আমার কয়েকজন বন্ধুবান্ধব আছে যারা আমার মতোই গাধা। উল্টো করে বললে বলা যায় সমাজের চোখে বোকাদের সাথেই আমার বন্ধু্ুত্বটা টেকে। এই বোকাদের জীবনে চলার টাকা থাকে না তবু নীতি-নৈতিকতার জায়গায় কোন ছাড় দেবে না। আমার তেমনি একজন বন্ধু এক বিসিএস ক্যাডার সরকারের গুরুত্বপূর্ণ একটা সরকারি প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ একটা দায়িত্বে আছে। ও এখন যেই শাখার দায়িত্বে গত কয়েকবছর ধরেই সেই শাখায় শুধুই লস হচ্ছে। ও দায়িত্ব নেয়ার পর গতবছর দুই কোটি টাকা লাভ হলো। প্রতিষ্ঠানের প্রধানকে সেটা জানাতেই তাচ্ছিল্য করে তিনি বললেন ‘‘বাংলাদেশের বাজেট এখন আড়াইলাখ তিন লাখ কোটি টাকা। তোমার এই দুই কোটি টাকা লাভে রাষ্ট্রের কিছু যায় আসে না’’। আমার সেই বন্ধু মন খারাপ করে বললেন সরকারি চাকুরি করি। অনেকেই এখানে এসে ঘুষ খায়। আমি সেটা না করে প্রতিষ্ঠানের লাভ করে দিয়েছি।কোথায় সবাই খুশি হবে তা না অফিসের অনেকেই বিরক্ত।সৎ থাকার স্বীকৃতিটাও মিলছে না।বাজেট প্রসঙ্গে কথাটা মনে এলো। আজকে অর্থমন্ত্রী যে বাজেট ঘোষণা করছেন সেটি সাড়ে তিন লাখ কোটি টাকার বাজেট। রাষ্ট্রের কাছে এই টাকা হয়তো কিছুই না। তাই এক দেড় হাজার কোটি টাকা লুটপাট হয়ে গেলেও আমাদের অর্থমন্ত্রী বলেন এই টাকা তো কোন টাকাই না। রাষ্ট্রের হাজার হাজার কোটি টাকা দুর্নীতি হয়ে গেলেও তাই আর আজকাল কিছু হয় না।তৃনমূল থেকে শুরু করে সর্বত্রই একই অবস্থা। একটা পিয়নের চাকুরির জন্যও শুনি দুই তিনলাখ টাকা ঘুষ দেওয়ার জন্য বসে থাকেন। পুলিশের এসআই পদে নাকি ১০–১২ লাখ টাকাও লেনদেন হয়। অনেক সরকারি কর্মকর্তা নাকি আছেন মাসে কোটি কোটি টাকা ঘুষ পান। আমি যখন এসব শুনি আমার খুব কষ্ট লাগে। আমি জানি পুরো চিত্রটাই হয়তো এটা নয়। কারণ কাষ্টমস এর কোন কর্মকর্তা যেমন মাসে ঘুষ খান তেমনি আমার কলেজের এক বন্ধু যে এখন কাষ্টমসের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা সততার সাথেই জীবন যাপন করছে। আমি এক সরকারি কর্মকর্তাকে চিনি যিনি টাকার অভাবে ভাইয়ের চিকিৎসা করাতে পারছিলেন না। একজনকে চিনি যিনি টাকা নেই বলে ঢাকার কোন সুপারশপ থেকে চকলেট কিনে ছেলেকে বলেন বিদেশি চকলেট। তবে এমন কর্মকর্তার সংখ্যা কমে যাচ্ছে। খারাপ লোকের দাপটে তারা অসহায়।তবে আমার নিজের মনে হয় এখন যে বেতনকাঠামো তাতে একজন সরকারি কর্মকর্তা চাইলেই সৎভাবে মোটামুটি জীবনযাপন করতে পারেন। তাহলে প্রশ্ন হলো দেশে ঘুষ–দুর্নীতি–অনিয়ম কেন বন্ধ হচ্ছে না? কেন বাংলাদেশের সব ব্যাংক থেকে বস্তা ভরে হাজার কোটি লুট করলেও বিচার হচ্ছে না? কেন ফ্লাইওভার বা রাস্তা বানাতে বাংলাদেশে সারা পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি খরচ হয়? কেন ৫০০ কোটি টাকার প্রকল্প দুই হাজার কোটি টাকায় গিয়ে দাঁড়ায়। আমাদের লাখো কোটি টাকার বাজেট বলে আমরা কী টাকাকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করি।আমি আজ পর্যন্ত কোনদিন একলাখ টাকা একসাথে হাতে নিয়ে দেখিনি। বাজেটের সাড়ে তিনলাখ কোটি টাকা আমার মাথায় ধরে না। আমার কাছে সাড়ে তিন হাজার টাকাও অনেক টাকা। বিয়ের আগেই আমি সিগারেট খাওয়া ছেড়ে দিয়েছি কারণটা কী জানেন? সাড়ে তিনহাজার টাকা মাসে বেঁচে যায় তাই। টাকার জন্য গ্রীণরোডের বাসা ছেড়ে আমি এখন পুরান ঢাকার দিকে থাকি। গড়ে সাতশ টাকার বেশি দামের পাঞ্জাবি আমি কখনো কিনিনি। অথচ একটু ভালো থাকবো আর সৎ থাকবো বলে আমি সরকারি চাকুরি করিনি। কারণ একজন সরকারি কর্মকর্তা যে বেতন দিয়ে চাকুরি শুরু করেন আমি ছাত্র অবস্থায় তার তিনগুন পেতাম। এখনো ভালোই বেতন পাই। কিন্তু তবুও চলতে কষ্ট হয়। তবু আমি যেখানে যাই সরকারি অফিস কী, সাংবাদিক মহল সবজায়গায় গর্ব করে কথা বলতে পারি। কী মন্ত্রী, কী সচিব, কী সাংবাদিক নেতা, কাউকে তোয়াক্কা করতে হয় না।অথচ আমার বাবাও সৎ সরকারি কর্মকর্তা। তিনি বছরে একবার রোজার ঈদে আমাদের নতুন কাপড় দিতেন। আর কোরবানির ঈদ এলে বলতেন এই ঈদে নতুন জামাকাপাড় নিতে নেই, শুধু গরু কোরবানি দিতে হয়। আমরা তিনভাইবোনই সেটা মেনে নিয়েছি। কিন্তু আজকাল তো দেখি মানুষজন লাখ কোটি টাকার নিচে কথাই বলেন না। আজকাল বুঝি এসবের মূল্য নেই। বরং কে কার চেয়ে দামী পোষাক পরলো দামী গাড়ি কিনলো সেই প্রতিযোগিতাই এখন মনে হয় গুরুত্বপূর্ণ।প্রশ্ন হলো আমরা নিজেরাও কী সততার মূল্য দিচ্ছি? যেই সমাজ সততার মূল্য দেয় না সেই সমাজে সৎ মানুষ ক্রমেই কিন্তু কমতে থাকে। এই তো ২৫–৩০ বছর আগেও এলাকার ঘুষখোর দারোগার বাড়ি সবাই চিনতো। তাঁর ছেলেমেয়েরা লজ্জায় থাকতো। কিন্তু এখন? উল্টো তারা গর্ব করে। আপনার বাবা সরকারি কর্মকর্তা। আপনি জানেন আপনার বাবার আয় কতো? আচ্ছা তাহলে সেই টাকায় আপনি কী করে বিদেশে পড়েন? আপনি নিজে চিন্তা করুন তো ৩০-৪০ হাজার টাকা বেতনের চাকুরি করে আপনি কী করে আপনি ফ্ল্যাট কেনেন। বিদেশে টাকা পাচার করেন? একবার ভাবুন তো মেয়ে বিয়ে দেবার সময় আমরা এমন ছেলে খুঁজি কী না যার টাকা আছে কিংবা টাকা কামানোর রাস্তা আছে।আমার খুব অবাক লাগে যখন দেখি ঢাকায় দারুণ দারুণ সব ফ্ল্যাট হচ্ছে যেগুলোর দাম কোটি কোটি টাকা এবং সেগুলো দেদারসে বিক্রি হয়। গুলশান–বারিধারা–ধানমন্ডিতে নতুন নতুন বাড়িঘর দেখে আমি চমকে থাকি। আমেরিকা ইউরোপে নাকি এমন জায়গায় বাংলাদেশিদের বাড়ি আছে যেখানে সেই দেশের নাগরিকরাও বাড়ি কেনার সাহস করেন না। এই ঢাকা শহরে যতো দামী গাড়ির মডেল ভারতেও কিন্তু নেই। নেই অনেক উন্নত শহরেও। এই তো কদিন আগে আমারই এক বন্ধু বললো ৫৫ লাখ টাকায় নতুন গাড়ি কিনেছে। আমি মনে মনে ভাবি ৫৫ লাখ হলে তো আমি সারাজীবন লেখালেখি করতাম আর ঘুরতাম আর মানুষের দরকারে টাকা দিতাম।আমার আসলেই খুব অবাক লাগে। এই দেশের কিছু মানুষ যখন কোটি টাকা দিয়ে ফ্ল্যাট–গাড়ি কেনে তখন কিন্তু কিছু মানুষ জীবন বাঁচানোর লড়াই করতে করতে ক্লান্ত। এই ঢাকা শহরে কতো মানুষ টাকার অভাবে সিএনজিতে না চড়ে বাসে চড়ে, কতো লোক পছন্দ হয় না তবু কম দামী বাসায় থাকে। মানুষের সংগ্রামের তো শেষ নেই। আবার সেই দেশেই কিছু মানুষের টাকার শেষ নেই।আমি বলছি না বড়লোকরা গাড়ি কিনবেন না, মানুষের গাড়ি থাকবে না। কিন্তু বলুন তো কোটি টাকা দিয়ে গাড়ি কেনার কী দরকার? আপনি প্রয়োজন মেটান কিন্তু এতো বিলাসিতা কেন? আপনার হয়তো কোটি টাকা দিয়ে গাড়ি কেনার সামর্থ্য আছে কিন্তু আপনি যদি ছয়–সাত লাখ টাকার গাড়ি কিনে বাকি টাকাটা বাঁচান তাহলে আপনার সেই টাকায় কতো দরিদ্র মানুষের সংসার চলে যায়, কতো অসুস্থ মানুষের অপারেশন হয়ে যায়, কতোজনের লেখাপড়ার খরচ হয়ে যায় একবার হিসাব করে দেখছেন? যদি ধর্মে বিশ্বাস করেন তাহলে আপনার পরকালটাও এই কাজে ঠিক হয়ে যাবে। আর যদি পরকালে বিশ্বাস নাও করেন এই দুনিয়াতে মানুষের পাশে থাকার যে আনন্দ সেটাই বা কম কী? আমি জানি বাংলাদেশের কিছু মানুষের যতো টাকা আছে সেই টাকা দিয়ে ১০–২০ টা পদ্মা সেতু করা যায়, পুরো দেশের মানুষের জীবন বদলে যায়। তবু এই দেশের লাখো মানুষ কতো কষ্টেই না থাকে!বাজেট উপলক্ষ্যে এতো কথা কেন বলছি আমি জানি না। গতকাল সাংবাদিক মানিক মিয়ার মৃত্যুবার্ষিকীতে একজন বলছিলেন, এই দেশে ধনী–গরিবের বৈষম্য বাড়ছে। আমরা বলছি না সম্পদের সমান বন্টন কিন্তু সম্পদের সুষম বন্টন তো হতে পারে। আমি জানি সেটাও হবে না। এই বাংলাদেশে ধনী অরো ধনী হবে, গরিব অরো গরিব হবে। লুটপাট হবে। দুর্নীতি হবে। যার ক্ষমতা আছে সে টাকা কামাবে। যারা টাকা আছে সে অরো টাকায় আরো ক্ষমতাবান হবে।আর এভাবে বিচারবিভাগ, প্রশাসন, পুলিশ, সাংবাদিকতা সর্বত্র সততার দাম কমতেই থাকবে।আমার নিজের মনে হয় আমাদের রাষ্ট্রীয় বাজেটের অংক যতোই বাড়ছে ততোই ধনী গরিবের বৈষম্য বাড়ছে।আমি যেন আমার মতো অভাগার কথা কেউ শুনবে না তবু বলছি ভাই এতো কোটি কোটি টাকা দিয়ে কী করবেন? সেই কবরেই তো যেতে হবে। আপনি হয়তো ভাবছেন পরবর্তী প্রজন্মের জন্য রেখে যাবেন। ভাইরে একটু পরে কী হবে আমরা জানি না। আপনি কী করে ভাবছেন আপনার টাকা আপনার প্রিয়জনের নিশ্চয়তা দেবে। কাজেই মোটামুটি জীবনযাপন করুন, যেটা না হলেই নয় সেটা কিনুন। কিন্তু টাকা খরচ করুন মানুষের জন্য। আপনার সামর্থ্য অনুযায়ী দুই হাত দিয়ে খরচ করুন মানুষের জন্য। । দেখবেন সুখে থাকবেন, শান্তিতেও। চলুন রাষ্ট্র থেকে শুরু করে ব্যক্তি জীবনে এমন বাজেট করি যেখানে আয়টা হবে শতভাগ সৎ আর খরচটা হবে নিজের পাশাপাশি মানবতার জন্য। কাজেই আমার স্লোগান সৎ আয়ে হোক মানবিক বাজেট।