ব্র্যাকের ৫০ বছর পুর্তি !

Spread the love

শরিফুল হাসান

আমার দুই পাশে যে দুজন মানুষকে দেখছেন তাদের গল্প আপনাদের মুগ্ধ করবে। দুজনেই মানুষের জন্য দারুণভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। নয়ন ভাই ও ফাইরুজ আপা। দুইজনের সঙ্গেই আমার প্রথম যোগাযোগটা হয়েছিল সাংবাদিকতার সুবাদে। একজনের সঙ্গে একযুগেরও বেশি সময় আগে, আরেকজনের সঙ্গে আটবছর আগে। সৌভাগ্যবশত এই দুজনেই এখন আবার কাজের সূত্রে আমার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ। একজন মাইগ্রেশন পোগ্রামে কাজ করেন আরেকজনের নবজন্ম ব্র্যাকের ইয়ুথ প্লাটফর্ম আমরা নতুন নেটওয়ার্কের মধ্যে দিয়ে।

ব্র্যাকের ৫০ বছর পুর্তি উপলক্ষ্যে আমরা আজকে যে কয়েকজন মানুষের গল্প শুনেছি তার মধ্যে এই দুজনও ছিলেন। তাদের গল্প আমাদের সবার মন ছুঁয়ে গেছে।

নয়ন ভাই সর্ম্পকে বলতে গেলি আমি বলি, এই পৃথিবীতে কিছু কিছু মানুষ থাকে যাদের জন্মই হয়েছে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য। এমনি একজন মানুষ Al-Amin Noyon। মালয়েশিয়ায় কাজের জন্য গিয়ে নিপীড়নের শিকার। তাঁর মতো আর কাউকে যেন কষ্টে পড়তে না হয় সে কারণে দেশে ফিরে গত এক যুগ ধরে প্রবাসীদের জন্য ক্লান্তিহীনভাবে কাজ করছেন মানুষটা। গত পাঁচ বছর ধরে ব্র্যাকের মাইগ্রেশন পোগ্রামের হয়ে ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে কাজ করছেন। এই সময়ে অন্তত বিশ হাজার মানুষ কোন না কোনভাবে তার মাধ্যমে সহায়তা পেয়েছে।

আমি উন্নয়ন সংস্থায় কাজ করা মানুষ নই। সাংবাদিকতা করেছি সারাজীবন। তাই প্রথম যখন আমরা ভাবলাম বিমানবন্দরে আসা অসহায় বিদেশ ফেরত মানুষকে সহায়তা করবো অনেকেই ভেবেছিল কী করে সম্ভব? সবার সহযোগিতায় সেই অসম্ভব কাজকে সম্ভব করেছে নয়ন ভাই। দিন নেই, রাত নেই, ভোর নেই সবসময় তিনি বিমানবন্দের হাজির।

এই কাজে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় বিশেষ করে এয়ারপোর্টের ওয়েলফেয়ার ডেস্ক, এপিবিএন, বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ, সিভিল এভিয়েশন সবাই যেভাবে সবসময় সহযোগিতা করে যাচ্ছে সেটা না বললেই নয়। জাতিসংঘের সংস্থা ইউএনডিপি বছর দুয়েক আগে নয়ন ভাইকে পরিবর্তেনর রূপকার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। নয়ন ভাইকে নিয়ে বছর দুয়েক আগে প্রথম আলো একটা নিউজ করেছিল যার শিরোনাম এই মোমবাতির নাম ‘নয়ন ভাই। এখানে বিস্তারিত পাবেন। 

(https://www.prothomalo.com/…/%E0%A6%8F%E0%A6%87-%E0%A6…)

আজ বরং আপনাদের সঙ্গে আরেকজনের পরিচয় করিয় দেই। ফাইরুজ ফাইজা বিথার।  ২০০৯ সালের ১২ জুলাই দিনটা ফাইরুজের জন্য সবচেয়ে কষ্টের দিন। খুলনার স্কুলপড়ুয়া ফাইরুজের সেই দিনটা শুরু হয় করুণ এক দুঃসংবাদ পেয়ে। খবর আসে, তাঁর বাবা কাউন্সিলর শহীদ ইকবাল বিথারকে সন্ত্রাসীরা হত্যা করেছে। এরপর ফাইরুজআর তাঁর মা রুনু ইকবাল বিথারের নতুন লড়াই শুরু হয়।

ও হ্যা, নয়ন ভাইকে আমি পেয়েছিলাম সাংবাদিক হিসেবে। এরপর আমি ব্র্যাকে যোগ দেওয়ার পর সে আমাদের টীমে যোগ দেয়। আর আটবছর আগে ফাইরুজ যখন কলেজে পড়ে সে সময় আমি প্রথম তাঁর সঙ্গে কথা বলেছিলাম তাঁর বাবার হত্যাকাণ্ড নিয়ে। এ নিয়ে আমি একটা অনুসন্ধানী নিউজ করেছিলাম যে তাঁর বাবাকে একজন সাংসদ হত্যা করেছেন। সেই ফাইরুজ আজ মানুষের মনের যন্ত্রণা দূর করার চেষ্টা করছে। কীভাবে সেটার শুরু হয়েছিল সেই গল্পটা শুনুন।

বাবার মৃত্যুর পর জীবনের চড়াই-উতরাইয়ের মধ্যে মনের ভাঙা-গড়া দেখেছেন ফাইরুজ। মানসিকভাবে একটা সংকটময় সময় পার করছিলেন ফাইরুজ। সেই সময় তাঁর মা একদিন তাকে সাইক্রিয়াটিস্টের কাছে নিয়ে যান। মানিসক স্বাস্থ্য কতোটা জরুরী মানুষের জন্য সেই প্রথম বুঝতে পারেন ফাইরুজ। উপলব্ধি করতে থাকেন, একজন মানুষের কঠিন সময়ে মানসিক স্বাস্থ্যের পরিচর্যা কতটা দরকার। এরপর ফাইরুজ ঠিক করেন তিনি সাইকোলজি পড়বেন।

২০১৬ সালে উচ্চশিক্ষার জন্য গিয়েছিলেন অস্ট্রেলিয়ায়। সেখানকার ম্যাককোয়াইরি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিও হয়েছিলেন। ছয় মাস পর ছুটিতে দেশে এসে দেখেন তাঁর মা তাকে ছাড়া সংকটে আছেন। এবার মায়ের কথা ভেবে দেশে থাকার সিদ্ধান্ত নেন। ভর্তি হলেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন্যান্স বিষয়ে। কিন্তু সবসময় মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে ভাবতেন।

আপনাদের শুনে ভালো লাগবে তরুণদের নিয়ে কাজ করার জন্য ব্র্যাকের একটা ইয়ুথ প্ল্যাটফর্ম আছে। মাইগ্রেশনের পাশাপাশি এই মাস থেকে আমি তরুণদের এই কাজটায় যুক্ত হয়েছি।  এই প্ল্যাটফর্মের আওতায় আমরা তরুণদের নিয়ে নিয়মিত ‘আমরা নতুন নেটওয়ার্ক’-এর প্রশিক্ষণের আয়োজন করা হয়। খুলনায় এমনি একটা প্রশিক্ষণ কর্মশালায় নিয়মিত অংশগ্রহণ করতেন ফাইরুজ। প্রশিক্সণ শেষে আমরা তরুণদের কাছে জানতে চাই এই দেশের কোন সমস্যাটার সমাধান তারা করতে চান। এরপর তাদের ছোট ছোট কয়েকটি দলে ভাগ করে দেওয়া হতো।

নানাজন নানা সমস্যা সমাধানের কথা বলেন। ফাইরুজ বলেন তিনি মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করতে চান। তাঁর সঙ্গে ছিলেন রাগিব শাহরিয়ার, আরিফ ইসলাম, মুহিব উল্লাহ ও মাহবুবুর রহমান। সেদিন সেই দলের সবাই একমত হন খুলনায় মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার অপ্রতুলতার ব্যাপারে। এভাবেই শুরু হয় মনের স্কুলের ভিত গড়ার কাজ। এ পর্যন্ত হাজারেরও বেশি শিক্ষার্থী ও তরুণকে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা দিয়েছেন তাঁরা। অন্তত ১০০ জনকে অভিজ্ঞ কাউন্সেলরের সাহায্য নিতে উদ্বুদ্ধ করেছেন এবং যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছেন।

আপনারা জানেন, করোনা মহামারি শুরুর পর মানুষের মনের ওপর নানা চাপ তৈরি হয়। মানসিক সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতে ফাইরুজ ও তাঁর দল তখন ফেসবুক মনের স্কুলের মাধ্যম সেবা শুরু করেন। বর্তমানে গ্রুপটির সদস্যসংখ্যা ১০ হাজার ছাড়িয়েছে। বিস্তারিত এখানে পাবেন। (https://www.prothomalo.com/…/%E0%A6%AB%E0%A6%BE%E0%A6…)

ফাইরুজদের এই উদ্যোগ গতবছর বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনের ‘চেঞ্জমেকার অ্যাওয়ার্ড’ পেয়েছে। ২১ সেপ্টেম্বর বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে ফাইরুজের নাম ঘোষণা করা হয়।  ফাইরুজ অবশ্য আজ আমাদের বলছিলেনন, এই পুরস্কারে তিনি খুশি। তবে তাদের জন্য সবচেয়ে বড় পুরস্কার হলো যখন একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী বলছিলেন আগেরদিন রাতভর যদি মনের স্কুলের বন্ধুরা তার সঙ্গে কথা না বলতেন তাহলে তার পরদিনের সকালটা দেথা হতো না। এই কাউন্সিলিংই আসলে তাকে বাঁচিয়েছে।

ফাইরুজের কথা শুনতে শুনতে ভীষণ কান্না পাচ্ছিল। শুধু ফাইরুজ বা নয়ন ভাই নয় ব্র্যাকের ৫০ বছর উপলক্ষে আজকে বেশ কয়েকজনের গল্প শুনছিলাম। শুনতে শুনতে বারবার চোখ মুছছিলাম। বারবার মনে হচ্ছিল, আরকেজন মানুষের পাশে দাঁড়ানোতেই আসলে জীবনের সব স্বার্থকতা। আর এভাবেই মানুষের জয় হোক।

Leave a Reply

Your email address will not be published.