শোকের দিন

Spread the love

শরিফুল হাসান

বাঙালির শোকের দিন আজ, দিন আত্মোপলব্ধির। এই দেশে এমন একটা রাত এসেছিল যার চেয়ে কালো রাত আর হতে পারে না। শুধু কালো ব্যাজ বুকে লাগিয়ে, কালো পোশাক পরে, ফেসবুক কিংবা শহরজুড়ে পোস্টার ও ব্যানার ছড়িয়ে কিংবা গরু জবাই বা বিরিয়ানি দিয়ে এই শোক অনুধাবন করা যাবে না।

এগুলো খুব সহজে দেখা যায়, দেখানো যায়। এগুলো দিয়ে শোক প্রকাশ করা যতোটা সহজ, বুকের মধ্যে বঙ্গবন্ধু শব্দটা রাখা, বঙ্গবন্ধুর আদর্শের চর্চা, সেই তুলনায় একটু কঠিন। আফসোস, এই দেশে রাজনৈতিক নেতা থেকে শুরু করে আমলা কিংবা নানা পেশাজীবী লোকজন আমরা শোক প্রকাশের জন্য সহজ পথটা বেছে নেন। সেই তুলনায় বঙ্গবন্ধুর আদর্শের চর্চাকারী কম।

অথচ এই আদর্শের চর্চা করতে না পারলে, অন্তর দিয়ে অনুধাবন করতে না পারলে, আদর্শের চর্চা করতে না পারলে বঙ্গবন্ধুর প্রতি সত্যিকারের শ্রদ্ধা দেখানো হয় না।প্রশ্ন উঠতে পারে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ কী? আমি তো বলবো বঙ্গবন্ধুর আদর্শ মানে তাঁর দেশ্রপ্রেম, তাঁর অপোষহীনতা, তাঁর সততা, সবসময় মানুষের কথা ভাবা, তাঁর ধর্মনিরপেক্ষতা, মানুষের জন্য অসীম ভালোবাসা।

আফসোস,গত ১৩ বছরে মুখে মুখে বঙ্গবন্ধুর কথা বলা লোকের সংখ্যা হুহু করে বাড়লেও বাস্তবে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ চর্চার লোক কতোটা বেড়েছে তা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে হয়। আসলে মুখে বঙ্গবন্ধু বলার চেয়ে অন্তরে বঙ্গবন্ধুর আদর্শধারী লোকের সংখ্যা বাড়লে তো এতো দুর্নীতি হতো না, অসততা হতো না, বিদেশে টাকা পাচার হতো না। বঙ্গবন্ধু তো এগুলো করেননি। অথচ আজ হরহামেশা সেগুলোই হচ্ছে।

অথচ বঙ্গবন্ধুর আদর্শের চর্চা করলে এগুলো হওয়ার কথা নয়। আমরা অনেক সময় ভুলে যাই বঙ্গবন্ধু কতো বড় নেতা! শুধু বাংলায় কেন এই গোটা পৃথিবীতে খুব বেশি নেই যিনি একটা জাতিকে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখিয়েই ক্ষান্ত থাকেননি দিনের পর দিন লড়াই সংগ্রাম করে গেছেন স্বাধীনতার জন্য এবং সত্যি সত্যি তিনি সেই দেশকে স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন! আমরা বড় অভাগা জাতি এমন বিশ্বনেতাকে স্বাধীনতার মাত্র চার বছরের স্বপরিবারে মাথায় হত্যা করেছিল এই দেশেরই একদল কুলাঙ্গার।

ভাবতে কষ্ট লাগে কবর খুঁড়ে রাখার পরেও যে পাকিস্তানিরাও সাহস করেনি তাকে হত্যা করতে, স্বাধীন দেশে সেই বঙ্গবন্ধুকেই হত্যা করা হয়েছিল। অথচ ১৫ আগস্ট কালো রাতে যদি বঙ্গবন্ধুকে হায়েনারা হত্যা করতে না পারতো, আর মাত্র ১০ টা বছর যদি বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্র চালাতে পারতেন তাহলে বাংলাদেশ হতে পারতো অন্যরকম এক রাষ্ট্র।

আজকে মালয়েশিয়ার মাহাথির, কিউবার ফিদেল কাস্ট্রোসহ নানাজনের নাম গুনর্কীতন করা হয়। কিন্তু বঙ্গবন্ধু থাকলে তিনিই হতেন বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী নেতা। কিন্ত হায়েনারা সব শেষ করে দিয়েছিল। ওই যে আদর্শের কথা বলছিলাম সে আদর্শ দুর্বল ছিল বলেই খন্দকার মোশতাক যুক্ত ছিল এই হত্যাকাণ্ডে।‌ আদর্শ দুর্বল ছিল বলেই বঙ্গবন্ধু হত্যার পর তার মন্ত্রিসভার ২১ জন যোগ দিয়েছিলেন খন্দকার মোশতাকের মন্ত্রিসভায়। আদর্শ দুর্বল ছিল বলেই আওয়ামী লীগ সেদিন খুনি আর পরাজিত পাকিস্তানি শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করতে পারেনি।

তাই বঙ্গভবনে বসে খুনিরা দিন পার করেছে। আর ক্যান্টনমেন্টে বসে আরেকদল বানিয়েছে ক্ষমতার মসনদ। কোন সন্দেহ নেই সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা এই জাতির মহাকলঙ্ক। কিন্তু সেই কলঙ্ক তো শুধু খুনেই শেষ নয়! সভ্য দুনিয়ার যে কোন খুনের বিচার হয়। আর বাংলা‌দেশে সেই খুনী‌দের পুরুস্কৃত করেছে।

বঙ্গবন্ধুর ১২ খুনীকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের দূতাবাসে চাকুরি দেওয়া হয়েছে। আরও ভয়ঙ্কর হলো খুনীদের যেন বিচার না হয় সেজন্য ইনডেমনিটি (দায়মুক্তি) অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছে। ১৯৭৫ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত যারাই ক্ষমতায় ছিলো সবাই এই কালো আদেশ বহাল রেখেছে। বহাল রেখেছে খুনিদের চাকুরিও। আর এই সময়ে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের নামে নানা ধরনের মিথ্যা ছড়ানো হয়েছে। রাষ্ট্রীয়ভাবে টানা ২১ বছর তো বঙ্গবন্ধুর নামটাও নেয়া যেত না। আসলে ১৫ আগস্ট তো শুধু জাতীয় শোক দিবস নয়, দিনটা একইসাথে মনে করিয়ে দেয় বাঙালি অকৃতজ্ঞ জাতি।

অথচ ১৫ আগস্ট কালো রাতে যদি বঙ্গবন্ধুকে হায়েনারা হত্যা করতে না পারতো, আর মাত্র ১০ টা বছর যদি বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্র চালাতে পারতেন তাহলে হয়তো ভিন্ন এক বাংলাদেশ পেতাম আমরা!তবে আশার কথা হলো ক্ষমতার লোভে নয় বরং বিনম্র ভালোবাসায় শত প্রতিকুলতার মধ্যেও এদেশের একদল মানুষ বুকের মধ্যে সযত্নে বঙ্গবন্ধুকে লালন করেছে।

আজ শোকের দিনে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি বঙ্গবন্ধুসহ নিহত সবাইকে। যে যাই বলুক যতদিন এই বাংলাদেশ থাকবে, ততোদিন থাকবেন বঙ্গবন্ধু। আর সে কারণেই বাঙালি কবি এবং প্রাবন্ধিক অন্নদাশঙ্কর রায়ের কথাগুলো বলতে হয়-যতকাল রবে পদ্মা যমুনা গৌরি মেঘনা বহমানততকাল রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান।

All reactions:377377

Leave a Reply

Your email address will not be published.