শরিফুল হাসান
মালয়েশিয়া নতুন করে বিদেশি শ্রমিক নিয়োগ শুরু করলেও বাংলাদেশের শ্রমিকদের জন্য দেশটির দরোজা আবার খোলার বিষয়টি এখনো অনিশ্চয়তার মধ্যেই রয়ে গেছে। মালয়েশিয়ার মানবসম্পদমন্ত্রী সম্প্রতি আবার শ্রমিক নেওয়া শুরু করার ঘোষণা দিলেও বলেছেন, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তা বন্ধ থাকবে।বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এ সংকট নিরসনে ‘সর্বোচ্চ পর্যায়ের’ কূটনৈতিক চেষ্টা চলছে। তবে জনশক্তি ব্যবসায়ী ও প্রবাসীদের দাবি, অবৈধ ও দীর্ঘদিন ধরে থাকা মোট এক লাখ বাংলাদেশি শ্রমিক সে দেশ থেকে বহিষ্কারের সম্মুখীন হয়েছেন।এক বছরেরও বেশি সময় ধরে বন্ধ থাকার পর চলতি মাসেই মালয়েশিয়া আবার বিদেশি শ্রমিক নেওয়ার ঘোষণা দেয়। মালয়েশিয়ার মানবসম্পদমন্ত্রী এম সুব্রামানিয়াম ১৪ ফেব্রুয়ারি সে দেশের শীর্ষস্থানীয় ইংরেজি দৈনিক মালয়েশিয়া স্টারকে দেওয়া সাক্ষাত্কারে বলেন, ‘বিদেশি শ্রমিক আমদানি মালয়েশিয়া কখনোই বন্ধ করেনি। শুধু বাংলাদেশ থেকে নতুন শ্রমিক আমদানি বন্ধ থাকবে।’ বহুজাতিক কোম্পানিগুলো সাম্প্রতিক সময়ে সরকারকে বিদেশ থেকে শ্রমিক আমদানির অনুমতির জন্য চাপ দিচ্ছিল উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, তাঁর দেশ নেপাল, মিয়ানমার, ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ড থেকে শ্রমিক নেবে। তবে বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক নেওয়া বন্ধ থাকবে।এ বিষয়ে জানতে চাইলে বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ গতকাল শনিবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘বন্ধ হয়ে যাওয়া এই বাজার চালু করার জন্য সর্বোচ্চ পর্যায়ের কূটনৈতিক তত্পরতা চলছে।’ এক শ্রেণীর অবৈধ জনশক্তি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতির কারণে মালয়েশিয়ার বাজার বন্ধ রয়েছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, এর সঙ্গে মালয়েশিয়ার অনেকেও জড়িত। মালয়েশিয়া দৈনিক তিন শ থেকে চার শ অবৈধ বাংলাদেশি শ্রমিককে বৈধ করে নিচ্ছে দাবি করে তিনি বলেন, এ প্রক্রিয়া শেষ হলেই আবার শ্রমিক নেওয়া হবে।তবে মন্ত্রীর এই বক্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়ে মালয়েশিয়া থেকে একাধিক বাংলাদেশি প্রথম আলোকে বলেন, বাস্তবতা হচ্ছে, মালয়েশিয়া কোনো অবৈধ শ্রমিককে বৈধ করছে না।বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগে কয়েক বছর বন্ধ রাখার পর ২০০৮ সালে আবার বাংলাদেশি কর্মী নিয়োগ শুরু করে মালয়েশিয়া। কিন্তু চাহিদার অতিরিক্ত লোক পাঠানোর কারণে ২০০৯ সালের মার্চে আবারও শ্রমিক নিয়োগে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। এর পর থেকে বাংলাদেশ সরকারের প্রচেষ্টা সত্ত্বেও এ সমস্যার সমাধান হয়নি।জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) মহাপরিচালক খোরশেদ আলম চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার চালু করার জন্য সব ধরনের কূটনৈতিক উদ্যোগ চলছে। তিনি নিজেও মালয়েশিয়ায় দূতাবাসের মাধ্যমে বিষয়টির খোঁজখবর রাখছেন। শ্রমিক নেওয়া হচ্ছে নেপাল থেকে: আগামী ছয় মাসের মধ্যে নেপালকে এক লাখ লোক পাঠাতে বলা হয়েছে। ৪ ফেব্রুয়ারি নেপালের রিপাবলিক পত্রিকায় বলা হয়েছে, মালয়েশিয়ার চাহিদামতো শ্রমিক সংগ্রহ করতে গিয়ে সে দেশের জনশক্তি রপ্তানিকারকেরা রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে। কারণ, দেশটি আগে একবারে ২৫ হাজারের মতো ভিসা পেত। এবারই প্রথম একসঙ্গে এক লাখ শ্রমিকের জন্য ভিসা অনুমোদিত হয়েছে। খবরে উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক নেওয়া বন্ধ থাকার কারণেই নেপালের ওপর হঠাত্ এমন চাপ পড়েছে।পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে অবৈধ শ্রমিকদের: জনশক্তি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন বায়রার যুগ্ম মহাসচিব শামীম আহমেদ চৌধুরী বলেন, ভিজিট ভিসায় গিয়ে অবৈধ হয়ে পড়া শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ৫০ হাজার। তাঁরা আর কখনোই বৈধ হতে পারবেন না। তাঁরাসহ ১৩ বছরেরও বেশি সময় ধরে আছেন এ ধরনের আরও ৫০ হাজার শ্রমিককে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে মালয়েশিয়া।কুয়ালালামপুর থেকে রিয়াজউদ্দিন প্রথম আলোকে জানান, অনেক দিন ধরে যাঁরা মালয়েশিয়ায় আছেন তাঁদের ভিসার মেয়াদ নবায়ন করা হচ্ছে না। জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি থেকে এ সমস্যার শুরু। ১০ বছর ধরে মালয়েশিয়ায় থাকা কুমিল্লার আবদুল হান্নান জানান, তিনি গত সপ্তায় ভিসা নবায়নের জন্য গেলে ভিসা দেওয়া হবে না বলে জানিয়ে দেওয়া হয়।যোগাযোগ করা হলে মালয়েশিয়ার বাংলাদেশ দূতাবাসের শ্রম কাউন্সেলর মন্টু কুমার বিশ্বাস প্রথম আলোকে জানান, সার্বিক বিষয়ে খোঁজখবর রাখা হচ্ছে। তবে কত শ্রমিককে ফেরত পাঠানো হবে, কাদের ফেরত পাঠানো হবে, সে ব্যাপারে তিনি কিছু নিশ্চিত করতে পারেননি।বাজার হারানোর আশঙ্কা: বায়রার যুগ্ম মহাসচিব শামীম আহমেদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়া লোক নেওয়া বন্ধ রাখলেও অনেক লোক ভিজিট ভিসায় গিয়ে অবৈধ হয়ে পড়েছেন। এক শ্রেণীর ব্যবসায়ী প্রতিদিনই এ ভিসায় লোক পাঠাচ্ছে। সরকারকে বিষয়টি জানানো হয়েছে। অবৈধ এই তত্পরতা ঠেকাতে না পারলে প্রতিযোগিতার বিশ্বে মালয়েশিয়ার বাজার আবার চালু করা খুবই কঠিন হবে বলে তাঁর আশঙ্কা।বায়রার সভাপতি গোলাম মোস্তফা প্রথম আলোকে বলেন, মালয়েশিয়ার বাজার হারালে একটি বড় সমস্যা হবে। কূটনৈতিক যোগাযোগের মাধ্যমে বাজারটি আবার চালু করতে সম্ভাব্য সব তত্পরতা চালানো প্রয়োজন। তিনি প্রয়োজনে দুই দেশের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী পর্যায়ে সফরের তাগিদ দেন।