অামার কাছে এখনো মনে হচ্ছে পুরো ঘটনাই সিনেমা।গত শুক্রবারের ঘটনা। সন্ধ্যার দিকে প্রথম অালো অফিসে অামার কাছে এলো জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজির চতুর্থ বর্ষের ছাত্র ইমাম হোসেন। তার সাথে এক কিশোর। অামাদের গল্পের নায়ক এই ছেলে।
ইমাম জানালো, পুরান ঢাকার শ্যামবাজারে তার বাবা আবদুল লতিফের দোকান। সেই দোকানের পাশেই সাদ্দাম হোটেলে কাজ করে রাসেল নামের একটি ছেলে। আড়াই বছর আগে এক লোক তাকে এই হোটেলে দিয়ে যায়। ইদানীং সে কেবল বাড়ি যাওয়ার জন্য কান্নাকাটি করে।
ইমাম জানালেন তার আবদুল লতিফকে বাচ্চা ছেলেটি নানা ডাকে। প্রায়ই কান্নাকাটি দেখে একদিন বাবা তাকে বললেন, তুই তো ইউনিভার্সিটি পড়িসি। ছেলেটার বাবা মা খুঁজে বের কর না? কিন্তু রাসেল তো বাড়ির ঠিকানা বলতে পারে না। কারণ,পাঁচ বছর আগে রাগ করে বাড়ি ছেড়েছিল ছেলেটি।
ইমামের মনে হয়, ছেলেটির ছবি যদি পত্রিকায় প্রকাশ করা হয়, তাহলে হয়তো পরিবারের সদস্যরা দেখে তাকে চিনতে পারবেন। এমন ভাবনা থেকে ওকে নিয়ে অামার কাছে নিয়ে এসেছে।
প্রথম অালোর রিসেপশনে বসে অামি গল্প শুরু করি ইমামের সাথে। একটা অনুষ্ঠানের কার্ড দিতে রিসেপশনে তখন অামার সাথে দেখা করতে এসেছে যমুনা টেলিভিশনের অারেক সাংবাদিক জিয়াও। ওর সাথে কথা বলতে বলতেই গল্প করি ছেলেটার সাথে।
কীভাবে ঢাকা এলে তুুমি? অামার প্রশ্ন শুনে ঢাকায় আসার গল্পটা বলে রাসেল। জানালো, ‘রিকশায় করে কিছুদূর আইয়া ঘাট থেকে লঞ্চে উঠছি। তারপর ঘুমাইয়া গেছি। লঞ্চ থেকে নামার পর নদীর ধারের একটা হোটেলে গেছি। পরে ওটাতেই কাজ করছি।’ লঞ্চে কতক্ষণ লেগেছিল জানতে চাইলে রাসেল বলল, ‘দুই-তিন ঘণ্টা হইব।’
প্রথম আলোর অভ্যর্থনাকক্ষে ততক্ষণে রাসেলকে দেখতে ভিড় জমেছে। অামাদের ক্যান্টিনের ছেলেদের উৎসাহ সবচেয়ে বেশি। বাড়ি থেকে পালালে কেন জানতে চাইলে রাসেল কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলল, মা (শাহেদা আক্তার) মারা যাওয়ার পর বাবা (ফয়জুল হক) আরেকটা বিয়ে করেছেন। বাড়িতে তাকে মারধর করা হতো। তাই রাগ করে বাড়ি ছেড়েছে। এখন তাহলে বাড়ি যেতে চাইছ কেন? ‘বাবা-ভাইবোনদের কথা মনে পড়ে। একটু দেখতে চাই সবাইরে।’ রাসেল জবাব দেয়।
রাসেলর কথায় নোয়াখালীর টান। অামার কাছে অাসা জিয়ার বাড়ি লক্ষীপুর। জিয়াও তাই বললো। ইমাম হোসেনও জানালেন, রাসেল নোয়াখালীর আঞ্চলিক টানে কথা বলে। অামি রাসেলকে বলি স্কুল পড়ছিলা? রাসেল বলে, তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছে। স্কুলের নাম কী? বলে ইয়াছিন চেয়ারম্যানের স্কুল।
সার্চ ইঞ্জিন গুগলে খোঁজ করে এই নামে কোনো স্কুল পেলাম না। অামি সারা বাংলাদেশ মোটামুটি ঘুরেছি। রাসেলের কথা শুনে অামি ভেবেছিলাম ওর বাড়ি ভোলা, বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জ, সন্দীপ বা হাতিয়া হতে পারে। নোয়াখালীর কথার টান শুনে মনে হলো, নোয়াখালীর একমাত্র উপজেলা হাতিয়া, যেখান থেকে ঢাকায় সরাসরি লঞ্চ আসে।
গুগলে এবার ‘হাতিয়ার ইয়াসিন চেয়ারম্যান’ লিখে সার্চ দিতেই প্রথম আলোর দুটি পুরোনো প্রতিবেদন বেরিয়ে আসে। সেই প্রতিবেদনে দেখা যায়, হাতিয়ার সোনাদিয়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যানের নাম ইয়াসিন আরাফাত।ঢাকায় একটি বেসরকারি টেলিভিশনের সাংবাদিক হাতিয়ার বাসিন্দা সাইফুদ্দিন রবিন। একসময়ে প্রথম অালোয় কাজ করতো। জিয়াকে বললাম রবিনকে ফোন করে অামার কথা বলো। জিয়া ফোন দিলো। অামি রবিনকে জিজ্ঞাসা করলাম তোমাদের এলাকায় ইয়াসিন চেয়ারম্যান অাছে?
রবিন বললো অাছে। অামি বললাম তার মোবাইল নম্বর দাও। রবিন একটু পর নম্বর জোগাড় করে দিলো। রাত তখন ৯ টা। অামি অনেক অাশা নিয়ে ইয়াসিন চেয়ারম্যানকে ফোন দিলাম। জানতে চাইলাম, অাপনার নামে কোনো স্কুল অাছে কী? তিনি বললেন না।
ইয়াসিন চেয়ারম্যরান জানালেন, বাড়ির পাশে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছেন তিনি। নাম দক্ষিণ-পূর্ব মাইজচরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এলাকায় অনেকে একে ইয়াসিন চেয়ারম্যানের স্কুল বলে থাকে। এবার তাকে কিশোর রাসেলের বৃত্তান্ত, বাবা-মায়ের নাম বলা হলো। তিনি রাসেলের সঙ্গে কথা বলতে চাইলেন। তাঁর এক প্রশ্নের জবাবে রাসেল জানাল, স্কুলের কাছে মাস্টার মসজিদ নামে একটা মসজিদ আছে।
ইয়াসিন চেয়ারম্যান অামাওক বললেন, স্কুল আর ওই মসজিদ কাছাকাছি। তার মানে, ছেলেটি বোধ হয় এই এলাকার। তিনি ছেলেটির বাবা-মায়ের খোঁজ করার প্রতিশ্রুতি দিলেন। অামি রাসেল অার ইমাম হোসেনকে বিদায় দিলাম। বললাম দেখি চেয়ারম্যান কী জানায়। ছোট্ট রাসেল কিছুতেই যাবে না। অামাকে বলে স্যার অাপনি অামার বাবার কাছে পাঠান। অামি ওকে নানা অাশ্বাস দিয়ে বাড়ি পাঠাই। অাশায় থাকি ইয়াসিন চেয়ারম্যানের।
ঘন্টা দুয়েক পরে এবার তার ফোন। অানন্দিত ইয়াসিন চেয়ারম্যান জানালেন, ছেলেটির বাবার সন্ধান পেয়েছেন। লঞ্চের সারেং ছিলেন। ছেলের শোকে পাগলপ্রায়। খুবই দরিদ্র পরিবার। এখন তিনি ছেলেকে নিতে ঢাকায় আসতে চান। অামি অার ইমাম তাদের সাথে যোগাযোগ করি। অপেক্ষায় থাকি ঢাকা অাসার।
বুধবার সন্ধ্যা। কারওয়ান বাজারের প্রথম আলো কার্যালয়। বাবা তাঁর ১৪ বছরের কিশোর ছেলেকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছেন। কাঁদছে বাবার সঙ্গে আসা রাসেলের আরেক ভাই। এখানেই জানা গেল রাসেলের আসল নাম সাহাবুদ্দিন। ঢাকায় আসার পর কীভাবে যেন তার নাম রাসেল হয়ে গেছে।
সাহাবুদ্দিনের বাবা ফয়জুল হক ছেলেকে পেয়ে কাঁদছেন। কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘পাঁচ বছর আগে ছেলেটা হারায়ে যায়। ওর মা মারা যাওয়ার পর একদিন বাড়ি থেকে পালাইয়া যায়। বহু জায়গায় খুঁজছি। হাতিয়া, নোয়াখালী, চিটাগাং। দুই বছর খুঁজে আমি ধরে নিছি ছেলে নাই, মরি গেছে। হে যে ঢাকা আসতে পারে, আমরা স্বপ্নেও ভাবি নাই। আজকে ছেলেটারে দেইখা শান্তি পাইলাম।’
রাসেল মানে সাহাবুদ্দিনরা চার ভাই, তিন বোন। সাহাবুদ্দিনের পিঠাপিঠি বড় ভাই মনিরউদ্দিন বলে, সাহাবুদ্দিন হারানোর পর তার বাবা সারেংয়ের চাকরি ছেড়ে দেন। পাঁচ বছরেই বুড়ো হয়ে গেছেন বাবা। তেমন কথা বলেন না কারও সঙ্গে। কিন্তু সাহাবুদ্দিনকে দেখে যেন রাজ্যের শক্তি ফিরে এসেছে তাঁর গায়ে। হাসছেন, কথা বলছেন।
সেটা অবশ্য বৃদ্ধ ফয়জুল হককে দেখেই বোঝা যাচ্ছে। একটু পরপর চোখ মুছছেন। আবার হাসছেন। সেই কান্না-হাসি দেখে আবেগাক্রান্ত ইমাম হোসেনও। তিনি বলেন, ‘আমার আট মাসের পরিশ্রম সার্থক হয়েছে। ছেলেটা আজ বাবার কাছে ফিরেছে। আমার কতটা ভালো লাগছে বুঝিয়ে বলতে পারব না।’
বাবাকে পেয়ে কেমন লাগছে জানতে চাইলে সাহাবুদ্দিন শরীর দুলিয়ে হাসতেই থাকল। আবার বাড়ি থেকে পালাবে কি না, জানতে চাইলে বলল, ‘আর কোনো দিন না।’
ঘণ্টাখানেকের কান্নাকাটি-কথাবার্তা শেষে প্রথম আলো ছাড়ার পালা পরিবারটির। বৃদ্ধ ফয়জুল হক ছেলেকে জড়িয়ে ধরে আছেন। বাবা-ছেলের মুখে হাসি, চোখে পানি। অামার অফিসের লোকজর দেখছে। তারাও হাসছে। সম্পাদক মতি ভাই পুরো ঘটনা শুনে তিনিও হাসছেন। ঘটনা জেনে পরিবারটিকে দেখতে বিকেল থেকে বসে ছিলেন অানিসুল হক।
কে চাইলে অাজকের পত্রিকার শেষ পৃষ্ঠায় পথ দেখাল চোখের পানি নিউজটা পড়তে পারেন। অামার প্রোফাইলেও নিউজটার লিংক
https://www.prothomalo.com/bangladesh/article/1169271/%e0%a6%aa%e0%a6%a5-%e0%a6%a6%e0%a7%87%e0%a6%96%e0%a6%be%e0%a6%b2-%e0%a6%9a%e0%a7%8b%e0%a6%96%e0%a7%87%e0%a6%b0-%e0%a6%aa%e0%a6%be%e0%a6%a8%e0%a6%bf%20%e0%a6%85%e0%a6%be%e2%80%8c%e0%a6%9b%e0%a7%87%e0%a5%a4
সত্যি বলছি, অামার কাছে এখনো মনে হচ্ছে কোন সিনেমার শুটিং করলাম। সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ অামার মতো এক সাংবাদিককে এই নাটকে যুক্ত করায়। বিশেষ ধন্যবাদ ইমাম অার তার বাবাকে। দুনিয়ার সব সন্তানরা ভালো থাকুক বাবা-মায়ের সাথে। ভালো থাকুক সব বাবা মা। ভালো থাকুক এই পৃথিবী।



