শিনজো আবে!

Spread the love

শরিফুল হাসান

জাপানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে দলের হয়ে ভোটের প্রচারে গিয়ে আততায়ীর গুলিতে নিহত। গত কয়েক ঘন্টা ধরে খবরটা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। ট্রেনে বসে বসে ভাবছি শান্তি প্রিয় জাপানে এমন ঘটনা ঘটতে পারে কল্পনাতেও কেউ কী ভেবেছে?

শিনজো আবে জাপানের ভীষণ প্রভাবশালী নেতা। জাপানে সবচেয়ে বেশিদিন ক্ষমতায় থাকা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেশের অর্থনীতি শক্তিশালী করার পাশাপাশি জাপানকে আবারও বিশ্ব শক্তিতে পরিণত করার পথে অনেকটা অগ্রসর হয়েছিলেন। স্বাস্থ্যগত কারণে প্রধানমন্ত্রীত্ব ছেড়ে দেওয়ার পরও রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন।

বাংলাদেশের অকৃত্রিম এই বন্ধুর মৃত্যুর খবরটি ভীষণ বেদনার। কারণ বাংলাদেশকে নানাভাবে সহায়তা করেছেন আবের সরকার। বিশ্বব্যাংক যখন ঘটা করে বিশ হাজার কোটি টাকার পদ্মাসেতু থেকে সরে দাঁড়ালো, সব দাতা সংস্থাকে নিয়ে ম্যানিলায় মিটিং করে আকারে ইঙ্গিতে অন্য প্রকল্প থেকেও সরে দাঁড়ানোর আহ্বান জানালো তখন আবের সরকার সরে যাওয়া তো দূরের কথা, উল্টা বাইশ হাজার কোটি টাকার মেট্রোরেল প্রকল্পে এগিয়ে আসে, যা পদ্মাসেতু প্রকল্পের চেয়েও দুই হাজার কোটি টাকা বেশি এবং টাকার অংকে বাংলাদেশে এ যাবত কালে যে কোন দাতা সংস্থা কর্তৃক গৃহীত সর্ববৃহৎ প্রকল্প।

অনেকেই জানেন, ২০১৬ সালে হোলি আর্টিজান বেকারি-তে জঙ্গী হামলায় সাত জাপানি নিহত হন। তারা প্রত্যেকেই জাইকা’র সদস্য এবং ঢাকায় মেট্রোরেল প্রকল্পের সাথে পরামর্শক হিসেবে যুক্ত ছিলেন৷ এমন নির্মম হত্যাকান্ডের পর প্রচণ্ড চাপ থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশের প্রতি সমর্থন থেকে সরে দাঁড়াননি প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে ও তাঁর নেতৃত্বাধীন জাপান সরকার। হোলি আর্টিজানে হামলার প্রভাব পড়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে নির্মাণাধীন মেঘনা-গোমতী দ্বিতীয় সেতু প্রকল্পেও।

এই ঘটনায় প্রায় ছয় মাস কাজ বন্ধ রাখে জাপানের তিন নির্মাতা কোম্পানি। এজন্য প্রকল্প মেয়াদ ৬ মাস বাড়ানোরও আবেদন করে তারা। কিন্তু সেই ৬ মাস তো দূরে থাক, আগের সময় এক মাস হাতে থাকতেই নির্মাণ শেষ করে তারা। এমনকি তিন সেতুর মোট নির্মাণ ব্যয় থেকে বেঁচে যাওয়া ৭৩৮ কোটি টাকা সরকারকে ফেরতও দেয়। এমন সততা জাপানিদের কাছে খুব সাধারণ ঘটনা।বাংলাদেশের স্বাধীনতার সূচনালগ্ন থেকেই বাংলাদেশের শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে পাশে আছে জাপান।

বলা যায় জাপান বাংলাদেশের দুর্দিনের বন্ধু। বাংলাদেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নে জাপানের সহায়তা নজিরবিহীন। অবকাঠামো ছাড়া কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবাসহ অন্যান্য খাতেও জাপা‌নি‌দের সহায়তা অনেক। বাংলাদেশকে যতো দেশ উন্নয়ন সাহায্য দেয় জাপান সেই তালিকায় সবার ওপরে। সেই জাপানের সাবেক প্রধানমন্ত্রীর মৃত্যুর খবরটি ভীষণ বেদনার। আমার জন্য আরেকটু বেদনার কারণ জাপান আর জাপানিদের নিয়ে আমার মধুর সব স্মৃতি আছে। কয়েকটি বলি। এক যুগ আগের ঘটনা।

টো‌কিও শহরের এক স্টেশনের কাছে হাতে ম্যাপ নিয়ে শ্রীলঙ্কার এক সাংবাদিক বন্ধুর সাথে একটা ঠিকানা খুঁজছি। কাছাকাছি এসেও খুঁজে না পেয়ে একে ওকে প্রশ্ন করছি। কিন্তু বোঝাতে পারছি না। এর মধ্যেই হঠাৎ কোথা থেকে যেনো উদয় হলেন মধ্যবয়সী এক ভদ্রমহিলা। কাছে এসে তিনি জানতে চাইলেন, তোমরা কী খুঁজ‌ছো? গন্তব্য বলার পর তিনি অনেকটা হেঁটে পথ দেখিয়ে দিলেন। এরপর বললেন, তার খুব জরুরি কাজ আছে।

যেতে হবে। এরপর তিনি প্রায় দৌড়া‌তে লাগলেন। প্রচণ্ড কাজের মধ্যেও বিদেশি বুঝতে পেরে তিনি যেভাবে সাহায্য করলেন তাতে ভালো লাগতে বাধ্য। নাম না জানা সেই জাপানিকে‌ আজীবন ধন্যবাদ। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আমন্ত্রণে সেবার ১৫ দিনের জাপান সফর পৃথিবী সম্পর্কে নতুন ধারণা দিয়েছিলো। টোকিও, কিয়োটো, হিরোশিমা কতো কতো শহর যে সেবার ঘুরেছি। কতো কিছু যে শিখেছি মুগ্ধ হয়ে। বেশ মনে আছে, দ্রুতগতির বুলেট ট্রেনে করে হি‌রো‌শিমা যাওয়ার পথে দলে থাকা এক সাংবাদিক তার পাস‌পোর্ট ভুল ক‌রে ট্রেনে ফেলে গিয়েছিলেন। এরপর তার কী দুশ্চিন্তা। কিন্তু সাথে থাকা জাপানি গাইড বললেন, চিন্তা করো না। আসলেই তার চিন্তা দূর হ‌য়ে গিয়েছিলো।

ট্রেন থেকে নামার আধঘণ্টার মধ্যে তার পাস‌পো‌র্টের হদিস পাওয়া যায়। জাপানের ফরেন প্রেস সেন্টা‌রের যে ভবনটায় প্রতিদিন যেতে হতো, সেখানকার দা‌রোয়ানকে দেখা যেতো রোজ সকালে সবাইকে‌ মাথা নুই‌য়ে হা‌সিমু‌খে স্বাগত জানাচ্ছেন। একইরকম হাসিমুখ থাকতো প্র‌তিটি রেস্তোরাঁর ও‌য়েটাররা। প্রথম দেখায় যে কারও মনে হবে, জাপানিরা এতো ভা‌লো কেনো! আসলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাপান বদলে যায়। জাপানের মানুষ যে এতো ভালো সেই সামাজিক শিক্ষা শুরু হয় কিন্ডারগার্টেন লেভেল থেকে।

সবসময় মানুষকে সাহায্য করা, হেসে কথা বলা, ধন্যবাদ দেয়া, ভুল হলে ক্ষমা চাওয়া, একের বিপদে আরেকজনের পাশে দাঁড়ানো, মুরব্বিদের সম্মান করা সব শিক্ষাই শুরু হয় শৈশবে এবং স্কুল থেকেই। প্রাইমারী স্কুল থেকে এরা দল বেধে স্কুলে যায়।ট্রাফিক আইন, বাস ট্রেনে চড়ার নিয়ম কানুন সবই শেখানো হয় শৈশব থেকে। জাপানের স্কুলে ধনী গরিবের বৈষম্য থাকে না। এটা কাজ করার চেয়ে দলগত কাজ শেখানো হয়।

মানুষকে শেখানো হয় শান্তি আর ভালোবাসা। সেই জাপানে এমন ঘটনা ভীষণ দুঃখজনক। জাপান নিশ্চয়ই এই সংকট কাটিয়ে উঠবে। ভালোবাসা আবে। ভালোবাসা জাপান।

Leave a Reply

Your email address will not be published.