে গত মাসে প্রথম আলোর কথা হয়েছে। তাঁদের ৪০ জনই দাবি করেছেন, তাঁরা বা তাঁদের পরিবার আওয়ামী লীগ, বিএনপি বা জামায়াত—কোনো দলের রাজনীতির সঙ্গেই জড়িত নন। ২০ জন বলেছেন, তাঁরা আওয়ামী লীগের সমর্থক। পাঁচজন বলেছেন, তাঁদের পরিবারের কেউ না কেউ বিএনপি বা জামায়াতের রাজনীতিতে জড়িত। তবে গেজেটে নাম না আসাকে বঞ্চনা বলে মনে করেন তাঁরা।
প্রশাসন ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত এক তরুণী হতাশ কণ্ঠে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার নানা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তবে পরিবারের কেউ রাজনীতি করে না। খোঁজ নিয়ে জেনেছি, গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আমার মা দুবার বিএনপির সমর্থনে উপজেলা মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান হয়েছেন। অথচ আমার মা দুবারই নির্বাচন করেছেন স্বতন্ত্রভাবে। আর আমি তো মেধার জোরে চাকরি পেয়েছি। তবে কেন আমার বিরুদ্ধে এই প্রতিবেদন?’
কৃষি ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত একজন বলেন, তাঁরা নয় ভাইবোন। বাবার কোনো জমি নেই। মানুষের বাড়িতে কাজ করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্মান, স্নাতকোত্তরে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে ২০১০ সালে প্রধানমন্ত্রী স্বর্ণপদক পান। ক্যাম্পাসে রাজনীতি করতেন না। পরিবারের সবাই আওয়ামী লীগের সমর্থক। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষে এক বড় ভাই হলে সিট দিয়েছিলেন। সেটা শিবিরের কক্ষ বুঝতে পেরে কক্ষ বদলে ফেলেছিলেন। কিন্তু গোয়েন্দা সংস্থা নেতিবাচক প্রতিবেদন দিয়েছে।
আরেক প্রার্থী বলেন, ‘দুই বছর বয়সে বাবাকে হারিয়েছি, ১০ বছর বয়সে মাকে। অবসরে মাথায় ইট বয়ে, ঘাস কেটে বিক্রি করে, টিউশনি করে সম্মান, স্নাতকোত্তরে প্রথম শ্রেণি পেয়েছি। তাবলিগে গিয়েছি, এই অপরাধেই কি গোয়েন্দা সংস্থা নেতিবাচক প্রতিবেদন দিল?’
২৯তম বিসিএসে প্রভাষক হিসেবে চাকরি পেয়ে সরকারি কলেজে কর্মরত একজন ৩৪তম বিসিএসে পুলিশ ক্যাডার পেয়েছেন। তাঁর প্রশ্ন, এই সরকারের আমলেই ইতিবাচক প্রতিবেদনের ভিত্তিতে চাকরি পেলে এখন কী সমস্যা হলো? একই প্রশ্ন ৩২তম বিসিএসের শিক্ষা ক্যাডারে যোগ দেওয়া আরেকজনের। তিনি ৩৪তম বিসিএসে প্রশাসন ক্যাডারে সুপারিশ পেয়েছেন। লোকপ্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের একজন সহকারী পরিচালক এবং একজন প্রকৌশলীও একই প্রশ্ন তুলেছেন। তাঁদের একজন এবার প্রশাসন, আরেকজন গণপূর্ত ক্যাডার পেয়েছেন।
এবার শিক্ষা ক্যাডারে সুপারিশ পাওয়া একজন বলেন, ‘শিক্ষাজীবনে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অসংখ্য পুরস্কার পেয়েছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গার্লস গাইডের সভাপতি ছিলাম। বিসিএসের মৌখিক পরীক্ষার আগে আমার ২৬ সপ্তাহের যমজ দুটি বাচ্চা গর্ভপাত (মিসক্যারেজ) হয়। মানসিক এই দুরবস্থা কাটিয়ে পরীক্ষা দিয়ে চতুর্থ হই, কিন্তু গেজেটে নাম আসেনি। পরে শুনলাম, বাবা মাদ্রাসার শিক্ষক, এটাই কারণ। বাবাও মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন।’
প্রশাসন ক্যাডারে সুপারিশ পাওয়া একজন বলেন, তিনি ঢাকা কলেজে ছাত্রলীগ করতেন। বাবা মুক্তিযোদ্ধা। বড় ভাই পুলিশে। কিন্তু আটকে দিয়েছে একটি গোয়েন্দা সংস্থা।
কৃষি ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত একজন বলেন, রাজনীতির ধারেকাছেও যাননি। বাবা ফুটপাতের দোকানি। ক্যাডারে সুপারিশ পাওয়ার পর বাবা খুব খুশি হয়েছিলেন। কিন্তু গেজেটে নাম আসেনি শুনে অসুস্থ বাবা মারা গেছেন। এখন তিনিও চাকরির আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। আর কারও জীবনে যেন এমন ঘটনা না ঘটে।
স্বাস্থ্য ক্যাডারে সুপারিশ পাওয়া এক তরুণী বললেন, ‘বাবার সঙ্গে স্থানীয় জামায়াতের লোকদের চলাফেরা ছিল। এ কারণে গেজেটে নাম না-ও আসতে পারে ভেবে বাবা সারাক্ষণ কষ্ট পান যে তাঁর কারণে আমি সরকারি চাকরির সুযোগবঞ্চিত। এর আগে আমার বড় ভাইও বুয়েট থেকে লেখাপড়া শেষে ২৮তম বিসিএসে গণপূর্ত ক্যাডার পেয়েছিলেন, কিন্তু গোয়েন্দা সংস্থার নেতিবাচক প্রতিবেদনে চাকরি পাননি। অভিমানে তিনি দেশ ছেড়েছেন।’
পুলিশ ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত একজন বললেন, ‘বাবা অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষক। এক ভাই কুয়েট থেকে পাস করেছেন। রাজশাহী ক্যাডেট কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করা আরেক ভাই এখন নৌবাহিনীর কর্মকর্তা। তাঁর ক্ষেত্রে প্রতিবেদনে সমস্যা হয়নি, অথচ আমার ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রতিবেদন।’
পুলিশ ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত ফরিদপুরের একজন বলেন, ‘পাঁচ বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে ছিলাম। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতির সঙ্গে রাজনীতি করেছি। গেজেটে নাম না আসায় খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, আমার ফেসবুক আইডি হ্যাক করে শিবিরের কিছু বার্তা ছড়ানো হয়েছিল। এখানে আমার কী দোষ?’
৩৪তম বিসিএসে নন-ক্যাডার পদে সুপারিশ পেয়েও নেতিবাচক প্রতিবেদনের কারণে চাকরি না পাওয়া এক তরুণী বললেন, তিনি ৩৫তম বিসিএসে শিক্ষা ক্যাডারে সুপারিশ পেয়েছেন। তিনি আতঙ্কে আছেন, এবারও কি তাঁকে আটকে দেওয়া হবে?
বাদ পড়া প্রত্যেকেই বলেছেন, বিসিএস ক্যাডারের সুপারিশ পেয়ে তাঁরা যেমন আনন্দিত ছিলেন, গত তিনটা মাস তাঁদের জীবনে ততটাই যন্ত্রণাময়। এভাবে মেধাবীদের চাকরিবঞ্চিত করা কতটা যৌক্তিক, জানতে চাইলে পিএসসির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাদিক প্রথম আলোকে বলেন, ‘পিএসসির কাজ চূড়ান্ত ফল তৈরি করে সুপারিশ করা। পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার যাচাইয়ের পর গেজেট প্রকাশ করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এ ক্ষেত্রে পিএসসির কিছু করার নেই।’
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও সাবেক সচিব এ এম এম শওকত আলী এ বিষয়ে উদাহরণ দিয়ে বলেন, ‘পুলিশে প্রশিক্ষণরত অবস্থায় গোয়েন্দা প্রতিবেদনের কথা বলে একবার একটা ছেলেকে বাদ দেওয়া হলে তিনি আদালতে যান। পরে আদালত তাঁকে বাদ দেওয়া অবৈধ ঘোষণা করে। কাউকে বাদ দিতে হলে তাঁর বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট তথ্য, দালিলিক প্রমাণ থাকা উচিত। অন্যথায় বাদ দেওয়াটা ন্যায়সংগত নয়। জনপ্রশাসনের বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করা উচিত।’

Leave a Reply

Your email address will not be published.