শরিফুল হাসান
মানব পাচারের দিক থেকে বাংলাদেশকে ঝুঁকিপূর্ণ মনে করছে যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের এ বছরের বার্ষিক প্রতিবেদনে বাংলাদেশকে মানব পাচারের মাত্রার বিচারে দ্বিতীয় সারির পর্যবেক্ষণ তালিকায় রাখা হয়েছে। বাংলাদেশ গত বছরও একই তালিকায় ছিল। আগামী বছর তৃতীয় সারিতে নেমে এলে সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে পড়বে বলে আশঙ্কা রয়েছে। এতে অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিকসহ অন্য সব ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা পাওয়ার ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব পড়বে।বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ আশঙ্কার কথা জানিয়ে চিঠি পাঠিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে। প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় আশঙ্কা করছে, এতে সবচেয়ে বেশি নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানির ক্ষেত্রে।যুক্তরাষ্ট্রের এই প্রতিবদেন নিয়ে ইতিমধ্যে বিতর্ক উঠেছে। বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, এই প্রতিবেদন উদ্দেশ্যমূলক। কারণ আগামী বছর বাংলাদেশ তৃতীয় সারিতে নেমে এলে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তৃতীয় তালিকায় রয়েছে মিয়ানমার, কঙ্গো, ইরিত্রিয়া, মৌরিতানিয়া, সুদান, জিম্বাবুয়ে, ইরান, উত্তর কোরিয়া, পাপুয়া নিউগিনির মতো দেশগুলো।পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র তার নিজস্ব কৌশলে তথ্য সংগ্রহ করে। এতে অনেক সময় বাস্তব চিত্র আসে না। তবে মন্ত্রণালয় বিষয়টি খুবই গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে। আগামী বছর পরিস্থিতির উন্নতির জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ইতিবাচক পদক্ষেপগুলোও যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে জানানো হবে।যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে ১৪ জুন আন্তর্জাতিক মানব পাচারবিষয়ক প্রতিবেদন-২০১০ প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনে দেশগুলোকে চারটি স্তরে ভাগ করা হয়। স্তর ১, স্তর ২, স্তর ২ পর্যবেক্ষণ তালিকা এবং সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ স্তর ৩। প্রতিবেদনে ১৭৭টি দেশের মানব পাচারসংক্রান্ত তথ্যচিত্র তুলে ধরা হয়েছে।২২ জুন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে দেওয়া পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের চিঠিতে বলা হয়েছে, প্রতিবেদনটি বাংলাদেশের জন্য রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক তথা বাণিজ্যিকভাবে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। পর পর দুবার দ্বিতীয় সারির পর্যবেক্ষণ তালিকায় থাকলেও ২০১১ সালে তৃতীয় সারিতে নেমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ জন্য বাস্তবসম্মত কর্মপরিকল্পনা গ্রহণে সব মন্ত্রণালয় ও সংস্থার সমন্বয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি জরুরি সভা করা উচিত।জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপসচিব (রাজনৈতিক) সিদ্দিক উল্লাহ ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, ২০০৯ সালের প্রতিবেদনেও বাংলাদেশ দ্বিতীয় সারির পর্যবেক্ষণ তালিকায় ছিল। ওই প্রতিবেদনের পর সরকার বিভিন্নভাবে পাচার বন্ধে কাজ শুরু করে। পুলিশকে প্রশিক্ষণ দেওয়া, বেসরকারি সংস্থাগুলোর সমন্বয়ে কাজ করা, পাচার বন্ধে ইউনিট করাসহ অনেক কাজ হয়। অতীতে কখনোই একসঙ্গে এত কাজ হয়নি। কিন্তু এসব উদ্যোগের প্রতিফলন ২০১০-এর প্রতিবেদনে এসেছে বলে মনে হয় না। এলে বাংলাদেশের অবস্থার অবশ্যই উন্নতি হতো।ভবিষ্যতে কী কর্মসূচি নেওয়া হবে, জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এই কর্মকর্তা বলেন, সার্বিক কার্যক্রমগুলো মূল্যায়ন করে শিগগিরই আবার নতুন করে কাজ শুরু হবে। বিষয়টির সঙ্গে আরও অনেক মন্ত্রণালয় ও প্রতিষ্ঠান জড়িত। সবাইকে নিয়ে কাজ করা হবে এবং বাংলাদেশের পরিস্থিতি ভালো করার চেষ্টা করা হবে।যুক্তরাষ্ট্রের এবারের প্রতিবেদনে মানব পাচারের জন্য জনশক্তি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোকেই (রিক্রুটিং এজেন্সি) দায়ী করা হয়েছে। বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রতিষ্ঠান জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) বাংলাদেশে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর দেখভালের দায়িত্ব পালন করে।বিএমইটির মহাপরিচালক খোরশেদ আলম চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, মানব পাচারবিষয়ক প্রতিবদেনটি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে সরকার। কিন্তু যেসব দেশে পাচার হচ্ছে, সেসব দেশে বাংলাদেশ থেকে বৈধভাবে কাজের জন্য কোনো লোক যায় না। কোনো রিক্রুটিং এজেন্সিও সেখানে লোক পাঠায় না। পাচারের ঘটনা ঘটলে সেটি ভ্রমণ ভিসায় হতে পারে। তার পরও রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর সংগঠন বায়রার কেউ এর সঙ্গে জড়িত থাকলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।বায়রার মহাসচিব আলী হায়দার চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, এই প্রতিবেদন বিভ্রান্তিকর ও উদ্দেশ্যমূলক। বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানি খাতকে ধ্বংস করার জন্যই এই প্রতিবেদন। বায়রা ইতিমধ্যে এই প্রতিবেদনের প্রতিবাদ সরকারকে জানিয়েছে।প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় ও বায়রার নেতারা দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগ করছেন, ট্রাভেল এজেন্সিগুলো ভ্রমণ ভিসায় কাজের জন্য বাইরে লোক পাঠাচ্ছে। তাদের মাধ্যমেই বিদেশে নারী ও শিশু পাচারের ঘটনা ঘটছে। আইনি কাঠামো না থাকায় তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেওয়া যাচ্ছে না।রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোকে দায়ী: যুক্তরাষ্ট্রের এবারের প্রতিবেদনে বাংলাদেশ থেকে মানব পাচারের জন্য মূলত দেশের কিছু জনশক্তি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানকে দায়ী করা হয়েছে। এতে বলা হয়, পাচারের অন্যতম শিকার নারী ও শিশুরা। তাদের জোর করে অনৈতিক কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে।প্রতিবেদনে বলা হয়, রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর মাধ্যমে চাকরির নামে বিদেশে গিয়ে নারীরা ‘চুক্তিবদ্ধ গৃহকর্মী’ হিসেবে আটকা পড়ছেন। তাঁদের চলাফেরা পর্যন্ত নিয়োগকর্তা নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন। বহু ক্ষেত্রেই তাঁরা ন্যায্য পারিশ্রমিক থেকেও বঞ্চিত হন এবং শরীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হন।প্রতিবেদনে বলা হয়, অন্য দেশের শ্রমিকদের বিদেশে যেতে যে টাকা দিতে হয়, বাংলাদেশের একজন শ্রমিককে তার চেয়ে তিন গুণ টাকা দিতে হয়। কিন্তু প্রায়ই তাঁদের আসল খরচের কোনো রসিদ দেওয়া হয় না। ফলে প্রতারণা বাড়ছে। যেসব রিক্রুটিং এজেন্সি এসব করছে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে পারছে না সরকার।প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে নারী ও শিশু পাচারকাজে জড়িত প্রমাণিত হলে ১০ বছরের কারাদণ্ড থেকে মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত হতে পারে। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দীর্ঘ প্রক্রিয়ার কারণে বিচারকাজ বিলম্বিত হয়। প্রায়ই অপরাধীরা পার পেয়ে যায়।বাংলাদেশের জন্য সুপারিশ: প্রতিবেদনে পাচার ঠেকাতে বাংলাদেশ সরকারের নানা উদ্যোগ ও ইতিবাচক পদক্ষেপের প্রশংসা করা হলেও সেগুেলোর সীমাবদ্ধতার কথা তুলে ধরা হয়। প্রতিবেদনে মানব পাচার বন্ধে বাংলাদেশের জন্য কয়েকটি সুপারিশ করা হয়। এগুলো হলো: বিদেশে কাজের নামে যেন কেউ পাচার না হয়, সেটি কঠোরভাবে লক্ষ রাখা, পাচারবিরোধী যথাযথ নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন। এ ছাড়া অবৈধ রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া এবং পাচারের ঘটনার বিচার করতে প্রয়োজনে বিশেষ আদালত গঠন।



