শরিফুল হাসান
মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার সাতবাড়িয়া গ্রামের আলমগীর হোসেন স্বপ্ন দেখেছিলেন, বিদেশে গিয়ে ভাগ্যের চাকা ঘোরাবেন। এলাকার আদম ব্যবসায়ী হালান ফরায়েজী ও জহির তাঁকে গ্রিসে পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দেন। জমিজমাসহ সর্বস্ব বিক্রি করে চার লাখ টাকা দেন আলমগীর। টাকা নিয়ে পালিয়ে যায় দালালেরা। আলমগীর এখন ঢাকায় সিএনজিচালিত অটোরিকশা চালান। আলমগীরের মতোই হাজার হাজার বাংলাদেশি বিদেশে যাওয়ার নামে প্রতিনিয়ত এভাবে প্রতারিত হচ্ছেন। দালালদের সহায়তায় বিদেশে যেতে পারলেও সরকার-নির্ধারিত খরচের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি টাকা ব্যয় করতে হয়। মালয়েশিয়া যেতে সরকারি খরচ ৮৪ হাজার টাকা, অথচ দিতে হয় দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা।দেশের জনশক্তি রপ্তানির কোনো আইনেই দালাল বা মধ্যস্বত্ব্বভোগী বলে কিছু নেই। অথচ গ্রামগঞ্জ ও শহরে ছড়িয়ে আছে ৫০ হাজার থেকে লাখ খানেক দালাল। তারাই বছরের পর বছর ধরে জনশক্তি রপ্তানির নিয়ন্ত্রক। জনশক্তি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো বিদেশে লোক পাঠাতে সরাসরি এই দালালদের ওপরই নির্ভর করে। তাই প্রতারণা কোনোভাবেই বন্ধ হচ্ছে না। জনশক্তি রপ্তানি খাতের সার্বিক দেখভালের দায়িত্বে থাকা জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) মহাপরিচালক খোরশেদ আলম চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো দালালদের ওপরই নির্ভরশীল। দালালদের শরণাপন্ন না হয়ে সরাসরি রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোতে যাওয়া উচিত। বিদেশগামীরা জেলা প্রশাসনের অধীন প্রবাসীকল্যাণ ডেস্ক বা জেলা কর্মসংস্থান অফিসে গিয়েও নাম নিবন্ধন করতে পারেন।অভিবাসনবিষয়ক বেসরকারি সংস্থা ইমা রিসার্চ ফাউন্ডেশনের সমন্বয়ক আনিসুর রহমান খান প্রথম আলোকে বলেন, দালালদের সঠিক সংখ্যা কত, তা জানা নেই। মনে করা হয়, দেশের এক হাজার রিক্রুটিং এজেন্সির অধীনে সারা দেশে ৫০ হাজার দালাল আছে। এর বাইরেও দালাল হিসেবে কাজ করে আরও ৫০ হাজার মানুষ। দালালপ্রথা বন্ধ না হলে জনশক্তি রপ্তানি খাতে কখনোই স্বচ্ছতা আসবে না, বন্ধ হবে না প্রতারণাও। জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সংগঠন বায়রার সভাপতি আবুল বাশার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা চাই না দালালপ্রথা থাকুক। আমরা চাই লোকজন সরাসরি আমাদের কাছে আসুক। কিন্তু গ্রামের লোকজন এখনো মনে করে, ঢাকায় গেলে তাদের নিরাপত্তা দেওয়ার কেউ নেই। তাই তারা এলাকার পরিচিত কোনো দালাল ধরে। এ কারণে এই প্রথা ভাঙা যাচ্ছে না।’ কেন দালালপ্রথা: সরকারি সব প্রচারণায় বলা হয়, বিদেশে যাওয়ার জন্য কোনো দালাল বা মধ্যস্থতাকারী না ধরে সরাসরি রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে বিদেশে যান। এই প্রচারণা কোনো কাজেই আসছে না। অভিবাসনবিষয়ক সংস্থা রামরুর সমন্বয়ক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক সি আর আবরার প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিদেশগামী এবং রিক্রুটিং এজেন্সি দুই পক্ষই এখন দালালদের ওপর নির্ভরশীল। একজন কর্মী বিদেশে যেতে চাইলে কোথায় যাবেন, কী করবেন—সে ব্যাপারে যথেষ্ট সরকারি তথ্য নেই। এই সুযোগ নেয় দালালেরা। আবার রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর তৃণমূলে কোনো কার্যক্রম নেই। তাদের সবার অফিস ঢাকায়। ফলে তাদেরও বিদেশে পাঠানোর জন্য লোক আনতে এই দালালদের ওপর নির্ভর করতে হয়। এভাবেই দালালপ্রথা টিকে আছে বছরের পর বছর। প্রমাণ ছাড়া টাকা লেনদেন: দালালদের মাধ্যমে আড়াই লাখ টাকা খরচ করে মালয়েশিয়া গিয়েছিলেন নোয়াখালীর করিম শিকদার, আক্কাস আলীসহ ১২ জন। কিন্তু সেখানে গিয়ে চাকরি না পেয়ে দেশে ফিরে এসে রিক্রুটিং এজেন্সির বিরুদ্ধে বিএমইটিতে অভিযোগপত্র দেন। কিন্তু আড়াই লাখ টাকা দেওয়ার কোনো রসিদ তাঁরা দেখাতে পারেননি। দুবাই যাওয়ার জন্য দেড় লাখ টাকা দিয়েছিলেন কুষ্টিয়ার খোকসা উপজেলার জুয়েল রানা। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, দালাল টাকা নিয়ে পালিয়ে গেলে তিনি থানায় মামলা করতে যান। কিন্তু রসিদ না থাকায় মামলা করতে পারেননি। অভিবাসন খরচ বাড়ছে: মালয়েশিয়া-ফেরত অভিবাসী এবং বর্তমানে একটি অভিবাসনবিষয়ক বেসরকারি সংস্থায় কর্মরত জয়নাল আবেদিন বলেন, ‘আমি অসংখ্য শ্রমিকের সঙ্গে কথা বলেছি। সবাই একটি কথাই বলেছেন, গ্রামে-শহরে, ঢাকায় কয়েকবার তাঁদের দালালদের টাকা দিতে হয়েছে। ফলে সরকারি খরচ ৮৪ হাজার টাকা হলেও দেখা যায়, একজন শ্রমিককে দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা খরচ করতে হয়েছে।’ সি আর আবরার বলেন, বাংলাদেশ থেকে বিদেশে যাওয়ার খরচ পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি। এর অন্যতম কারণ এই দালালপ্রথা। যত হাত ঘোরে, অভিবাসন খরচ তত বাড়ে। অভিবাসন খরচ কমাতে হলে এই দালালপ্রথা ভাঙতে হবে। বিএমইটির মহাপরিচালক খোরশেদ আলম চৌধুরীও বিষয়টি স্বীকার করেন। ঢাকার বাইরে কারও অফিস নেই: বায়রার তথ্য অনুযায়ী, দেশে এখন এক হাজার রিক্রুটিং এজেন্সি আছে। কিন্তু এদের সবার অফিসই ঢাকায়। সরকারিভাবে ঢাকার বাইরে তাদের অফিস নেওয়ার জন্য বলা হলেও কেউ-ই ঢাকার বাইরে অফিস নেয়নি।অভিবাসনবিষয়ক বেসরকারি সংস্থা অকুপের চেয়ারম্যান শাকিরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, কোনো রিক্রুটিং এজেন্সির ঢাকার বাইরে কোনো শাখা বা কার্যালয় নেই। তৃণমূল পর্যায়ে তাদের কোনো যোগাযোগও নেই। ফলে গ্রামের একজন মানুষকে ঢাকায় নিয়ে আসতে সহায়তা করে এই দালালেরা। আর এভাবেই প্রতিটি গ্রামে-শহরে ক্রমেই শক্ত হচ্ছে এই দালালপ্রথা। সমস্যা সমাধান করতে হলে ঢাকার বাইরে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোকে যেতে হবে। বিএমইটির মহাপরিচালক খোরশেদ আলম চৌধুরী বলেন, ঢাকার বাইরে রিক্রুটিং এজেন্সিকে অফিস খোলার জন্য বারবার বলা হলেও কেউ-ই অফিস খোলেনি। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বায়রার সভাপতি আবুল বাশার বলেন, ‘এখন ব্যবসা ভালো না। ব্যবসা ভালো হলে আমরা ঢাকার বাইরে যাব।’ বিদেশেও আছে দালাল: এরা সাধারণত ওই দেশের বাংলাদেশি অভিবাসী। দীর্ঘদিন ধরে থাকায় তাদের সঙ্গে প্রতিষ্ঠানের মালিকসহ অনেকের সম্পর্ক হয়। এরাই ভিসা বের করে বিক্রি করে দেয় দেশের রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর কাছে। এ সময় তারা দামাদামি করে। ফলে ভিসার দাম বাড়ে, অভিবাসন খরচও বেড়ে যায়। জানা গেছে, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, ওমান, কুয়েত, সিঙ্গাপুরসহ সব জায়গায় এই দালালপ্রথা গজিয়ে উঠেছে। এশিয়ার অভিবাসনবিষয়ক ১৮টি বেসরকারি সংস্থার সমন্বয়কারী সংস্থা মালয়েশিয়ার কারাম এশিয়ার সমন্বয়ক হারুন-আল-রশিদ প্রথম আলোকে বলেন, মালয়েশিয়ায় প্রভাবশালী ৪০ থেকে ৫০ জন দালাল রয়েছে, যারা বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ করে। এরা সবাই একসময়ে শ্রমিক ছিল। সরাসরি টাকা না নেওয়ার অভিযোগ: সরকারি সব প্রচারপত্রে সরাসরি রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোকে টাকা দিতে প্রচার চালানো হয়। তবে বিদেশগামী অনেকেই অভিযোগ করেছেন, সরাসরি গেলে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো টাকা নেয় না। বায়রার সভাপতি আবুল বাশার অভিযোগ অস্বীকার করে কেউ এমন করলে তাদের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগের পরামর্শ দেন। মধ্যস্থতাকারীদের ভাষ্য: জনশক্তি রপ্তানির মধ্যস্থতাকারী হিসেবে জড়িতরা বেশির ভাগই নাম প্রকাশ করে কোনো কথা বলতে চাননি। অন্যতম ব্যতিক্রম চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাইমুল হক। ঢাকার আরামবাগে থাকেন, আট থেকে দশটি রিক্রুটিং এজেন্সির সঙ্গে কাজ করেন। কীভাবে লোক আনেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রংপুর থেকে লোক এনে ঢাকার বিভিন্ন অফিসে যাই। ধরেন, রাজ ওভারসিজ দর ঠিক করে দিল এক লাখ ৩০ হাজার টাকা। আমি তখন বিদেশে যেতে চায় এমন কাউকে খুঁজে এক লাখ ৫০ হাজার টাকা নিই। এরপর আমি রাজ ওভারসিজে যাই। কোম্পানির এজেন্টকে লোক দিয়ে আসি। এভাবে ২০-২৫ হাজার টাকা লাভ থাকে।’ আরেকজন মধ্যস্থতাকারী ঢাকার নবাবগঞ্জের আবদুল মোতালেব জানান, ‘এলাকা থেকে লোক এনে আকাশভ্রমণ রিক্রুটিং এজেন্সিতে যাই। একটা কাজে আমার ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা লাভ থাকে’। প্রতারণা করা নিয়ে জানতে চাইলে মোতালেব বলেন, মূলত গ্রাম থেকে যারা লোক আনে, তারাই প্রতারণা করে। অনেক সময়ই তারা টাকা মেরে দেয়। অভিবাসন খরচ কেন বাড়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘যত হাত ঘোরে তত খরচ বাড়ে।’ পরিচয়পত্র দেওয়ার প্রস্তাব: সি আর আবরার গ্রামগঞ্জ ও শহরে ছড়িয়ে থাকা দালালদের রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর পরিচয়পত্র দেওয়ার সুপারিশ করে বলেন, ইউনিয়ন পর্যায় এবং থানায় তাদের নামের তালিকা দেওয়া হোক। যাতে যে কেউ-ই দালাল সেজে প্রতারণা না করতে পারে। এই দালালদের নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোকে দেওয়া উচিত। দরকার সচেতনতা: বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও প্রবাসীকল্যাণসচিব জাফর আহমেদ খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘দালালপ্রথা বা মধ্যস্থতাকারীদের কারণে অভিবাসন খরচ বেড়ে যায়। প্রতারণাসহ নানা সমস্যা সৃষ্টি হয়। এই সমস্যা সমাধানে সরকারি তথ্যভান্ডার গড়ে তোলাসহ অনেক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিদেশগামীদের এসব ব্যাপারে সচেতন হতে হবে। সরকারি ও বেসরকারি সব সংস্থা মিলে আমরা জনগণকে এ ব্যাপারে সচেতন করতে পারি।’ ওকুপের চেয়ারম্যান শাকিরুল ইসলাম ও ইমার আনিসুর রহমান বলেন, ‘অভিবাসীদের সতর্ক করার উদ্যোগটিও সরকারকেই নিতে হবে। সরকারিভাবেই এ ব্যাপারে যথেষ্ট প্রচারণা নেই।