বাংলাদেশের শিক্ষিত তরুণ ছেলেমেয়েদের জীবনের এখন একটাই লক্ষ্য একটা ভালো চাকুরি।কখনো সরকারি চাকুরির পরীক্ষা না দিলেও সাংবাদিক হিসেবে গত এক দশকে এই চাকুরিপ্রার্থী তরুণদের আমি খুব কাছ থেকে দেখছি। একইসাথে দেখছি নিয়োগ প্রক্রিয়াগুলোও।
আমি আমার নিজের অভিজ্ঞতায় শতভাগ নিশ্চয়তা দিয়ে বলতে পারি এই রাষ্ট্রের সবচেয়ে কাঙ্খিত বিসিএসের চাকুরি কিংবা প্রথম শ্রেণীর যে কোন কর্মকর্তা যিনি পিএসসির মাধ্যমে নিয়োগ পেয়েছেন তাকে চাকুরি পেতে এক টাকাও ঘুষ দিতে হয়নি।
কাজেই কেউ ঘুষ ছাড়া চাকুরি পাওয়াদের সংবর্ধণা দিতে চাইলে শুধু গত আট বছরে বিসিএসের মাধ্যশে নিয়োগ পাওয়া ২৬ হাজার ১৯৫ জন ক্যাডারকে এবং ৪৩ হাজার ২০ জন প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর কর্মকর্তাকে সংবধর্ণা দিতে পারেন। তাঁরা সবাই আপনার আমার আশপাশেই আছেন।একই কথা বলতে পারি বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তা নিয়োগের ক্ষেত্রেও। বাংলাদেশ ব্যাংকের সহকারী পরিচালক নিয়োগ প্রক্রিয়া শুধু স্বচ্ছই নয়, মৌখিক পরীক্ষায় কম নম্বর থাকে বলে এখানে কোন ধরনের তদবিরেরও সুযোহ থাকে না। কাজেই সহকারী পরিচরালক বা এখানকার কর্মকর্তা নিয়োগের ক্ষেত্রেও কাউকে কোন ঘুষ দিতে হয় না।
রাষ্টায়াত্ত্ব ব্যাংকগুলোর কর্মকর্তা নিয়োগের ক্ষেত্রেও বলা যায় নিয়োগ প্রক্রিয়া মোটামুটি স্বচ্ছ। কাজেই ঘুষ ছাড়া চাকুরি পাওয়া লোকদের সংবর্ধনা দিতে চাইলে এখন লাখো ছেলেমেয়ে পাওয়া যাবে।একইভাবে প্রতিবছর জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশন যে শতাধিক ছেলেমেয়েকে নিয়োগ দিচ্ছে সেটাও শতভাগ স্বচ্ছ এবং মেধাই সেখানে একমাত্র বিবেচ্য বিষয়।তবে পিএসসির বাইরে স্বায়ত্তশাসিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং করপোরেশনগুলো নিজেরা পরীক্ষা নিয়ে লোক নিয়োগ দেয়। সেখানে যথেষ্ট অনিয়ম আছে। বিশেষ করে সুপারিশ আর তদবির সেখানে বেশ প্রকট বলেই শোনা যায়।
আর চাকুরিতে ঘুষ দেয়া–নেয়ার কথা বললে আমি আমার উদ্বেগের কথা জানাবো পুলিশের এসআই নিয়োগের ক্ষেত্রে। এখানে পাঁচ থেকে ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ লেনদেন হয়। যদিও অনেকে মেধায় চাকুরি পায় এখানে কিন্তু অনেকেই ঘুষ দেয়।
আইন অনুযায়ী রাষ্ট্রের প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর কর্মকর্তা পদের যে কোন নিয়োগ পিএসসির মাধ্যমে হওয়ার কথা। পুলিশের এসআই পদটাকে দ্বিতীয় শ্রেণীর করার পর এই নিয়োগও পিএসসির মাধ্যমে হওয়ার কথা। কিন্তু পুলিশ কোনভাবেই এটা ছাড়তে রাজি হয়নি। এ নিয়ে পিএসসি আর পুলিশের দ্বৈরথের সময় আমি অনেকগুলো নিউজ করেছি।
আমি এই জায়গাটায় জোর দিতে চাই এ কারণে যে কেউ যদি ১৫ লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে এসআই হন নিয়োগের পর তিনি এই টাকা তুলে নিতে চাইবেন। আর এর ভুক্তভোগী হবে সাধারণ মানুষ। কাজেই পুলিশের নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ঘুষ লেনদেন বন্ধ করা জরুরী। আর এই নিয়োগটা পিএসসির মাধ্যমে হওয়া উচিত। তাহলে রাষ্ট্র অনেক যোগ্য পুলিশ কর্মকর্তা পাবে।
কর্মকর্তা নিয়োগের বাইরে কর্মচারী নিয়োগটা যে যে মন্ত্রণালয় বা অধিদপ্তর করে। আমার মনে হয় এখানে আরও স্বচ্ছতার সুযোগ আছে। কারণ সাধারণ মানুষ বেশিরভাগ সময় কর্মকর্তা পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেন না। তারা এইসব কর্মচারীদের কাছে যায়। আর বেশিরভাগ ঘুষ অনিয়ম এদের মাধ্যমে হয় যদিও বড় কর্তারা ভাগ না নিলে এটিও বন্ধ করতে পারবেন।
যে কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম সোখানেই আবার ফিরি। বলেছিলাম বাংলাদেশের শিক্ষিত ছেলেমেয়েদের জীবনের এখন একটাই লক্ষ্য একটা চাকুরি। দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে ছেলেমেয়েরা সব লোখাপড়া বাদ দিয়ে চাকুরির পড়ালেখায় ব্যস্ত। এই তরুণ প্রজন্ম চাকুরির পরীক্ষা দিতে দিতে তাদের জীবনের সেরা সময়টা নষ্ট করে। বিভিন্ন চাকুরির পরীক্ষার আবেদন করতে গিয়ে তাদের অনেক টাকা খরচ করতে হয় যেটা তাদের জন্য একটা বাড়তি চাপ। আমার মনে হয় তারুণ্যের এই চাকুরি সংক্রান্ত সমস্যার সমাধান জরুরী।
আমার নিজের অভিজ্ঞতায় আমি এর সমাধান দিতে পারি জানি না রাষ্ট্র সেটা নেবে কী না। প্রথমত রাষ্ট্রের সব ধরণের নিয়োগ পরীক্ষা পিএসসির মাধ্যমে হতে হবে। সেই প্রক্রিয়া হতে হবে স্বচ্ছ। বর্তমানে বিসিএসে ২০০ নম্বরের মৌখিক পরীক্ষা নেয়া হয়। এটা কমিয়ে ১০০ করা উচিত। যে কোন নিয়োগে মৌখিক পরীক্ষার নম্বর ২০ শতাংশের বেশি হওয়া উচিত নয়। আর প্রতিটা পরীক্ষায় প্রিলিমিনারি থেকে শুরু করে লিখিত ভাইভায় কে কতো পেলো মেধাক্রম অনুযায়ী সেটা প্রকাশ করতে হবে।আমার দ্বিতীয়, পরামর্শ হলো সারাবছর নানা ধরনের পরীক্ষা না নিয়ে বিসিএসের মতো একটাই পরীক্ষা নিতে পারে পিএসসি। সেই পরীক্ষার মেধা তালিকা অনুযায়ী সারাবছর কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়া যেতে পারে।
একইভাবে কর্মচারী নিয়োগের জন্যও একটা পরীক্ষা নেয়া উচিত। সেই পরীক্ষা দিয়ে বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে কর্মচারী নিয়োগ দেয়া উচিত। একইভাবে সব ব্যাংকগুলোর জন্য সারা বছরে একটা পরীক্ষা হোক। মেধা অনুযায়ী কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়া হোক।
আজকের তরুণ প্রজন্ম এই রাষ্ট্রকে প্রতিনিয়ত গালি দেয় কোটা পদ্ধতির কারণে। সশস্ত্র বাহিনীতে নিয়োগে কিন্তু কেউ কোটার কথা বলে না। আমি মনে করি সব ধরনের নিয়োগে এই কোটার সংস্কার জরুরী। মেধায় এখন ৭০ শতাশ আর সবমিলেয় কোটায় ৩০ শতাংশ নিয়োগ হতে পারে। ৩০ ভাগ কোটার মধ্যে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য ১৫ শতাংশ, নারীদের জন্য ১০ শতাংশ, আদিবাসীদের জন্য তিন শতাংশ এবং প্রতিবন্ধীসহ বাকিদের জন্য দুই শতাংশ কোটা থাকতে পারে। ভারতের মতো একটি পরিবাররের কোন সদস্যকে একবার কোটার সুবিধা দেওয়া উচিত।
আমার আরেকটা পরামর্শ হলো নিয়োগ প্রক্রিয়াগুলোর দীর্ঘসূত্রতা বন্ধ করা উচিত। আর নিয়োগের পর পুলিশ ভেরিফিকেশনের নামে যেটা হয় সেটা একেবারেই অপ্রয়োজনীয়। এখানেও ঘুষ বকশিশের রেওয়াজ আছে। আছে হয়রানিও।
আমি জানি না আমার কথাগুলো রাষ্ট্র শুনবে কী না। তবে দেশের তরুণ প্রজন্মকে স্বস্তি দিতে হলে চাকুরি সংক্রান্ত এসব সমস্যার সমাধান জরুরী। একইভাবে দেশ আর দেশের মনুষের সেবা দেওয়ার জন্যও এটা জরুরী। কারণ নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অনিয়ম যতো কমবে রাষ্ট্রের মানুষও ততো বেশি সেবা পাবে। আশা করছি সংশ্লিষ্টরা কথাগুলো বিবেচনা করবেন। আর না করলেও হতাশা প্রকাশ ছাড়া আমার কিছু বলার নেই। তবে আমি আমার বিবেকের তাড়নায় দেশের স্বার্থে কথাগুলো বলেই যাবো। এই রাষ্ট্রের সবাই ভালো থাকুক। শুভকামনা সবার জন্য।শরিফুল হাসান, সিনিয়র রিপোর্টার, প্রথম আলো