সন্ত্রাস নিয়ে বলতে মানা!
শরিফুল হাসান
নির্বাচন কমিশনার সাখাওয়াত হোসেনের সামনে আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য মেয়র পদপ্রার্থী সেলিনা হায়াত আইভী যখন সন্ত্রাস নিয়ে তাঁর উদ্বেগের কথা বলছেন, তখন পেছন থেকে চিৎকার করে তাঁকে থামিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন কিছু লোক।নারায়ণগঞ্জ শহরের শহীদ জিয়া হল মিলনায়তনে গতকাল বুধবার দুপুর দেড়টার দৃশ্যটি ছিল এমন। সিটি করপোরেশন নির্বাচন উপলক্ষে এখানেই আয়োজন করা হয়েছিল মতবিনিময়ের।আইভীর বক্তব্যের সময় হইচইয়ের কারণে একপর্যায়ে সভায় কিছুটা আতঙ্কও দেখা দেয়। তখন নির্বাচন কমিশনারকে উদ্দেশ করে আইভী বলেন, ‘মাননীয় কমিশনার, আপনার উপস্থিতিতেই এসব লোকজন হইচই করছে। সুতরাং নারায়ণগঞ্জের পরিস্থিতি কেমন, তা আপনাকে বুঝতে হবে।’আইভীর বক্তব্য শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বক্তব্য দেওয়া শুরু করেন আরেক সম্ভাব্য মেয়র পদপ্রার্থী শামীম ওসমান। তিনি বলেন, কোনো কারণ ছাড়াই নারায়ণগঞ্জে সন্ত্রাসের অভিযোগ করা হচ্ছে। কিন্তু এখানকার পরিস্থিতি অন্য জেলার চেয়ে ভালো। গণমাধ্যমের সমালোচনা করে তিনি বলেন, তারা অযথাই বিতর্ক সৃষ্টি করছে, মানুষকে ভুল বার্তা দিচ্ছে। এ সময় শামীম ওসমানের সমর্থনে হাততালি দিচ্ছিলেন জেলা প্রশাসক সামছুর রহমান।এর আগে বিএনপির সম্ভাব্য মেয়র পদপ্রার্থী তৈমুর আলম খন্দকার বলেন, ‘নারায়ণগঞ্জে বর্তমানে যে পরিস্থিতি, তাতে সেনাবাহিনী ছাড়া সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। তাই আমরা সেনাবাহিনী মোতায়েনের দাবি জানাচ্ছি।’বেলা সাড়ে ১১টায় শুরু হয় এ মতবিনিময় সভা। মিলনায়তন পরিপূর্ণ ছিল সম্ভাব্য কাউন্সিলর পদপ্রার্থী, তাঁদের সমর্থক, রাজনীতিক ও সুশীল সমাজের লোকজনের উপস্থিতিতে।বেলা সাড়ে ১১টায় তৈমুর আলম খন্দকার ও দুপুর ১২টায় সেলিনা হায়াত আইভী মিলনায়তনে উপস্থিত হন। দুপুর দেড়টায় মতবিনিময়ের প্রায় শেষপর্যায়ে আসেন শামীম ওসমান। সামনের কাতারে তাঁদের নির্দিষ্ট আসনে তিনজন বসেন পাশাপাশি।তবে সকাল থেকেই মিলনায়তনের চেয়ারগুলো দখল করে রেখেছিলেন একজন সম্ভাব্য মেয়র পদপ্রার্থীর সমর্থক আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীরা। আইভী বক্তব্য দেওয়ার সময়ে এঁরা হইচই শুরু করেন।কমিশনার সাখাওয়াত হোসেন বলেন, যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে, প্রশাসন তার কথা শোনে। আর নির্বাচনে অনেক প্রার্থী পুলিশ ও প্রশাসনকে কাজে লাগাতে চায়। কিন্তু প্রশাসন কোনো প্রার্থীর পক্ষে কাজ করছে—এমন অভিযোগ পাওয়া গেলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।নির্বাচন কমিশনার বলেন, ‘পুরো দেশ আজ দুই ভাগে বিভক্ত। প্রশাসন, পুলিশ, গণমাধ্যম—সর্বক্ষেত্রে এ বিভাজন ছড়িয়ে পড়েছে। আমাদের এ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।’সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘নির্বাচনে সন্ত্রাসী ব্যবহারের ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আমরা নারায়ণগঞ্জের নির্বাচনকে অনেক বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি। আমরা চট্টগ্রামের চেয়ে অনেক বেশি কঠোর থাকব নারায়ণগঞ্জে।’ ভোটারদের উদ্দেশে সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘আপনাদেরকে প্রার্থী টাকা দিলে তা নেবেন, কিন্তু ওই প্রার্থীকে ভোট দেবেন না। ভোট দিতে হবে বিবেক খাটিয়ে ভালো ও সৎ ব্যক্তিকে।’সভায় সেলিনা হায়াত আইভী বলেন, ‘নারায়ণগঞ্জের বর্তমান প্রশাসন পক্ষপাতিত্ব করছে। বর্তমান জেলা প্রশাসকের ভূমিকা নিয়ে আমি অনেকবার অভিযোগ করেছি। এই প্রশাসনের রদবদল দাবি করছি। এর পরও কমিশন যদি মনে করে, তারা সুষ্ঠু নির্বাচন করতে পারবে, তাহলে আমি সেই কথায় আস্থা রাখতে চাই।’সেলিনা হায়াত বলেন, নারায়ণগঞ্জের মানুষ সন্ত্রাস নিয়ে আতঙ্কিত। সন্ত্রাসীরা নির্বাচন প্রভাবিত করার চেষ্টা করছে। তিনি অভিযোগ করেন, নারায়ণগঞ্জে অনেক বড় বড় সন্ত্রাসী আছে। তারা অনেকে পালিয়ে ছিল, এখন আবার ফিরে এসেছে। আইভীর এ বক্তব্যের সময় মঞ্চের শেষের দিকে বসা কিছু লোক চিৎকার করে তাঁকে থামিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন।এরপর সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘আমি জেলা পুলিশকে বলে দিয়েছি, সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিন। পুলিশ যদি ব্যবস্থা না নেয়, আমাদের জানাবেন, আমরা অ্যাকশনে যাব।’সেলিনা হায়াত বলেন, এসব সন্ত্রাসীর বিরুদ্ধে মামলা দেওয়ার সাহস সাধারণ মানুষের নেই। আর কেউ মামলা দিতে গেলে সেই মামলা নেওয়ার সাহস পুলিশের নেই।আইভীর বক্তব্যের আগে জেলা যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শাহ মিজান গণমাধ্যমের কঠোর সমালোচনা করেন। তিনি অভিযোগ করেন, আমার দেশ পত্রিকা তাঁকে সন্ত্রাসী বানিয়েছে। তিনি গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সাখাওয়াত হোসেনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘এ বিষয়ে আপনার কোনো বক্তব্য থাকলে ওই পত্রিকায় প্রতিবাদ পাঠান। প্রেস কাউন্সিলে যান।’সভায় কয়েকজন সম্ভাব্য কাউন্সিলর পদপ্রার্থী ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) বিষয়ে প্রশ্ন তোলেন। এ ব্যাপারে সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘ইভিএম পদ্ধতিতে কারচুপির কোনো সুযোগ নেই। অনেকে তা জেনেও এ নিয়ে রাজনীতি করছেন। শিক্ষিত-অশিক্ষিত সবাই খুব সহজে এ মেশিনে ভোট দিতে পারবেন। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন এলাকার যেসব ওয়ার্ডে ইভিএম মেশিনে ভোট গ্রহণ চলবে, সেসব ওয়ার্ড ও শহরের একটি মিলনায়তনে এই ইভিএম মেশিনে ভোট দেওয়া সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে।’নির্বাচনসংশ্লিষ্ট নয়, এমন কোনো অনুষ্ঠানে প্রার্থীদের না যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন সাখাওয়াত। তিনি বলেন, হেরফেরের কোনো নির্বাচন বর্তমান কমিশন মেনে নেবে না। কোনো প্রার্থী আচরণবিধি লঙ্ঘন করলে কমিশন ওই প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিল, প্রয়োজনে নির্বাচন বন্ধ করে দিতে বাধ্য হবে।সাখাওয়াত হোসেন আরও বলেন, ‘সম্ভাব্য প্রার্থীরা একে অন্যের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। এ ক্ষেত্রে কমিশন অভিযুক্ত প্রার্থীর মনোনয়ন বাতিল করে দিতে পারে। ওই প্রার্থী যত বড় প্রভাবশালী হোন না কেন, বর্তমান কমিশন তাঁকে পরোয়া করবে না।’সাখাওয়াত বলেন, ইতিমধ্যে পুলিশের তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তার ও অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে প্রশাসনকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। প্রশাসন ব্যর্থ হলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সিটি করপোরেশন এলাকার তিনটি থানায় ওসিদের সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে একজন করে কর্মকর্তা থাকবেন। তাঁরা ওসিদের কর্মকাণ্ড মনিটরিং করবেন।এই সভায় সিটি নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা ও ঢাকা বিভাগীয় উপনির্বাচন কমিশনার বিশ্বাস লুৎফর রহমান, নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক মো. সামছুর রহমান, পুলিশ সুপার শেখ নাজমুল আলম, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মেহেদী হাসান, নারায়ণগঞ্জ জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা ফরহাদ হোসেন, ২৭টি ওয়ার্ডের সম্ভাব্য কাউন্সিলর পদপ্রার্থীরা এবং নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।এর আগে সকালে জেলা প্রশাসকের সম্মেলনকক্ষে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করেন সাখাওয়াত হোসেন।



