পর্যটন শহরের প্রাণ ধ্বংস হচ্ছে!

Spread the love

শরিফুল হাসান

ছবিগুলো দেখুন! কে বলবে এগুলো পৃথিবীর সবচেয়ে সম্ভাবনাময় পর্যটন শহর কক্সবাজারের ছবি? বরং প্রথম দেখায় মনে হবে ঢাকা শহর। ছবিগুলো দেখি আর ভাবি অসাধারণ এক পর্যটন শহরের প্রাণ-প্রকৃতি কীভাবে দিনকে দিন ধ্বংস হচ্ছে! ভীষণ মন খারাপ হয়। আমি ফিরে যাই তিন দশক আগে আমার শৈশবে যখন প্রথমবার কক্সবাজার এসেছিলাম। না খুব বেশিদিন আগের কথা নয়! বাবার চাকুরির সুবাদে চট্টগ্রামে আসা, সেই সুবাদে প্রথম কক্সবাজার বেড়াতে আসা।

১৯৯২ বা ৯৩ সালে বোধহয় প্রথম কক্সবাজার আসি। এরপর বছরে একবার দুইবার নিয়মিত আসতাম পরিবার বা আত্মীয় স্বজনের সঙ্গে। এখনো মনে আছে বাসে বা গাড়িতে করে কক্সবাজার শহরে ঢোকার আগে বাসটা যখন উঁচু পাহাড় থেকে কলাতলী পয়েন্টে আসতো মনে হতো বাসটা সাগরে চলে যাবে। দিগন্ত বিস্তৃত উম্মুক্ত সৈকত আর পাহাড় দেখে তখন মুগ্ধ হতাম। সদ্য কৈশোর পেরিয়ে যখন কলেজে উঠি সেইসময় মানে ১৯৯৯-২০০০ সালেও কলেজের বন্ধুরা মিলে চট্টগ্রাম থেকে চলে আসতাম কক্সবাজারে। তখনো মুগ্ধতা ছিল। ছিলো খোলা সাগর।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পড়াকালে রাতের বাসে চড়ে চলে আসতাম কক্সবাজারে। তখনো আমি মুগ্ধই হতাম! সারারাত ভ্রমণ করে শহরে ঢোকার আগে বাসটা যখন উঁচু পাহাড় থেকে কলাতলী পয়েন্টে আসতো মনে হতো বাসটা সাগরে চলে যাবে। আমার ঘুম ছুটে যেতো। পরিস্থিতি বদলাতে থাকে ২০০৩-০৪ সালের পর‌।

গত ১৭-১৮ বছর ধরে মতো আসি ততোই দেখি ভবন আর ভবন। দিনকে দিন পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে।‌ সাগর সৈকতের কাছে ধীরে ধীরে উঠতে থাকলো বড় বড় ভবন। এখন আর কলাতলীতে বাস এলে মনে হয় না সাগরে বাস চলে যাবে বরং চোখে পড়ে বড় বড় বিল্ডিং। সৈকত থেকে এখন আর পাহাড়ের কোন চিহ্নই দেখা যায় না। হোটেল বসে মনে হয় আমি ঢাকা শহরেই আছি। অথচ এই একযুগ আগেও আমি সাগজুড়ে লাল কাকড়াদের দলে দলে ছুটতে দেখেছি। এখন দেখি আবর্জনা। বিশেষ করে গত একযুগে যতোবারই কক্সবাজার আসি আমার মন কাঁদে। বিশেষ করে গত পাঁচ বছরে এমন অনেকবার হয়েছে কক্সবাজােরে এসে হোটেল থেকে আর মূল সৈকতে যাইনি। লাখ লাখ লোক। নোংরা, আবর্জনা। কখনো খুব ইচ্ছে হলে আমি আগে শহর ছেড়ে মেরিন ড্রাইভ ধরে হিমছড়ি ইনানির দিকে যেতাম। এখন সেখানেও যাই না। হিমছড়ি পেরিয়ে দরিয়ানগরের দিকে একটু ভালো লাগতো, সেখানেও দেখি নতুন নতুন স্থাপনা! অথচ কক্সবাজারের পুরোনো ছবিগুলো দেখুন। কে বলবে পাহাড়ের পাশেই সাগর ছিল।

আমার ধারণা পৃথিবীর কোন সভ্য দেশ ককক্সবাজার পেলে অন্যরকম বানিয়ে ফেলতো। আর আমরা? আমরা ধ্বংস করছি। আমি এশিয়া ইউরোপ মধ্যপ্রাচ্যে আর আফ্রিকার গোটা ত্রিশেক দেশ আর অন্তত গোটা ৫০ শহর দেখেছি। এমন অপরিকল্পিত সমুদ্র সৈকতের শহর আমি আর দেখিনি। আপনারা অনেকেই হয়তো থাইল্যাণ্ডের পাতায়া গেছেন। ছোট্ট একটা সৈকত।

দেখেন সেটা ঘিরে কতো কী আয়োজন। মালদ্বীপ, ইন্দোনেশিয়ার কথা বাদ দিলাম দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় সবগুলো দেশই দেখেছি। আপনি গোয়া সমুদ্র সৈকত বলেন কিংবা মুম্বাই দেখবেন সৈকত ঘিরে কতো পরিকল্পনা। আমার ভীষণ আফসোস হয়! ককক্সবাজারে মতো এতো দীর্ঘ সৈকত! সাগরেল শব্দ, পাহাড়! আমরা আমাদের কক্সবাজারকে রোজ হত্যা করছি। সেই হত্যাকে আর প্রলম্বিত করেছে রোহিঙ্গা সংকট। আপনাদের একটু ইতিহাসে নিয়ে যাই। গুগল করলেই পেয়ে যাবেন, মুঘল সম্রাট শাহ সুজা পাহাড়ী রাস্তা ধরে আরাকান যাওয়ার পথে কক্সবাজারের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হন এবং এখানেই ক্যাম্প স্থাপনের আদেশ দেন। তার যাত্রাবহরের প্রায় একহাজার পালঙ্কী কক্সবাজারের চকরিয়ার ডুলাহাজারা নামের স্থানে অবস্থান নেয়।

ডুলহাজারা অর্থ হাজার পালঙ্কী। মুঘলদের পরে ত্রিপুরা এবং আরকান তার পর পর্তুগিজ এবং ব্রিটিশরা এই এলাকার নিয়ন্ত্রণ নেয়। বদলে ফেলে তারা কক্সবাজারের নাম। এর আগে কক্সবাজোরের আগের নাম ছিল পালংকি। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি হিরাম কক্সকে পালংকির মহাপরিচালক করে পাঠায়। তখনো এই শরনার্থী সংকট ছিল। ক্যাপ্টেন কক্স আরাকান শরণার্থী এবং স্থানীয় রাখাইনদের মধ্যে বিদ্যমান হাজার বছরের পুরোনো সংঘাত নিরসনের চেষ্টা করেন। কিন্তু কাজ পুরোপুরি শেষ করার আগেই ১৭৯৯ সালে তিনি মারা যান। তার পুনর্বাসন অবদানকে স্মরণীয় করে রাখতে একটি বাজার প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং এর নাম দেয়া হয় কক্স সাহেবের বাজার। সেই থেকে কক্সবাজার। সত্যি বলছি, পৃথিবীর বেশ কিছু দেশ ঘুরে আমার মনে হয়েছে, সৃষ্টিকর্তা দুহাত ভরে বাংলাদেশকে দিয়েছেন। পর্যটন প্রকৃতি আমাদের অসাধারন। কক্সবাজারের মতো একটা সাগর সৈকত দিয়ে একটা দেশের সম্পদশালী হয়ে যেতে পারে।

কিন্তু আমরা পারি না। কেন পারি না? আচ্ছা বলুন তো কেন বিদেশিরা কক্সবাজারে আসবে? তারা কী জানে বিশাল এক সমুদ্র সৈকত আছে কক্সবাজারে? বিশ্ববাসীর কাছে তো আমরা আমাদের কক্সবাজারকে তুলে ধরতে পারিনি। আবার যে কয়কজন বিদেশিও বা আসবে কেন আসবে? আপনি ইন্দোনেশিয়া-মালয়েশিয়া যান। মুসলমান দেশ হওয়া সত্ত্বেও পর্টনের বেলায় সব সুবিধা রেখেছে তারা। এমনকি সৌদ আরবও যেখানে তার দরজা উম্মুক্ত করছে বিদেশিদের জন্য সেখানে আমরা এখনো বসে আছি মান্ধাতা আমলে। আমরা বিনোদনের জন্য কী করেছি? আবার লোকে যে প্রকৃতি দেখতে আসবে সেই প্রকৃতিও তো ধ্বংস করছি আমরা। আচ্ছা বিদেশির কথা বাদ দিলাম। দেশে শান্তিতে ঘোরার জন্যও কক্সবাজার কী খুব স্বাচ্ছন্দ্যের জায়গা?

মোটেও না। হোটেল খরচ ভয়াবহ বেশি। ঢাকা থেকে বিমানে পরিবার নিয়ে আসার খরচ দেখলে আপনি আসতে চাইবেন না। পুরো শহরটা ধুলাময়। কোথাও নির্জনতা নেই। খালি হোটেল আর হোটেল। সেই হোটেলের জানালা দিয়ে আপনি শুধু ভবন দেখবেন। মাঝে মধ্যে মনে হয়, সৃষ্টিকর্তা উদাহরভাবে দেওয়ার পরেও আমরা অভাগা জাতি বলে সব কাজে লাগাতে পারছি না। দেখেন মরুর শহর দুবাইতে আমি দেখেছি ওরা ওদের সাগরপাড়ে কী সুন্দর করে কাঠের রেস্টরুন্টে বানাচ্ছে। সবাই প্রকৃতি বাঁচায়। আর আমরা পারলে সৈকতের ভেতরেও হোটেল করি।

তার কোন ডিজাইন নেই, নকশা নেই। কিছু কিছু ভবন আবার বানিয়ে ফেলে রাখা। দেখলে মনে হয় যুদ্ধবিধ্বস্ত শহর। ২০১৯ সালে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের লাবণী পয়েন্ট থেকে কলাতলীতে যে সমস্ত অবৈধ স্থাপনা তৈরি করা হয়েছে সেগুলো ভেঙে ফেলার নির্দেশ দেয় সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। স্থাপনাগুলো ১৯৯৯ সালের পর কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের লাবণী পয়েন্ট থেকে কলাতলী পর্যন্ত লিজ দেওয়া হয়। এই লিজ আইন সম্মত হয়নি বলে রায়ে বলা হয়। তবে তিন বছর পেরিয়ে গেলেও এগুলো ভাঙা হয়নি। এছাড়া ওশ্যান প্যারাডাইজ ও লং বীচের বিপরীতে রাস্তার পূর্বপাশে যতগুলো হোটেল কটেজ আছে সবগুলো অবৈধ। এগুলো আবাসিক বরাদ্দ থাকলেও দুর্নীতি করে বানিজ্যিক ভবন করা হয়েছে।

আসলে ব্যবসা, দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার এগুলোই যেন এই দেশের ছবি। সবমিলিয়ে একসময়ের ছবির মতো কক্সবাজার এখন একটা পরিকল্পনাহীন এলাকা। অবশ্য শুধু কক্সবাজার কেন? সারা দেশেই আমাদের পযর্টনগুলোর বেহাল দশা! বহুবার বলেছি আমাদের সম্পদের ঘাটতি নেই, আমাদের সংকট ব্যবস্থাপনার। আমি জানি না কথাগুলো কেন লিখি! আমি জানি না কক্সবাজার নিয়ে আমরা কতোটা ভাবছি, কতোটা করছি! আমি এখনো বিশ্বাস করি কক্সবাজার ঠিক করা সম্ভব।

বড় বড় হোটেল বাদ দিয়ে ১২২কিলোমিটাররের পুরো সৈকতজুড়ে ইকো রিসোর্ট টাইপ হতে পারে! একটা মহাপরিকল্পনা তৈরি ও বাস্তবায়ন, সুশাসন, নজরদারি করে সুন্দর করতে পারলে মানুষজন এসে দেখতো বালুময় সমুদ্র সৈকত। বঙ্গোপসাগরের বিস্তীর্ণ বেলাভূমি, উচ্ছ্বসিত সমুদ্রতরঙ্গ, ঝাউবন, পাহাড়। রাতে মানুষ সাগরের গর্জন শুনতে শুনতে ঘুমাতে যেত। সকালে ঘুম থেকে উঠে মিষ্টি রোদের আলসেমিতে সাগর দেখতে দেখতে বলা যেতো, শুভ সকাল কক্সবাজার। শুভ সকাল বাংলাদেশ!

Leave a Reply

Your email address will not be published.