জমিদারপুত্রের স্কুলের ১৬৯ বছর

Spread the love

শরিফুল হাসান

পুরোনো ছবি, বর্তমান ছবি
পুরোনো ছবি, বর্তমান ছবি

১৮৪৮ সালের ১২ জুন। ঢাকার আর্মেনীয় জমিদারের পুত্র নিকোলাস পিটার পোগোজের বয়স তখন ১৮। এই তরুণ আরমানিটোলায় নিজ বাড়ির নিচতলায় একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করলেন। নাম দিলেন পোগোজ অ্যাংলো ভার্নাকুলার স্কুল অ্যাট ঢাকা। ইতিহাসবিদ শরীফ উদ্দিন আহমেদ রচিত ঢাকা: ইতিহাস ও নগরজীবন (১৮৪০-১৯২১) গ্রন্থে ঢাকার পোগোজ স্কুলের এই বর্ণনা আর বিবর্ণ একটি পুরোনো ছবি পাওয়া গেল। বইটিতে স্কুল প্রতিষ্ঠার পটভূমি হিসেবে বলা হয়েছে, ফিসের টাকা দিতে না পারায় ১৮৪৬ সালে ৯৬ জন ছাত্রকে সে সময়ে ঢাকা কলেজ ছাড়তে হয়েছিল। তাদের প্রতি সমব্যথী হয়ে ঢাকার তৎকালীন সিভিল সার্জন টি এ ওয়াইজ ১৮৪৬ সালে খোলেন ‘ইউনিয়ন স্কুল’। কিন্তু অর্থাভাবে সে স্কুল দুই বছরের বেশি চলেনি। ঢাকা কলেজের সাবেক ছাত্র পোগোজ তখন স্কুলটির ভার নিয়ে নিজের বাড়িতে নতুন নামে শুরু করেন। সেখান থেকে ১৮৫৫ সালে স্কুলটি নিকির গ্রিক জমিদার বন্ধু জে সি পানিয়াটির বাসগৃহে এবং ১৮৫৬ সালে পানিয়াটির বাড়ি থেকে আর্মেনি গির্জার পাশে সুধাময় হাউসে স্কুলটি স্থানান্তরিত হয়। ১৮৭৬ সালে পোগোজ মারা গেলে ঢাকার জমিদার মোহিনীমোহন দাস পোগোজ স্কুলের দুই-তৃতীয়াংশ কিনে নেন। এন পি পোগেজা নিকি পোগোজ নামেও পরিচিত ছিলেন। তিনি শুধু স্কুলটির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন না, স্কুলটির প্রধান শিক্ষকও ছিলেন। মৃত্যুর আগে তিনি তাঁর সব সম্পদ ট্রাস্ট করে রেখেছিলেন। জাতীয় জ্ঞানকোষ বাংলাপিডিয়ায় স্কুলটি সম্পর্কে বলা হয়েছে, ১৮৫৫ সালে নিকি তাঁর বন্ধু পানিওতির মালিকানাধীন একটি ভাড়াবাড়িতে স্কুলটি সরিয়ে নেন। সেখান থেকে আরও পাঁচ বছর পর সদরঘাটে একটি দোতলা বাড়িতে স্কুলটি স্থানান্তরিত হয়। সদরঘাটের অবস্থান থেকে পরে স্কুলটি বর্তমান ঠিকানা চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউতে স্থানান্তরিত হয়। ১৮৬৭ সালে এই স্কুলে ৫০০ ছাত্র ছিল। তখন এটি এই বাংলার সবচেয়ে বড় স্কুল ছিল। পোগোজের মৃত্যুর এক বছর পর ১৮৭১ সালে মোহিনীমোহন দাস নামের একজন ব্যাংকার ও জমিদার স্কুলটির মালিকানা নেন। তবে স্কুলের প্রথম প্রতিষ্ঠাতার প্রতি সম্মান দেখিয়ে নিজের নাম আর তিনি সংযুক্ত করেননি। ১৮৮৬ সালে তাঁর মৃত্যুর পর স্কুলটির মালিক হয় তাঁর এস্টেট। তবে ১৯০৭ সালে ভারতে স্কুলের স্বত্বাধিকার পদ্ধতি পরিবর্তিত হলে স্কুলটি পরিচালনার ব্যবস্থাপনা কমিটির ওপর দায়িত্ব অর্পিত হয়। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় পোগোজ স্কুল নানা রকম সমস্যায় পড়ে এবং ১৯৫০ সাল নাগাদ প্রায় ভেঙে পড়ার অবস্থা সৃষ্টি হয়। তবে সবার সহযোগিতায় স্কুলটি দ্রুত তার সংকট কাটিয়ে উঠতে সমর্থ হয় এবং সে সময়ের সেরা স্কুলগুলোর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সামনে এগোতে থাকে। তবে ঢাকায় একের পর সরকারি-বেসরকারি স্কুল হওয়ায় আগের ঐতিহ্য হারাতে থাকে। তবে পোগোজ স্কুলের বিখ্যাত ছাত্রের সংখ্যা হাতে গুনে শেষ করা যাবে না। পূর্ব বাংলা তথা বর্তমান বাংলাদেশের প্রথম আইসিএস ও পরে মন্ত্রী কে জি গুপ্ত, ঢাকা কলেজ ও কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রথম ভারতীয় অধ্যক্ষ পি কে রায়, প্রথম ভারতীয় ডিএসসি ও সরোজিনী নাইডুর বাবা ড. অঘোরনাথ চট্টোপাধ্যায়, ড. প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ, কৌতুকাভিনেতা ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, কবি কায়কোবাদ, কবি শামসুর রাহমান, শিল্পী রফিকুন নবীসহ অনেক খ্যাতিমান এখানকার শিক্ষার্থী। কেউ চাইলেই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে দেখে আসতে পারেন স্কুলটি। মূল ভবনের ওপরে এখনো শোভা পাচ্ছে ইংরেজিতে লেখা প্রতিষ্ঠার সাল ১৮৪৮, যা মনে করিয়ে দেয় ১৬৯ বছরের আলোকবর্তিকা ছড়ানোর কথা।

Leave a Reply

Your email address will not be published.