নেতিবাচক প্রভাব শ্রমবাজারে

Spread the love

সিঙ্গাপুরে নজরদারিতে বাংলাদেশিরা

শরিফুল হাসান

সিঙ্গাপুরে জঙ্গি সন্দেহে এখন পর্যন্ত ৪০ জন বাংলাদেশি আটকের ঘটনায় উৎকণ্ঠায় আছেন সেখানকার প্রবাসী বাংলাদেশিরা। তাঁরা বলছেন, শ্রমিকদের আবাসস্থলে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। সিঙ্গাপুরের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও গতকাল বিবৃতি দিয়ে নজরদারি বাড়ানোর কথা জানিয়েছে।
অন্যদিকে জনশক্তি রপ্তানিকারকেরা বলছেন, সিঙ্গাপুরের অনেক মালিক এখন বাংলাদেশি নিয়োগে আগ্রহ হারাচ্ছেন। সিঙ্গাপুরের অতি ঝুঁকিপূর্ণ বা অতি গুরুত্বপূর্ণ কোনো নির্মাণকাজে বাংলাদেশি কর্মীদের নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে না। এর বদলে ভারতীয়রা সেখানে নিয়োগ পাচ্ছেন। এ ছাড়া বাংলাদেশ থেকে এখন যাঁরা যাচ্ছেন, অনেক যাচাই-বাছাইয়ের পর তাঁদের সিঙ্গাপুরে আসার অনুমতি দেওয়া হচ্ছে। দ্রুত সমস্যার সমাধান করতে না পারলে এই বছরের শেষে সিঙ্গাপুরে অন্তত ১০টি বড় প্রকল্পে বাংলাদেশিরা না-ও নিয়োগ পেতে পারেন বলে আশঙ্কা করছেন জনশক্তি রপ্তানিকারকেরা।
বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী নুরুল ইসলাম গতকাল রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘সিঙ্গাপুর আমাদের খুব গুরুত্বপূর্ণ শ্রমবাজার। সেখানে বাংলাদেশিদের কাজের সুনাম রয়েছে। কিন্তু কিছু বাংলাদেশির অপরাধে সেটি যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেদিকে আমরা নজর রাখছি। দূতাবাসকে এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে বলেছি। কেউ অপরাধ করলে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
গতকাল বুধবার সিঙ্গাপুরের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বাংলাদেশি শ্রমিকদের ওপর নজরদারি বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে। এতে বলা হয়, গত বছরের শেষ দিকে জঙ্গি সম্পৃক্ততার অভিযোগে ২৭ বাংলাদেশিকে আটকের পর স্বরাষ্ট্র ও জনশক্তি মন্ত্রণালয় বাংলাদেশি শ্রমিকদের ব্যাপারে খোঁজখবর বাড়িয়েছে। বাংলাদেশিরা যেসব জায়গায় থাকছেন, সেখানে নির্দেশনা পাঠানো হয়েছে।
সিঙ্গাপুরের নির্মাণ খাত, জাহাজশিল্প ও প্রক্রিয়াজাত শিল্পে দেড় থেকে দুই লাখ বাংলাদেশি কাজ করছেন। প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়, জনশক্তি রপ্তানিকারক ও সিঙ্গাপুরপ্রবাসীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১৯৭৯ সালে ১১০ জন বাংলাদেশি দেশটিতে কাজ করতে যান। ধীরে ধীরে এই সংখ্যা বাড়তে থাকে। নব্বইয়ের দশক থেকে নির্মাণ ও জাহাজশ্রমিক হিসেবে বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশি সেখানে যেতে শুরু করেন।
প্রবাসী বাংলাদেশিরা বলছেন, ভারতীয় শ্রমিকদের তুলনায় কম বেতন, দক্ষ ও কঠোর পরিশ্রমী হওয়ার কারণে দেশটিতে বাংলাদেশি শ্রমিকদের চাহিদা রয়েছে। কিন্তু চার মাসের ব্যবধানে পরপর দুই দফা বাংলাদেশি শ্রমিকদের জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ার পর থেকে পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে।
সিঙ্গাপুরপ্রবাসী বাংলাদেশি প্রকৌশলী মনজুরুল আলম গতকাল বিকেলে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি যে প্রতিষ্ঠানে কাজ করি, সেখানে ১০ হাজার বাংলাদেশি কাজ করেন। সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের গ্রেপ্তারের পর থেকে বাংলাদেশিদের ওপর নজরদারি চলছে; বিশেষ করে মসজিদগুলোতে।’
চাঁদপুর থেকে যাওয়া দুজন প্রবাসী শ্রমিক শাহেদুল করিম ও সুলতানু হোসেন বলেন, বাংলাদেশি শ্রমিকেরা সবচেয়ে বেশি আতঙ্কে আছেন। এমনকি নামাজ পড়তে যেতেও অনেকে ভয় পাচ্ছেন এখন। সিঙ্গাপুরের বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব মেরিন টেকনোলজি অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি হাসান মিয়া মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘সমস্যা খুবই গুরুতর। আমরা যথাযথ ব্যবস্থা না নিতে পারলে পাকিস্তানিদের যেমন এখানে বাসিন্দা হতে দেয় না, বাংলাদেশিদের ক্ষেত্রেও তা হতে পারে। সমস্যা সমাধানে দূতাবাসসহ প্রবাসী সব সংগঠনকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।’
২৬ বছর ধরে সিঙ্গাপুরপ্রবাসী এবং সেখানকার বাংলা পত্রিকা বাংলার কণ্ঠর সম্পাদক এ কে এম মোহসিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত বছরের নভেম্বরে এবং সর্বশেষ এ বছরের মার্চ ও এপ্রিলে ১৩ বাংলাদেশি গ্রেপ্তারের পর বাংলাদেশি শ্রমিকেরা আতঙ্কে আছেন। কখন তাঁদের পাঠিয়ে দেওয়া হয়—সেই ভয় সবার মধ্যে। এ ছাড়া সিঙ্গাপুরের অনেক মালিকও এখন নতুন করে বাংলাদেশি আনতে চাইছেন না। আমরা দেখেছি, অতীতে কোনো ঘটনা ঘটলেই দূতাবাস উদ্যোগ নেয়। পরে আবার থেমে যায়। এবার সেটি করলে চলবে না। কারণ সমস্যা গুরুতর।’
জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭৬ থেকে ২০১৬ সালের এপ্রিল পর্যন্ত ৬ লাখ ১৫ হাজার ৫২২ জন বাংলাদেশি সিঙ্গাপুরে কাজ করতে গেছেন। গত বছরও ৫৫ হাজার ৫২৩ জন বাংলাদেশি সেখানে প্রবাসী হয়েছেন। আর এ বছরের চার মাসে গেছেন ১৯ হাজার ২১৮ জন।
সিঙ্গাপুরে বাংলাদেশি কর্মী পাঠানোর অনুমতি আছে ১৪টি প্রতিষ্ঠানের। এদের একটি মেরিট ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হাসান আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘গত বছরের শেষে ২৭ বাংলাদেশিকে গ্রেপ্তারের পর থেকে বাংলাদেশে চাহিদাপত্র কম আসছে। আমাদের ভয় হলো, এই বছরের শেষে সিঙ্গাপুরে অনেকগুলো বড় প্রকল্প নেওয়া হবে। সেসব প্রকল্পে হাজার হাজার লোক লাগবে। সমস্যার সমাধান করতে না পারলে আমরা এই বাজার হারাব।’
সিঙ্গাপুরের দ্য স্ট্রেইটস টাইমসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে দেশটির জনশক্তি আমদানিকারকেরা বলেছেন, জঙ্গি সম্পৃক্ততার অভিযোগে ২৭ বাংলাদেশি আটকের পর থেকেই বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি আমদানির ক্ষেত্রে কিছু শর্ত মানতে হচ্ছে। বাংলাদেশিদের জন্য কাজের অনুমতিপত্র পেতেও সমস্যা হচ্ছে। নিজের নাম, বাবা-মা-অভিভাবকের নামধাম ছাড়াও শ্রমিককে বাংলাদেশের যে গ্রাম থেকে আনা হচ্ছে, সেখানকার পূর্ণাঙ্গ তথ্যও জানাতে হচ্ছে। দেশটির জনশক্তি মন্ত্রণালয়ের সূত্র উল্লেখ করে সংবাদপত্রটি বলছে, সব প্রতিষ্ঠানের মূল্যায়নের ভিত্তিতে এখন বাংলাদেশি শ্রমিকদের কাজের অনুমতি দেওয়া হচ্ছে।
সিঙ্গাপুরের কে এফ এমপ্লয়মেন্ট কনসালট্যান্টসের মালিক কেন্ট এনজি বলেন, এখন কর্মীদের পারিবারিক বৃত্তান্ত বেশি জানতে চাওয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশি শ্রমিকেরা ভালো ও পরিশ্রমী কর্মী হিসেবে দেশটিতে প্রশংসিত।
পিপল ওয়ার্ল্ডওয়াইড কনসাল্টিংয়ের মালিক ডেভিড লিয়ং বলছেন, সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশি শ্রমিকদের চাহিদা কমেছে। জনশক্তি আমদানিকারক বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান বলেছে, তারা বাংলাদেশি শ্রমিক নিয়োগের ক্ষেত্রে বাড়তি যাচাই-বাছাই করবে। কেএসপি এমপ্লয়মেন্ট এজেন্সির প্রতিষ্ঠাতা জ্যাকি লি বাংলাদেশি শ্রমিকদের সিঙ্গাপুরে আসার আগেই স্কাইপে জানিয়ে দিচ্ছেন, তাঁরা কী করতে পারবেন আর কী পারবেন না।
এসব সমস্যার বিষয়ে জানতে চাইলে জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সংগঠন বায়রার সভাপতি আবুল বাসার বলেন, ‘সিঙ্গাপুর আমাদের প্রধান শ্রমবাজার। গুটি কয়েক বাংলাদেশির অপরাধে যেন এই বাজার ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সে জন্য আমাদের সবার সতর্ক হওয়া উচিত।’
সার্বিক বিষয়ে জানতে সিঙ্গাপুরে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মাহবুব-উজ-জামানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি গতকাল মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রবাসী শ্রমিকেরা কেউ বিপথে চলে যাচ্ছেন কি না, সে বিষয়ে আমরা খোঁজখবর রাখছি। এ বিষয়ে কারও কাছে কোনো তথ্য থাকলে তা-ও জানাতে বলছি। আমরা মনে করি, শ্রমিকেরা যেন কোনো সমস্যায় না পড়েন, সেটা দেখা আমাদের দায়িত্ব। আমরা চাই বাংলাদেশিরা যে কাজে এসেছেন, সেদিকেই মনোযোগ দিন।’ তিনি আরও বলেন, শ্রমিকেরা যেখানে থাকেন, সেসব জায়গায় আগে দূতাবাসের প্রতিনিধিরা কমপক্ষে দুবার পরিদর্শনে যেতেন। এখন থেকে আরও ঘন ঘন যাওয়ার পরিকল্পনা আছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published.